গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় খুলি! বেঁচে উঠে পৃথিবীকে সম্পূর্ণ উলটো দেখতে পেতেন এই ব্যক্তি!

Bullet Injury: ওই আহত সেনা দেখেন একটি বাড়ির উপর বাঁশ বেঁধে শ্রমিকরা কাজ করছেন, কিন্তু সকলেই উলটো হয়ে ঝুলে!

মারাত্মকভাবে আহত মানুষদের মস্তিষ্কের কাছে প্রবল ঋণী স্নায়ুবিজ্ঞান। এই মানুষদের চূর্ণ বিচূর্ণ কর্টিস, ক্ষতিগ্রস্ত শিরা চিকিৎসকদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে বারেবারে যেখান থেকে জটিল সমস্ত বিষয় বেরিয়ে এসেছে। মানুষের মস্তিষ্ককে আরও বিশদে, আরও গভীরে বুঝতে পেরেছেন স্নায়ুবিশেষজ্ঞরা। পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে যা করা সম্ভব হয়নি তাই করে দেখিয়েছে মানুষের আহত মস্তিষ্ক। এরকম একটি ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল চিকিৎসকদের। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এক সেনা। তারপর থেকে সারা পৃথিবীকে উলটো দেখতে শুরু করেন সেই সেনা!

এই ঘটনার আগে পর্যন্ত, নিউরোলজিস্টরা বিশ্বাস করতেন যে, মস্তিষ্ক নানা স্বতন্ত্র অঞ্চলের সমন্বয়ে গঠিত। এই স্বতন্ত্র অঞ্চলগুলি বিবিধ সীমানা দ্বারা বিভক্ত। কোনও অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চল হয় ভীষণই সামান্য মিশে রিয়েছে বা একেবারেই মিশে নেই। তবে আহত ওই সৈনিকের মস্তিষ্ক এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় চিকিৎসকদের। ওই রোগীর জট পাকিয়ে যাওয়ার স্নায়ুর বিষয়টিকে বুঝতে গিয়েই চিকিৎসক জাস্টো গঞ্জালো রদ্রিগেজ-লিল মস্তিষ্কের গতিবিদ্যার একটি নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেন।

আরও পড়ুন- ১৫০ বছর আগে পাঁচ সঙ্গীকে খুন করে মাংস ভক্ষণ! এই ব্যক্তির কাহিনি নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে

স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ চলেছিল ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। নৃশংস এই যুদ্ধে রিপাবলিকানদের হারিয়ে জয় হয় জাতীয়তাবাদী দলের। ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর অধীনে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সময়। রিপাবলিকানদের পক্ষে তখন লড়াই করেছিলেন এই সৈন্য। বয়স মাত্র ২৫। ১৯৩৮ সালের মে মাসে ভ্যালেন্সিয়ার লেভান্তেতে এক যুদ্ধক্ষেত্রে ওই সৈন্যকে মাথায় গুলি করা হয়।

কোমাতে চলে যান গুরুতর আহত ওই সেনা। দুই সপ্তাহ পরে কোমা থেকে জেগে ওঠেন তিনি। কিন্তু পৃথিবীটা পালটে যায় নিমেষে। আহত সৈনিক জানান তাঁর বাম চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। ডানদিকের চোখে আবছা, অস্পষ্ট দেখছেন সব। ওই সেনার মাথার খুলিতে দু'টি ছিদ্র করেছিল বুলেটটি, প্রবেশের সময় এবং বেরিয়ে যাওয়ার সময়। অস্ত্রোপচার বা কোনও ধরনের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন ছাড়াই সেরে উঠছিলেন ওই রোগী।

এর পরের পাঁচ দশক ধরে রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন চিকিৎসক রদ্রিগেজ-লিল। বেশ কয়েকটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর লক্ষণ চোখে পড়ে তাঁর। মাথায় গুলি লাগার পর থেকে সবকিছুকে তিনগুণ বড় করে দেখতে পেতেন ওই সেনা। পাশাপাশি, নানা বস্তু থেকে অদ্ভুত রঙও দেখতে পেতেন তিনি।

সব থেকে অস্বাভাবিক ছিল আরেকটি বিষয়। রোগী সবকিছুই দেখতে পেতেন উলটো! তাঁর বই, সেরিব্রাল ডাইনামিক্সে রদ্রিগেজ-লিল লিখেছিলেন, কীভাবে যুদ্ধের আঘাতের পর দৃশ্যমান সবকিছুকে অস্বাভাবিক অদ্ভুতভাবে দেখতে শুরু করেন তিনি। একদিন হঠাৎ ওই আহত সেনা দেখেন একটি বাড়ির উপর বাঁশ বেঁধে শ্রমিকরা কাজ করছেন, কিন্তু সকলেই উলটো হয়ে ঝুলে! পরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ঠিকই অবস্থানে রয়েছেন, ওই সেনাই দেখছেন উলটো।

আরও পড়ুন- প্রথমবার বাবা হওয়ার পর আয়তনে হ্রাস পাচ্ছে মস্তিষ্ক! নতুন গবেষণায় চাঞ্চল্য বিজ্ঞানমহলে

এই যে সমস্ত কিছু উল্টে যাওয়া, এটি রোগীর শব্দ এবং স্পর্শের অনুভূতিকেও প্রভাবিত করে। দু'টিই তাঁর মস্তিষ্ক এমনভাবে ঘটাত যেন তার শরীরের বিপরীত দিক থেকে তৈরি হচ্ছে সবটা। এই গুরুতর অস্থিরতা সত্ত্বেও, কষ্ট করে জীবনযাপন করতে পেরেছিলেন তিনি। রদ্রিগেজ-লিল বলতেন অচেতনে ধীরে ধীরে তাঁর মস্তিষ্ক এই উলটো বিষয়টির প্রেক্ষিতেই শরীরকে চালিত করত।

সেরিব্রাল ডায়নামিক্সে চিকিত্সক ব্যাখ্যা করেছেন, বুলেটটি রোগীর মস্তিষ্কের বাম প্যারিটো-অসিপিটাল অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করা হয়েছে। এই আঘাতের পরিণতি পর্যবেক্ষণ করেই, রদ্রিগেজ-লিল ধারণা করেছিলেন যে মস্তিষ্ককে আলাদা আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত করা যাবে না। ক্ষতটি যেভাবে রোগীর সংবেদনগুলিকে তালগোল পাকিয়ে দিয়েছিল তার উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, স্নায়বিক কার্যকারিতা আসলে সমগ্র কর্টেক্স জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

ওই আহত রোগীর পরিচয় কখনই প্রকাশ করা হয়নি। তবে দীর্ঘ এবং সুস্থ জীবন যাপন করেছিলেন তিনি। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে মারা যান তিনি। ওই আঘাতের পর আরও ৬০ বছর বেঁচেছিলেন রোগী, তবে প্রতিনিয়তই এই অদ্ভুত অবস্থার কারণে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তবে তাঁর এই বুলেটের আঘাত, রোগীর পিছনের দিকের মস্তিষ্ক স্নায়ুবিজ্ঞানের বাঁক বদল করেছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

More Articles