পাহাড় কেটে হোমস্টে নির্মাণ! কেন হলো উত্তরাখণ্ডের এই ভয়াবহ দুর্যোগ?

Disaster: দশ কিলোমিটারের মধ্যে যে কোনো অঞ্চলে, যেকোনো সময়েই  স্বল্পস্থায়ী এই বৃষ্টি আসতে পারে, সেক্ষেত্রে ঠিক কোথায় আসবে তা বলা মুশকিল।

উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার একটি গ্রাম ধারালি। পাহাড়ি সৌন্দর্যে ভরপুর গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীরগঙ্গা নদী। এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হোমস্টে। পর্যটকদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা। ৫ অগাস্ট দুপুরে এই নদীতে হড়পা বানের ফলে গাড়ি, বাড়ি-সহ মানুষের ভেসে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছে গোটা বিশ্ব। সরকারি হিসাবে, ৫ জন মারা গেলেও পাহাড়ের আনাচে-কানাচে কত মানুষ যে এখনও চাপা পড়ে আছে তা বলা মুশকিল! এমনকি উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ১১ জন সেনারও খোঁজ মিলছে না। হঠাৎ করে কেন সৃষ্টি হলো এমন ভয়াবহ হড়পা বান?

সাধারণত প্রচন্ড মেঘভাঙা বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি অঞ্চলের সরু এবং খাড়া নদীতে এই বান দেখতে পাওয়া যায়। বৃষ্টিপাতের ৬ ঘণ্টার মধ্যেই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে হড়পা বানের দেখা মেলে। মেঘভাঙা বৃষ্টিপাত আসলে কি? আবহাওয়া দফতরের হিসাব অনুযায়ী, কোনও ছোট অঞ্চলে (সর্বাধিক দশ কিলোমিটারের মধ্যে) এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলেই তাকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলে। আবহাওয়াবিদদের পরিভাষায় এটি 'ক্লাউডবার্স্ট' নামে অধিক পরিচিত। স্বল্প সময় স্থায়ী হলেও এর তীব্রতা এবং প্রভাব স্বাভাবিক অবস্থায় ভারী বা অতিভারী বৃষ্টির চাইতে অনেক বেশি, সেজন্য  ক্ষয়ক্ষতি ও অনেক বেশি হয়।

কেন সৃষ্টি হয় এই মেঘ ভাঙা বৃষ্টি?

একটা ছোট্ট এলাকায় মেঘ হঠাৎ ঘনীভূত হওয়ার কারণে মেঘভাঙা বৃষ্টি দেখা দেয়। মূলত ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে উষ্ণ বায়ু এলে ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়। আবার উত্তপ্ত বাতাস ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে থাকায় মেঘে পুঞ্জিভূত জলকণা বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারে না। উপরন্ত সেই জলকণাকে শুষে উত্তপ্ত বাতাস আরও উপরে উঠতে থাকে। পার্বত্য এলাকার নিম্ন অংশ থেকে উচ্চ ভূখণ্ডের দিকে গরম বাতাসের উঠতে থাকার ঘটনাকে বলে ‘অরোগ্রাফিক লিফ্ট’। ফলে উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলের আপেক্ষিক আর্দ্রতাও ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মেঘের জন্ম হয়। ক্রমশ বাড়তে থাকে সেই মেঘের ঘনত্ব, একসময় বাড়তে বাড়তে ঘনীভবন সীমাস্থ মানে পৌছায়, তখন মেঘ  আর জলরাশি ধরে রাখতে পারে না– পাহাড়ের কোলে তীব্র গতিতে বারিধারা নামতে থাকে, এমনকি মাঝে মধ্যে শিলা বৃষ্টিও দেখতে পাওয়া যায়। এসময় ভারী থেকে অতি ভারীবৃষ্টিও দেখতে পাওয়া যায়। প্রবল জলের স্রোতের সঙ্গে নেমে আসে ছোট-বড় পাথর, নুড়ি, কাদা, ইত্যাদি। সেই স্রোতের সামনে খড় কুটোর মতো ভেসে যায় সবকিছু। এই কারণেই মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি পাহাড়ি অঞ্চলে একরকম অভিশাপ। আবহাওয়াবিদরা যদিও এটাকে  ক্লাউডবার্স্ট বলেন, কিন্ত এটি কোনো বিস্ফোরণের থেকে কম নয়।

আরও পড়ুন-  ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাজন, চার দশকে যেভাবে কুঠার চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টিঅরণ্যে

সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩,৩০০ থেকে ৮,২০০ ফুট উচ্চতায় এই বৃষ্টি দেখতে পাওয়া যায়। কিউমুলোনিম্বাস মেঘের দরুণ এর সৃষ্টি। এত বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা একভাবে পড়তে থাকে যে সেগুলিকে আর আলাদা করা যায় না। মনে হয় যেন অবিরত প্রবাহমান বারিধারা।

আমাদের দেশের হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে এই মেঘ ভাঙা বৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি। বিশেষত উত্তরাখণ্ডে সম্ভাবনা আরও বেশি। আবহাওয়া দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতে, মৌসুম ও প্রাক-মৌসুমে এই বৃষ্টির প্রকোপ দেখতে পাওয়া যায়। মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এর জন্য দায়ী। কেবলমাত্র পার্বত্য অঞ্চলেই নয়, সমভূমিতেও এই বৃষ্টির দেখা মিলতে পারে। কিন্তু সমতলে ভূমি ধসের সম্ভাবনা কম বলে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে। যদিও পাহাড়ি এলাকায় মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়, কারণ সেখানে ‘অরোগ্রাফিক লিফটের’ অনুকূল  পরিবেশ রয়েছে।

এছাড়া প্রকৃতিগত দিক থেকে পাহাড় বায়ুপ্রবাহের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে, বাতাস একরকম বাধ্য হয়েই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠে সম্প্রসারিত হয় এবং ক্রমশ উষ্ণতা হারায়। এক সময় আর্দ্রতা ধরে রাখতে না পেরে  ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয়।

বর্তমান প্রযুক্তির যুগে  এই মেঘভাঙা বৃষ্টির আগাম সংকেত কি  কোনো ভাবে দেওয়া সম্ভব?

দশ কিলোমিটারের মধ্যে যে কোনো অঞ্চলে, যেকোনো সময়েই  স্বল্পস্থায়ী এই বৃষ্টি আসতে পারে, সেক্ষেত্রে ঠিক কোথায় আসবে তা বলা মুশকিল। সেজন্য মৌসম ভবনকে নির্ভর করতে অত্যাধুনিক রাডারের উপরে। এসব ব্যাপারে ডপলার রাডার খুবই কার্যকরী। কিন্ত ভারতের আবহাওয়া দফতরের কাছে পর্যাপ্ত সংখ্যক এই রাডার নেই, ফলে ‘রিয়াল টাইম ডেটা’ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। উত্তরাখণ্ডে বর্তমানে তিনটি ডপলার ওয়েদার রাডার (মুক্তেশ্বরে , সুরকন্দা দেবীতে , এবং ল্যান্সডাউনে) রয়েছে। ধারালির কাছাকাছি ডপলার রাডারটি রয়েছে ল্যান্সডাউনে, যেটি প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দুঃখের বিষয় তার রেঞ্জ আবার ১০০ কিলমিটার!

আরও পড়ুন- অনন্ত বিরহের বর্ষায় বৃষ্টি লুকোয় যে ‘রেইনকোট’

প্রশ্ন ওঠে, ক্ষীরগঙ্গা নদীতে যে হড়পা বানের দেখা মিলেছে  তার নেপথ্যে কি মেঘ ভাঙা বৃষ্টি? প্রাথমিক ভাবে সেটা মনে করা হলেও, আবহাওয়াবিদদের একাংশ তার সঙ্গে একমত নয়। উত্তর কাশি জেলায় গত ক'দিনের বৃষ্টির তথ্য অন্তত সে কথা বলে না। একথা ঠিক যে ক্ষীরগঙ্গার  উচ্চ অববাহিকাতে  বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্ত তা মেঘভাঙা বৃষ্টির জন্যে পর্যাপ্ত নয়। তাঁরা দাবি করেছেন, পাহাড় কেটে বড় বড় রাস্তা, হোটেল, হোমস্টে নির্মাণের সময় প্রচুর গাছ পালা কেটে ফেলা হয়েছে, বিপুল পরিমানে মাটি কাটা হয়েছে, এর ফলে উত্তরাখণ্ডের ভুমিস্তরের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। তাই এই বিপত্তি। আর শুধু উত্তর কাশিই নয় রুদ্র প্রয়াগ, দেব প্রয়াগ, লাংসি, ধারাসু এসব জেলাতে যেকোনো সময় বিপর্যয় ঘটতে পারে। ধারালির বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ জানতে গেলে উত্তরাখণ্ডের ভূ-প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের ৬৫৬ ফুট থেকে ২৫,৬৪৩ ফুট উচ্চতা জুড়ে বিস্তৃত উত্তরাখণ্ড। এটি হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত। এই ঢালের মাটিতে অভ্র, ও অন্যান্য খনিজের পরিমান বেশী। বিভিন্ন কারনে যখনই মাটি কাটা হয়েছে, সেই সব খনিজের স্তর উন্মুক্ত হয়ে গেছে, যা ভেসে গেছে প্রবল বর্ষণে। ২ অগাস্ট থেকে প্রবল বৃষ্টি, আর সেই সঙ্গে বদলে যাওয়া ভূমি রুপের কারণেই ধারালিতে এই ভয়াবহ দুর্যোগ হয়েছে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

More Articles