পরেশ থেকে মানিক, যেভাবে একে একে রাঘববোয়ালকে জালে ফেলছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক মামলায় তোলপাড় ফেলে দেওয়া নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
২০ জুন মানিক ভট্টাচার্যকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এসএসসি মামলায় মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর শিক্ষকতার চাকরি কেড়ে নেওয়া এবং ৪১ মাসের বেতন ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০২১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় একের পর এক নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক মামলায় তোলপাড় ফেলে দেওয়া নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের ভরসার পীঠস্থান। বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় তিনি ঝড় তুলেছেন। এর জেরে খোদ রাজ্য সরকারের আসন টলমল। কারণ এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে তিনি পরের পর চাঞ্চল্যকর রায় দিতেই আসরে নামে খোদ ইডি। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হয় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে। তাঁর ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় টাকার পাহাড়। এরপর ঝুলি থেকে একের পর এক বেড়াল বেরোতে থাকে। অনুব্রতর দুর্নীতির প্রাসাদে ঢুঁ মেরে চোখ কপালে সিবিআই কর্তাদের। সেই প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, কীভাবে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ঝড় তুলেছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
জুন মাসে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে সরিয়ে দেন। এই নিয়ে বেশ কিছু অসংগতি তাঁর সামনে আসতেই তিনি পদক্ষেপ করেন। এদিকে রাজ্য বিভিন্ন দুর্নীতি ইস্যুতে জেরবার হতেই গৌতম পালকে মানিকের জায়গায় বসায়। মঙ্গলবার তাঁর জায়গায় নতুন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাচ্ছেন গৌতম পাল। তিনি এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যর দায়িত্বে রয়েছেন। এদিন রাজ্য শিক্ষা দফতর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, এক বছরের জন্য পর্ষদের নতুন সভাপতি হলেন গৌতম পাল। গত জুন মাসে কলকাতা হাই কোর্ট মানিক ভট্টাচার্যকে বরখাস্ত করে। সূত্রের খবর, এখন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদে নতুন অ্যাড হক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই অ্যাড হক কমিটিতে রয়েছেন শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি–সহ অন্যান্য শিক্ষাবিদরা। এতদিন পর্ষদের সভাপতি ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য। আদালতের নির্দেশে মানিক ভট্টাচার্য অপসারিত হতেই তাঁর জায়গায় কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। এবার প্রকাশ্যে এল গৌতম পালের নাম। আগে অন্তর্বর্তী সভাপতি হিসেবে কাজ করছিলেন রত্না চক্রবর্তী বাগচী।
আবারও একটা দুর্নীতি সাফ করে বিচারের বাণী প্রতিষ্ঠা করলেন সেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ই। কীভাবে?
আরও পড়ুন: বুনো ওল বনাম বাঘা তেঁতুল! অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়-অরুণাভ ঘোষ সংঘাতের আসল কারণ কী
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, লুকিয়ে করা দ্বিতীয় নিয়োগ তালিকার ২৬৫ জনের নিয়োগে একাধিক অসংগতি খুঁজে পান। আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত জানান, বেআইনি নিয়োগ করে আদালতে সমালোচনার মুখে পড়ে পর্ষদ। এর আগে প্রশ্ন ভুল মামলায় ভর্ৎসনার মুখে পড়ে বোর্ড।
আইনজীবী ফিরদৌস শামিম জানান, রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ আইন ১৯৭৩-এর ১৯ নং ধারায় বলা আছে, পর্ষদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ সভাপতি।
দ্বিতীয় নিয়োগ তালিকা নিয়ে পর্ষদের কাছ থেকে রিপোর্ট চায় কলকাতা হাই কোর্ট। আদালতে পেশ করা পর্ষদের রিপোর্টে জানানো হয়, ২৬৯ নয়, বাড়তি ১ নম্বর করে দেওয়া হয়েছিল ২৭৩ জনকে। এখানেই গরমিল চোখে পড়ে কোর্টের।
আদালতে পেশ করা রিপোর্টে আরও জানানো হয়, টেটের (২০১৪) প্রশ্নপত্রে ভুল রয়েছে, তাই নম্বর বাড়ানো হোক। এই মর্মে পর্ষদের কাছে মোট ২৭৮৭টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। এদের মধ্যে ২৭৩ জন প্রশিক্ষিত প্রার্থী ছিল, যাদের বাড়তি ১ নম্বর করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে কোনও বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দ্বিতীয় নিয়োগ তালিকা প্রস্তুত করে বোর্ড। ২৭৩ জনের নিয়োগ তালিকা প্রকাশ হয়। যেখান থেকে ২৬৫ জনের চাকরি হয়। এই ২৬৫ জনের চাকরি বাতিলও করেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। একাধিক বেআইনি কাজ পর্ষদের সভাপতি হিসেবে দায় এড়াতে পারেন না মানিক ভট্টাচার্য। তাই তাঁকে পদ থেকে সরায় হাই কোর্ট।
এরপর ডিভিশন বেঞ্চে যান মানিক ভট্টাচার্য। সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশে স্থগিতাদেশ চান তিনি। ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি শেষ হলেও, মানিক ভট্টাচার্য আবেদন মেনে অপসারণের সিদ্ধান্তে কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশের ২ মাস পর নতুন পর্ষদ সভাপতি ঘোষণা করল রাজ্য। ১১ বছর পর বদল হলো পর্ষদ সভাপতি। আবার ন্যায়বিচার দিলেন সেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি যেভাবে রাজ্যে ঝড় তুলেছেন, তাতে তাঁর রায় নিয়ে গড়িমসি করার সাহস দেখাতে পারেনি রাজ্য। একদিকে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়, অন্যদিকে ল্যাজেগোবরে পরিস্থিতি, সব মিলিয়ে জেরবার রাজ্য পর্ষদ সভাপতি বদল করল।
এসএসসি হোক অথবা ডিএ, এইসব মামলাকে কেন্দ্র করে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি একসময় স্কুল সার্ভিস কমিশনেরই আইনজীবী ছিলেন। অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে কলকাতা হাই কোর্টে তিনি যোগ দেন ২০১৮ সালের ২ মে। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ৩০ জুলাই হাই কোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসাবে কাজ শুরু করেন।
২০২১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় একের পর এক নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ই এখন এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের কাছে আশা-ভরসার পীঠস্থান। নেটমাধ্যমে প্রশংসাও কুড়োচ্ছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এ-যাবৎ সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য নির্দেশ হলো, এসএসসি মামলায় মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর শিক্ষকতার চাকরি কেড়ে নেওয়া এবং ৪১ মাসের বেতন ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ। এসএসসি-সংক্রান্ত মামলা কেবলমাত্র সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া নয়, এর পাশাপাশি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বকেও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন তিনি। দুর্নীতি মামলা ছাড়াও এই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ৭৬ বছরের বৃদ্ধা শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষকে ২৫ বছরের বকেয়া বেতন পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছেন। ক্যানসার-আক্রান্ত শিক্ষিকার ১২ দিনের বেতন কেটে নেওয়ায় প্রধান শিক্ষকের পদ কেড়ে নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ওই প্রক্রিয়া দ্রুত মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ধারে-ভারে কতটা প্রভাব ফেলেছেন সমাজে এই বিচারপতি! সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে এজলাসে অরুণাভ ঘোষের ডুয়েলের সাক্ষী থেকেছে রাজ্য। আইনজীবী অরুণাভ অভিজিৎকে 'আইন জানেন না' বলে কটাক্ষ করেন। তিনি কিন্তু এজলাসে বারবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাঁদের হয়ে বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে গেছে, তাঁদের কাছে কি মসিহা নন এই বিচারপতি?
এক মহিলা শিক্ষিকা যখন ১৩ মাস মাইনে পাচ্ছেন না, বিচারের আশায় ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়, তখন তাঁকে আশ্বাস জুগিয়েছেন এই বিচারপতিই, তাঁকে বলতে শোনা গেছে, "মনে রাখবেন, ভারতে একটা জুডিশিয়ারি আছে।"