খেলা দেখতে এসে রানি মজলেন প্রেমে! বিশ্বের প্রাচীনতম সেই ক্লাব আছে কলকাতাতেই
Calcutta Polo Club: অনেকেই হয়তো জানেন না, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পোলো ক্লাব কলকাতায় অবস্থিত।
বনেদিয়ানার সঙ্গে আধুনিকতার এক অপূর্ব সুন্দর মেলবন্ধন ঘটেছে কল্লোলিনী তিলোত্তমায়। এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে খেলা। ভারতীয় ফুটবলের মক্কা বলা হয় কলকাতাকে। কলকাতার দুই ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের দ্বৈরথ সর্বজনবিদিত। সমগ্র এশিয়াতে জনপ্রিয় এই লড়াই। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুটবল স্টেডিয়াম সল্টলেকের বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। আমাদের কলকাতাতেই অবস্থিত ইডেন গার্ডেনস। ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যশালী স্টেডিয়াম এটি। তৃতীয় বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়ামও বটে। কলকাতায় এহেন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা জানেন না। সব মিলিয়ে বলা যায়, কলকাতা শহরে ক্রিকেট এবং ফুটবলের একটি ‘কালচার’ আছে। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরেকটি খেলা। খেলাটি হলো পোলো।
অনেকেই হয়তো জানেন না, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পোলো ক্লাব কলকাতায় অবস্থিত, ক্যালকাটা পোলো ক্লাব। এই খেলাটির উদ্ভাবন করা হয়েছিল সমাজের সম্ভ্রান্ত এবং উচ্চবর্গের মানুষের জন্য। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে খুব জনপ্রিয় এই খেলাটি। রাজা চার্লস, প্রিন্স ফিলিপ, প্রিন্স হ্যারি, প্রিন্স উইলিয়াম- এঁরা প্রত্যেকেই এই খেলাটি প্রফেশনাল স্তরে খেলেছেন। শোনা যায়, রাজা পঞ্চম জর্জের সোনার তৈরি পোলো স্টিক ছিল। তবে ইংরেজদের মধ্যে জনপ্রিয় এই খেলাটির জন্ম আসলে হয়েছিল পূর্ব ভারতের মণিপুরে। শোনা যায়, ১২১০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক এই পোলো খেলতে গিয়েই ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। পরবর্তীকালে আকবরের সময় পোলো খেলার বিস্তৃতি ঘটে ভারতে। সম্রাট আকবর পোলো খেলার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম তৈরি করেন এবং সেগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়। এভাবেই জন্ম হয় আধুনিক পোলো খেলার। মণিপুরের রাজপরিবারে পোলো বা ‘পুলু’ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এলে তারা এই খেলাটি দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং নিজেদের দেশেও এই খেলার বিস্তার ঘটায়। খেলোয়াড়রা অত্যন্ত দামি লিনেনের জামাকাপড় পরে, দামি ঘোড়ায় চেপে এই খেলাটি খেলতেন বলে ক্রমে এই খেলাটি সম্ভ্রান্তদের খেলা বলে পরিচিত হতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: তিলোত্তমা কলকাতাকে নাকি বলা হত ‘ব্ল্যাক টাউন’! নেপথ্যে কোন কারণ
ব্রিটিশরা ভারতীয়দের থেকে পোলো খেলা শিখে গিয়েছিল। সেই সময় ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। স্বাভাবিকভাবেই রাজধানীতে একটি পোলো ক্লাব তৈরি করার কথা চিন্তা করতে থাকে ব্রিটিশরা। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশরা বিশ্বের প্রথম পোলো ক্লাব নির্মাণ করেন কলকাতায়। দুই ব্রিটিশ মেজর, ক্যাপ্টেন রবার্ট স্টুয়ার্ট এবং জো শেরার উদ্যোগ নেন কলকাতার বুকেই একটি পোলো ক্লাব তৈরির। যেখানে শুধু পোলো খেলাই নয়, থাকবে এই খেলা অনুশীলন করার মতো পর্যাপ্ত পরিকাঠামোও। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কলকাতার রেস কোর্সের বুকেই গড়ে উঠল আস্ত একটি ক্লাব, ক্যালকাটা পোলো ক্লাব। তৎকালীন সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলিতে এই খেলাটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে ভারতে এই খেলা কেবলমাত্র নবাব বা রাজপরিবারের মানুষদের কাছেই সমাদৃত ছিল।
পোলোর জন্ম হলো পূর্ব ভারতে, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন পোলো ক্লাব কলকাতায় তৈরি হলো, কিন্তু তা সত্ত্বেও খেলাটি সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হতে ব্যর্থ হলো। গতবারের অলিম্পিকসে প্রথমবারের জন্য অংশ নিয়েছিলেন কোনও ভারতীয় পোলো খেলোয়াড়, ফাওয়াদ মির্জা। ক'জন রেখেছে সেই খবর? বাঙালির কাছে আজও ঘোড়া বলতে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজি আর রেসকোর্সের ঘোড়দৌড়। তবে এই পোলোর কারণে কিন্তু এক বাঙালি রাজকন্যা পেয়েছিলেন তাঁর ড্রিম ম্যান-কে। ১৯৩১ সালে কলকাতায় পোলো খেলতে এসেছিলেন একুশ বছরের এক তরুণ। তাঁর প্রেমে পড়লেন বছর বারোর এক কিশোরী। এই তরুণটি হলেন জয়পুরের মহারাজা সওয়াই মান সিংহ এবং কিশোরীটি হলেন তৎকালীন কোচবিহারের রাজকুমারী এবং পরবর্তীকালে জয়পুরের মহারানি, গায়ত্রী দেবী। দু'জনেই দারুন পোলো খেলতেন। ছয় বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর অবশেষে ১৯৩৭ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন তাঁরা। সাতের দশকে দেশে এমার্জেন্সির সময় এই গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সংঘাত হেডলাইন কেড়েছিল সকল সংবাদপত্রের। গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছেন এই অভিযোগে মহারানি গায়ত্রী দেবীর প্যালেস খুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। যাক সেকথা, ফিরে আসা যাক পোলোয়।
কলকাতায় ১৮৬২ সালে চালু হলো প্রথম পোলো ক্লাব। কিন্তু জানেন কি, বিশ্বের প্রথম পোলো টুর্নামেন্টও কিন্তু চালু হয়েছিল এই শহরেই। সেই সময় কলকাতায় ব্যবসা করতে এসেছিলেন স্যর জোসেফ এজরা। এঁর নামেই বড়বাজার মার্কেটের কাছে রয়েছে ‘এজরা স্ট্রিট’। উনিশ শতকের সাতের দশকে কলকাতায় পোলোর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন এই ইহুদি বণিক। ব্যবসার পাশাপাশি পোলোর নেশায় চেপে ধরে তাঁকে। ১৮৮০ সালে স্যার জোসেফ এজরা ঠিক করেন, একটি পোলো টুর্নামেন্ট করাবেন। আয়োজিত হয় বিশ্বের প্রথম পোলো টুর্নামেন্ট এজরা কাপ। সেই সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরাও নিজেদের দল নিয়ে এই টুর্নামেন্ট খেলতে আসতেন কলকাতায়। কয়েকটি বাঙালি দলও খেলত এই টুর্নামেন্টটি। বলাই বাহুল্য, দলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন কয়েকজন এক উচ্চবিত্ত বাঙালি। তবে এজরা কাপ ছাড়াও বিশ্বের আরও ১০টি ঐতিহাসিক পোলো ট্রফি যেমন- কারমাইকেল কাপ (১৯১০) এবং স্টুয়ার্ট কাপ (১৯৩২)- এগুলিরও জন্ম কলকাতাতেই। ১৯০৭ সালে অল ইন্ডিয়া পোলো অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে সারা ভারতব্যাপী পোলো টুর্নামেন্ট প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয়। সেই টুর্নামেন্টটি খেলা হয় ক্যালকাটা পোলো ক্লাবে।
বর্তমানে স্যর জোসেফ এজরাও নেই, নেই সমাজের উচ্চবিত্তদের পোলোর প্রতি তেমন আকাঙ্ক্ষা বা উদ্যোগও। তবে সময়ের সঙ্গে কি কালের অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছে ক্যালকাটা পোলো ক্লাব? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’-ও, আবার ‘না’-ও। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে চৌরঙ্গী রোডের ওপর এখনও টিমটিমে বাতি জ্বালিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ১৬০ বছর পুরনো ক্যালকাটা পোলো ক্লাব। তবে সেই জৌলুস বা উন্মাদনা এখন আর নেই। হারিয়ে না গেলেও হারিয়ে যেতে বসেছে পোলোর প্রতি বাঙালির উৎসাহ। গুটিকয়েক মানুষ আজও প্রশিক্ষণ নিতে যান পোলোর। তবে বিনিয়োগ এবং পরিকাঠামোর অভাবে একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে ক্যালকাটা পোলো ক্লাব। বাঙালি ক্রিকেট-ফুটবলকে হৃদয়ের অন্তপুরে বসিয়ে রাখলেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পোলোর থেকে। এটাই বাস্তব।