হাওয়া করার চাকরি করতেন আর্দালিরা, কোথায় গেল তালপাতার পাখা!

অনেকদিন হল ঘরে ঘরে নিবেছে লন্ঠন, কুপি। লোডশেডিংয়ের দাপট কমেছে। ক্যালেন্ডার জানান দিচ্ছে, বৈশাখ শুরু হলো। খুঁজতে থাকি বৈশাখী অনুষঙ্গ। তখনই মনে আসে ঘরে ঘরে তালপাতার পাতার শনশনে হাওয়া আজ উধাও। তালপাতার পাখা আজ নস্ট্য়ালজিয়া। স্মৃতি মলিন হলেও বাংলার লোকসংস্কৃতির সাক্ষী এই তালপাতার পাখা। তবে তার আঁচ পেতে যেতে হবে পেছনের দিকে। 


শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমের পাখা-এটাই বহুকাল ছিল বাঙালির জীবনের অঙ্গ। এখন সব ইতিহাসের পাতায় ভিড় করছে। তবে ছাতা এখনও জীবন থেকে পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়নি। লন্ঠন, কুপি তখনও নেবেনি। লোডশেডিং হলেই তখন পুরো পরিবার ছাদে কিংবা উঠোনে। সঙ্গে গায়ে কাঁটা দেওয়া ভূতের গল্প। ঘর্মাক্ত অবস্থায় তালপাতার পাখার হাওয়ায় স্বস্তি। এসব আজ স্মৃতির পাতার ভিড় করেছে। তবু একটা কথা জোরের সঙ্গে বলা যায়, বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য আজও বহন করছে এই তালপাতার পাখা। কীভাবে?
নকশি পাখা অর্থাৎ  নকশাযুক্ত হাতপাখা  লোকশিল্পের অন্যতম উদাহারণ।  হাতপাখার ব্যবহার গ্রামাঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত।  এ হাতপাখাকে আকর্ষণীয় করার জন্য একে  নানা নকশায় শোভিত করা হত। তখনই একে বলা হত নকশি পাখা।

 
নকশি পাখার উপকরণ প্রধানত সুতা,  বাঁশ, বেত, খেজুরপাতা, শোলা, তালপাতা ও শণ। ময়ূরের পালকের পাখা ও চন্দন কাঠের পাখাও প্রচলিত ছিল। ময়ূরের পালকের পাখায় বাড়তি কোনও নকশার দরকার হত না। নকশি পাখায় মূলত যে চিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হত, তার ওপর ভিত্তি করেই এর নামকরণ হত। যেমন: ভালোবাসা, কাঁকইর জালা, গুয়াপাতা, পালংপোষ, শুজনিফুল, বলদের চোখ, শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, ছিটাফুল, তারাফুল, মনবিলাসী, মনবাহার, বাঘবন্দী, ষোলকুড়ির ঘর, মনসুন্দরী, লেখা, সাগরদীঘি, হাতি-ফুল-মানুষ, গম্বুজ তোলা, পাশার দান, যুগলহাঁস, যুগল ময়ূর ইত্যাদি।
গ্রামবাংলার জনপ্রিয় পাখা হচ্ছে তালপাতার পাখা। একটি তালপাতা থেকে একটি মাত্র পাখা তৈরি হত। পাকা তালপাতা গোল করে কেটে তার চতুর্দিকে বাঁশের সরু চটি দিয়ে বাঁধা হত। এরপর সরু বেতি দিয়ে ছোট ছোট তিনকোণা নকশা তোলা হত। এছাড়া তালপাতা সরু করে কেটে বুননের সাহায্যে নকশি পাখা তৈরি করা হত।

বর্তমানে বিভিন্ন লোকমেলায় শোলার তৈরি এক ধরনের পাখা পাওয়া যায়। এ পাখা অত্যন্ত হালকা। শোলা পাতলা করে কেটে একটি কাগজের পাতলা বোর্ডের উপর আঠা দিয়ে লাগিয়ে এ পাখা তৈরি করা হয়। শোলার তৈরি পাখায় অনেক সময় রঙের সাহায্যে নানা ধরনের নকশাও ফুটিয়ে তোলা হয়। বিশেষ করে পালা-পার্বণ বা গ্রামীন মেলায় এ ধরনের পাখা এখনও দেখা যায়।

চন্দন কাঠের পাখা এদেশীয় না হলেও এদেশের বিত্তবান পরিবারের মেয়েরা আঠারো-উনিশ শতকে তা ব্যবহার করতেন। বর্তমানেও এর ব্যবহার আছে। চন্দন কাঠের ফোল্ডিং পাখার অনুকরণে এ দেশে এখন তালপাতার ফোল্ডিং পাখা তৈরি হয়। যুগের চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিকের পাখা। কালেদিনে পাখার এই শিল্পকলা দেখতে আগামী প্রজন্মকে জাদুঘরে না ছুটতে হয়!

আরও পড়ুন-আকবরের সময় থেকেই চলছে পয়লা বৈশাখ উদযাপন!

আগেকার দিনে রথের মেলায় বা বিভিন্ন মেলায় তালপাতারপাখা বিক্রি হত। গলির রাস্তায় পাখা ফেরি করেও যেত। তখন কয়লার উনুনই ছিল ভরসা। আর বর্ষাকালে ভিজে কয়লার উনুন যখন ধরতে চাইত না, তখন পাখা দিয়ে উনুনের নীচের চারকোণা খোলা অংশে জোরে হাওয়া করে উনুন ধরাতে মেয়েরা হিমশিম খেয়ে যেত অফিসের ভাত তৈরি করতে। সেই পাখাটা অবশ্য দৃষ্টিনন্দন ছিল না। অনেকসময় দাঁত, নখ বের করে গিন্নির দিকে চেয়ে থাকত বিপন্ন পাখা। অথচ এককালে তার স্থান ছিল বাড়ির বেডরুমে বালিশের পাশে। এখন তার স্থান ইতিহাসের পাতায়। কিংবা কোনও লেখকের কলমের চলমানতায়। তালপাতার পাখার হাওয়ার শীতলতা অনুভব করতে করতে একটু চোখ ফেরানো যাক পুরনো সেই দিনে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সুলতানদের দরবারের শোভা পেত নানা কিসিমের চামর। মুসলিম পরম্পরায় মুশকিল আসানের জন্য হাতে চামর দোলানোর স্মৃতি আজও আছে। হিন্দু পুজো অর্চনার রীতিতেও চামর বা তালপাতার পাখার বাতাস দিয়ে সন্তুষ্ট করা হত আরাধ্য দেবতাকে। ঐতিহাসিক এইচ ই বাস্টিডের লেখা একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, পর্তুগীজদের হাত ধরে ১৭৮৪ থেকে ১৭৯৮ সালের মধ্যে কলকাতায় টানা পাখার আবির্ভাব ঘটে। ১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি গির্জায় টানা পাখার ব্যবস্থা করেন। কাছারিতে আর্দালি নামক পোস্টে এদেশের অনেকেই চাকরি করতেন শুধুমাত্র বাতাস করার জন্য। 

কলকাতায় প্রথম বিজলি বাতি জ্বলে! তারপরে মাথার উপর ঘোরে বৈদ্যুতিক পাখা। এরপর এয়ার কুলার, এয়ার কন্ডিশনার, নানা যন্ত্রের আবির্ভাবে হাতপাখা প্রায় লুপ্ত সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে। তবে কোনও কোনও গৃহস্থ পরিবারে অন্তত একটি করে হলেও, শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতার মতো একটা তালপাখা হাতছাড়া করতে চান কেউ কেউ। সংখ্যার বিচারে এ ধরনের পরিবার নেহাতই হাতেগোনা হলেও পুরনো গৃহস্থবাড়ির অন্দরে এক আধটা হাতপাখার কি সন্ধান পাওয়া যাবে না? হাতপাখা মিউজিয়ামে যাওয়ার আগে এ কি দুর্লভ সুযোগ না?

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তালপাতার পাখা চলতে পারছে না। একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা খেতে বসেছেন। কাঁসার থালায় ভাত, সঙ্গে নানা ব্যঞ্জন। পরিবারের কেউ তাঁকে তালপাখার পাখা দিয়ে হাওয়া করছেন, এই দৃশ্য এখন বাস্তবে নেই বললেই চলে। কারণ একান্নবর্তী পরিবার নেই, গৃহকর্তার দাপট নেই, নেই তাঁকে হাওয়া করার রীতি। এসি আর কুলারের হাওয়ায় ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বঙ্গবাসী। ফলে তালপাতার হাতপাখা স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার আগে অন্তত বাংলার লোকসংস্কৃতির বাহক যেন ঠাঁই পায় জাদুঘরে। তাহলে অন্তত তালপাতার পাখার সঙ্গে পরিচয় ঘটবে আগামীর। এই আশায় বুক বাঁধতে পারে বঙ্গ-সংস্কৃতি।

More Articles