প্রথমবার বাবা হওয়ার পর আয়তনে হ্রাস পাচ্ছে মস্তিষ্ক! নতুন গবেষণায় চাঞ্চল্য বিজ্ঞানমহলে

Brain Plasticity: আপাত দৃষ্টিতে কর্টেক্সের আয়তনে হ্রাস পাওয়ার ঘটনা ক্ষতিকর শুনতে মনে হলেও, এই ঘটনা আদতে সন্তান ও অভিভাবকের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং তার প্রতি স্নেহের টান স্থাপন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

মা বা বাবা হওয়া জীবন বদলে দেওয়ার মতো একটি ঘটনা। সেখানে শুধু সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে ক্ষান্ত হলেই চলে না, সন্তানের সঙ্গে সুন্দর ও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলাও অপরিহার্য। সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে মহিলাদের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তনগুলো ঘটে, তার মধ্যে মস্তিষ্কের গঠনের পরিবর্তন একটি অন্যতম বিষয়। সন্তান জন্মের পরে মহিলাদের মস্তিষ্কে কী পরিবর্তন আসে, এ যাবৎ তা খুঁটিয়ে গবেষণা করেছেন গবেষকরা। কারণ, যেহেতু মা সন্তান ধারণ করেন প্রায় নয় মাস সময় ধরে, তার শরীরে পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক।

‘আর্কাইভস অব ওমেনস মেন্টাল হেলথ’ জার্নালে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি রিভিউ আর্টিকেল থেকে জানা যাচ্ছে, মহিলাদের ক্ষেত্রে মা হওয়ার ব্রেন প্লাস্টিসিটির ঘটনা ঘটে। যা সন্তানদের যত্ন এবং লালন-পালনের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, মা হওয়ার পর মহিলাদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের যে পরিবর্তন চোখে পড়ে, তার পেছনেও দায়ী ব্রেন প্লাস্টিসিটি। এমনকী পুরনো বেশ কিছু গবেষণা জানান দিচ্ছে, বাবা হওয়ার পর পুরুষদের মস্তিষ্কেও পরিবর্তন আসে।

পুরুষদের ক্ষেত্রে সেইরকম পরিবর্তনের অন্যতম হল নিউরোপ্লাস্টিসিটি। প্লাস্টিক যেমন বাহ্যিক শক্তির প্রভাবে যখন খুশি নিজেদের আকার, আয়তন পরিবর্তন করতে পারে- যেমন তাকে টানলে বেড়ে যায় বা তাপে কুঁচকে যায়, সেই রকম আমাদের নার্ভকোশ বা নিউরোনও বাহ্যিক বা শরীরের আভ্যন্তরীণ পরিবেশের প্রভাবে নিজেদের গঠন ও কাজে পরিবর্তন আনতে পারে। নিউরোনাল নেটওয়ার্ক, অর্থাৎ নার্ভকোশগুলির মধ্যে সংযোগের ফলে আন্তর্জাল গড়ে ওঠে, সেখানেও অদল-বদল ঘটতে পারে নিউরোপ্লাস্টিসিটির প্রভাবে। কিন্তু তারপরেও বাবা হওয়ার পরে মস্তিষ্কে আর কী কী পরিবর্তন হয়, সেই গবেষণা যথেষ্টভাবে হয়নি।

আরও পড়ুন- যত্রতত্র কিউআর কোড স্ক্যান করছেন, কী ভয়াবহ বিপদ লুকিয়ে রয়েছে জানেন?

সন্তানধারণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও যে বাবা হওয়ার পরে পুরুষদের মস্তিষ্কের বিপুল বদল আসে, তা নিয়ে গবেষকদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বিস্মিত করেছে। কিন্তু এ যাবৎ কেউ হয়তো ভাবেনি প্রথমবার বাবা হওয়ার পরে মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আয়তনে হ্রাস পাবে। আর সেই অংশ হল মস্তিষ্কের কর্টেক্সের ধূসর বস্তু।

মাদ্রিদ এবং দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার দু’টি গবেষণাগারে এই নতুন এই গবেষণাটি করে দেখা গেছে, প্রথমবার বাবা হওয়ার পর পুরুষদের মস্তিষ্কের কর্টেক্সের কিছু পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। সেই গবেষণা চলতি মাসের শুরুর দিকে ‘অক্সফোর্ড অ্যাকাডেমি’-র ‘সেরিব্রাল কর্টেক্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথমে বলা যাক মস্তিষ্কের ঠিক কোন অঞ্চলে কর্টেক্স থাকে। আমাদের মস্তিষ্কের সব থেকে বড় অংশটি হল সেরিব্রাম, মাথার সামনে থেকে শুরু করে মাঝের অংশ ছাপিয়ে মাথার সামান্য পেছন দিক অবধি বিস্তৃত থাকে এই অংশ। সেরিব্রামকে আবৃত করে যে অংশটি থাকে, তাকে বলে সেরিব্রাল কর্টেক্স। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ম্যাগডালেনা মার্টিনেজ়-গার্শিয়া ইন্সক্রিপ্টকে একটি জু়ম কলে জানিয়েছেন, “কর্টেক্সের কাজকে আমরা বিভিন্নভাবে ভাগ করতে পারি, যা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। সন্তানলাভের পরে সন্তানের প্রতি সজাগ থাকতে, তাদের বিপদ থেকে বাঁচাতে মস্তিষ্কের কর্টেক্স অংশটি সাহায্য করে”।

এই গবেষণার উদ্দ্যেশ্য ছিল, বাবা হওয়ার পরে পুরুষদের কর্টেক্সের আয়তন, পুরুত্ব, ও বিস্তারের পাশাপাশি সাব-কর্টিক্সেরও আয়তনের পরিবর্তন হচ্ছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সদ্য বাবাদের ক্ষেত্রে কর্টেক্সের আয়তন এক থেকে দুই শতাংশ হ্রাস পায়। আয়তনের হ্রাস সেই অংশেই ঘটেছে, যাকে বলা হয় ‘ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক’। এই অংশটি অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে গ্রহণ করার ক্ষমতা বাড়ায়। পাশাপাশি সন্তানের প্রতি অভিভাবকের স্নেহের উদ্রেক ঘটানোর জন্যে দায়ী। ম্যাগডালেনা আমাদের জানান, “কর্টেক্স আমাদের এমন কিছু ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, যাদের আমরা ‘হায়ার অর্ডার বিহেভিয়ার’ বলে থাকি। যার মধ্যে অন্যতম সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হওয়া, তাদের প্রতি ভালোবাসা এবং সহমর্মিতা দেখানো”।


আরও পড়ুন-“জি-স্পটটা কোন দিকে?” সঙ্গিনীকে যৌনসুখ দিতে যা খুঁজছেন, তা কি আদৌ আছে?

এর পাশাপাশি কর্টেক্সের যে অংশে আয়তন কমেছে, তা হল ‘ভিজ্যু়য়াল সিস্টেম’। এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন কুড়ি জন পুরুষ, যারা বাবা হতে চলেছেন। বাবা হওয়ার আগে ও পরে তাদের মস্তিষ্কের ছবি (নিউরোইমেজিং) নেওয়া হয়। পাশাপাশি সতেরো জন সন্তানহীন পুরুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে, তাদের মস্তিষ্কের গঠন তুলনা করে দেখা হয় নিউরোইমেজিংয়ের সাহায্যে। নিউরোইমেজিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ম্যাগনেটিক রেজো়নেন্স ইমেজিং বা এমআরআই।

তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথমবার যারা বাবা হয়েছেন, তাদের লিম্বিক সাব-কর্টিক্যাল নেটওয়ার্কে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। পরিবর্তন হয়নি সাব-কর্টেক্সের আয়তনেও। সাব-কর্টেক্স আমাদের ‘মোটিভেশন ও রিওয়ার্ড’ নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। “সন্তানের থেকে রিওয়ার্ড পেতে সাহায্য করে সাব-কর্টিক্যাল অঞ্চল”, ইন্সক্রিপ্টকে জানান ম্যাগডালেনা।

গবেষকরা আরও জানাচ্ছেন, কর্টেক্সের ধূসর বস্তু বা গ্রে ম্যাটারে যথেচ্ছভাবে ব্রেন প্লাস্টিসিটির ঘটনা ঘটেছে। আপাত দৃষ্টিতে কর্টেক্সের আয়তনে হ্রাস পাওয়ার ঘটনা ক্ষতিকর শুনতে মনে হলেও, এই ঘটনা আদতে সন্তান ও অভিভাবকের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং তার প্রতি স্নেহের টান স্থাপন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পুরনো গবেষণায় দেখা গেছে, মায়েদের ক্ষেত্রে কর্টেক্সের আয়তনের হ্রাস যত বেশি হয়, সন্তানের প্রতি টান পাল্লা দিয়ে বাড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই গবেষণা জানান দিচ্ছে, সদ্য বাবাদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনার ব্যত্যয় ঘটে না।

More Articles