চড়া হিন্দুত্ববাদ থেকে ভয়াবহ সন্ত্রাস! যে ভাবে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে দাপট বজায় রেখেছিলেন অর্জুন

Arjun Singh: অর্জুনকে ঘিরে কেবল বাহুবলি পরিচয়টাই যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি আর অর্জুন এতদিনে প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে।

সদ্য মিটেছে ব্যারাকপুর লোকসভা ভোট। এবার লোকসভা ভোটের হাই ভোল্টেজ কেন্দ্র ছিল ব্যারাকপুর। গোটা রাজ্যবাসীর নজর ছিল ব্যারাকপুরের দিকে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যারাকপুর লোকসভা ঘিরে সাধারণ মানুষের তেমন আলাদা কোনও আগ্রহ ছিল না। ২০১৯ লোকসভা ভোটের ঠিক আগেই আগেই ,তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক (ভাটপাড়ার) অর্জুন সিং তৃণমূলের হয়ে লোকসভার টিকিট না পেয়ে যোগ দিলেন বিজেপিতে। আর যোগ দিয়েই তিনি পেয়ে গেলেন ব্যারাকপুর কেন্দ্রে বিজেপির টিকিট। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল। তৃণমূলের প্রার্থীর থেকে খুব বেশি ভোটে জিতলেন না অর্জুন সিং। কিন্তু জিতলেন।

তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে যে ভাটপাড়া কেন্দ্র থেকে অর্জুন সিং প্রতিনিধিত্ব করতেন, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটেও এই ভাটপাড়া কেন্দ্রে তৎকালীন বিজেপি প্রার্থী কিন্তু লিড দিয়েছিলেন। এই বিষয়টি ঘিরে সংবাদমাধ্যমে বেশ হইচইও হয়েছিল। শোনা যায়, তৃণমূলের অন্দরেও এ নিয়ে চর্চা কম হয়নি। তারপর বিষয়টি থিতিয়ে যায়। কিন্তু অর্জুন-ঘনিষ্ঠদের থেকে শোনা গিয়েছিল, নোটবন্দির সময়কালে তৃণমূল কংগ্রেসের খাতায়-কলমে যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নাকি তার থেকে একদম ১৮০ ডিগ্রি আলাদা মতামত প্রকাশ করতেন অর্জুন সরাসরি। যাঁরা সেই সময় থেকে অর্জুনকে নিষ্ঠভাবে চিনতেন-জানতেন, তাঁদের অনেকেরই ধারণা ছিল, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরিমণ্ডলের সঙ্গে অর্জুনের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তথাকথিত মোদী হাওয়া এবং হিন্দুত্বের আবেগকে অনেকটাই কাজে লাগাতে পেরেছিলেন অর্জুন। তাছাড়া তৃণমূলের ভিতরে এবং বাইরে অর্জুনের যে বাহুবলি ইমেজ, যারা বামপন্থীদের পছন্দ করতেন না, তাঁদের কাছে সেটা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সেই কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯ সালে অর্জুনকে ব্যারাকপুর টিকিট না দেওয়ায়, সাধারণ ভোটারদের একটা বড় অংশ অর্জুনের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীলই ছিলেন। মানতেই হবে, সে সময় অর্জুনের নিজস্ব জনসম্পর্ক ছিল , যার ভিত্তিতে একটা বড় অংশের বামপন্থীদের সঙ্গে স্থানীয় স্তরে অর্জুনের সুসম্পর্ক ছিল। প্রাক্তন সংসদ তড়িৎ বরণ তোপদারের সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক ঘিরে নানা ধরনের কথাবার্তা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে তড়িৎবাবুর বাড়িতে অর্জুনের ঘনঘন যাতায়াত ঘিরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বামপন্থী শিবিরে নানা ধরনের সংশয়ের বাতাবরণও তৈরি হয় দীর্ঘদিন ধরে।

আরও পড়ুন: বাহুবলে ব্যারাকপুর দখল করতে পারবেন তৃণমূল-বিজেপি ডেইলি প্যাসেঞ্জার অর্জুন সিং?

শুধু কি তাই, অর্জুনের বাড়ি-লাগোয়া নৈহাটির নদিয়া জুটমিলে এক ট্রেড ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে (বর্তমানে প্রয়াত) অর্জুনের সম্পর্ক ঘিরে বামপন্থী মহলে নানা কথাবার্তা ছিল। সেই নেতা অসুস্থ হওয়ার পর অর্জুন যখন তাঁকে বাড়িতে দেখতে যান বা সেই নেতার সঙ্গে অর্জুনের নিত্যনৈমিত্তিক টেলিফোনিক সংযোগের কথা প্রকাশ্যে আসে ,তখন স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা ওই অঞ্চলে বামপন্থী রাজনীতি করেন ,নানাভাবে ২০১১ সালের পর থেকে যাঁরা তৃণমূলের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁদের একটা অংশের মধ্যেই বড় রকমের সংশয় পরিস্থিতি তৈরি হয়।

২০১৯ সালে অর্জুন বিজেপির প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়ার পর গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে এক ভয়াবহ তাণ্ডব চলেছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনী তখনও বাংলায়, রাজ্যের পুলিশের হাতে বিশেষ কোনও ক্ষমতাও নেই। সেই অবস্থায় অর্জুনের নিজস্ব বাহিনী বিজেপির মোড়কে ভয়াবহ অত্যাচার চালায় মূলত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের উপর। বহু তৃণমূল অফিস ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বাড়িও। তাঁদের উপর শারীরিক অত্যাচার চালানো হয়। এমনকী এই সময় বেশ কিছু তৃণমূলের নেতাকর্মী অর্জুনের নিজস্ব বাহিনীর হাতে নিহত হয় বলেও তৃণমূলের পক্ষের অভিযোগ।

কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকায় ওই সময়ে যেহেতু রাজ্য পুলিশের হাতে বিশেষ প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না, পাশাপাশি নির্বাচনী বিধি লাগু ছিল এলাকায়, সেই সুবিধা নিয়ে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসের রাজত্ব ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে কায়েম করেছিলেন অর্জুন ,তা মনে করলে আজও শিউরে ওঠেন ব্যারাকপুরের মানুষ। অর্জুন যে সে সময় কেবল তৃণমূলের উপরেই অত্যাচার করেছিলেন, তা নয়। একেবারে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় গরিব হিন্দিভাষী ,বাংলাভাষী মুসলমানদের উপরে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি অত্যাচারের স্টিম রোলার । তার বাড়ির লাগোয়া কাঁকিনাড়া অঞ্চলে সে সময়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছিল অর্জুন সিংয়ের প্রত্যক্ষ অঙ্গুলিহেলনে। গোটা ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র জুড়ে ধর্মীয় উস্কানি, ভাষাভিত্তিক উস্কানিকে এমন একটা জায়গায় অর্জুন নামিয়ে এনেছিলেন, যার জেরে প্রকাশ্য রাস্তায় সাধারণ নাগরিক, যারা অর্জুনের নুন খেয়েছেন বলেই স্থানীয় স্তরে পরিচিত, তারা যেভাবে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে হেনস্থা করার চেষ্টা করেছিল, সমস্ত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকদের কাছে তা ছিল ভয়াবহ আতঙ্কের।

তবে সাধারণ মানুষের কাছে আশ্চর্যের বিষয় হল, কাঁকিনাড়ায় বেশ কয়েকদিন ধরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অর্জুন সিংয়ের নেতৃত্বে গরিব মুসলমানদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চলা সত্ত্বেও, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে কোনও রকম তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। সেই হিংসার জের এতটাই ভয়াবহ ছিল ,যার ফলে রাতারাতি রাজ্য সরকার স্থানীয় জগদ্দল থানাটিকে ভেঙে ভাটপাড়া ফাঁড়িটিকে থানাস্তরে উন্নীত করেন।

তা সত্ত্বেও গোটা হিংসা পর্ব এবং সেই ঘটনাক্রমের সঙ্গে অর্জুন সিংয়ের জড়িয়ে থাকা নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত তো দূরের, প্রশাসনিক স্তরেও কোনও তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। কেন হয়নি? সেটা একটা বড় প্রশ্ন বটে। হিংসার পরিবেশ আপাতভাবে শান্ত হলেও গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে নিজের রাজনৈতিক দাপট বজায় রাখতে অর্জুন সিং আশ্রয় নিয়েছিলেন বিভাজনের রাজনীতির। যেমনভাবে হিন্দু মুসলমানের বিভাজন তিনি করেছেন, ঠিক তেমনই ভাবেই বাঙালি-অবাঙালির বিভাজন করে, গোটা এলাকাটিকে একটি হিন্দুত্বের গবেষণাগার পরিণত করেছেন অর্জুন।

শোনা যায়, নামে-বেনামে এই অঞ্চলে বেশ কিছু চটকলের মালিক অর্জুন সিং খোদ। এইসব চটকলগুলিতে বদলি শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও মুসলমান এবং বাঙালিকে বাদ দিয়ে সমস্ত কাজ যেভাবে পরিচালিত হতে শুরু করল এই সময়ে, তাতে গোটা শিল্পাঞ্চল জুড়ে একটা ভয়াবহ বিভাজনের অক্ষরেখা ক্রমশ পরিস্কার হতে শুরু করে। পাশাপাশি শোনা যায়, শ্রমিক অঞ্চলের বিভিন্ন নেতাদের যেভাবে অর্জুন তার নিজস্ব বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করাতে শুরু করে, তাতে গোটা এলাকায় শ্রমিকের স্বার্থবাহী সংগঠন এবং তাদের আন্দোলন যেন ক্রমশ শুকিয়ে যেতে শুরু করে।

শোনা যায় এই অঞ্চলের এক শ্রমিক নেতা শারাফাত হোসেন প্রতিদিন অর্জুনের সকালবেলার চায়ের আসরে উপস্থিত থাকতেন। তাঁর কাছ থেকে নানা রকম রাজনৈতিক শলা-পরামর্শ আত্মস্থ করে, সেই অনুযায়ী নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করতেন। এই শারাফাতকে ঘিরে বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে বহু বিতর্ক আছে। বামপন্থীদের অন্দরেই এ সময় শারাফাত এবং অর্জুন সংযোগ নিয়ে কানাঘুঁষো চলতে থাকে। এ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হতেই অর্জুন শারাফাতের ক্ষমতাও বাড়াতে থাকে। ক্রমে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে শারাফাত, এবং এতটাই যে সাধারণ গরিব-গুর্ব মানুষ প্রভাবিত হতে শুরু করল শারাফতে। বিশেষ করে বিগত পাঁচ বছর ধরে অর্জুন সিং ঠান্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিতভাবে যেসব মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে ভয়াবহ সামাজিক-অর্থনৈতিক- শারীরিক-মানসিক এবং ধর্মীয় অত্যাচার চালিয়ে এসেছে, সেই মানুষগুলোকেই কব্জা করবার স্বার্থেই ওই শারাফত নামক লোকটিকে ব্যবহার করতে শুরু করে অর্জুন। এ নিয়ে নানা গল্পগাছা শুনতে পাওয়া যায় কাঁকিনাড়াতে।

অর্জুনকে ঘিরে কেবল বাহুবলি পরিচয়টাই যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি আর অর্জুন এতদিনে প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে (পলতা) বেঙ্গল এনামেলের জমি কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে ভাটপাড়া নৈহাটি কো-অপারেটিভ ব্যাংকের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি— প্রায় সবকটি ক্ষেত্রেই অর্জুনের নাম জড়িয়ে বলে দাবি তৃণমূলের। ২০১৯ এ জেতার পর অর্জুন বিজেপিতে প্রকাশ্যে ছিল কমবেশি তিন বছর। সেই সময় ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপতরো হয়েছে। আজও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে সাংসদ তহবিলের দেওয়া অর্থে যে অ্যাম্বুলেন্সগুলিকে রাস্তায় রোগী নিয়ে চলাচল করতে দেখতে পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই বাম আমলে বামপন্থী সাংসদের এমপি ল্যাডের টাকায় কেনা। দু-একটি অবশ্য তৃণমূল সাংসদ দীনেশ বাবুর দেওয়া। তার বাইরে জনকল্যাণে বিগত পাঁচ বছরে অর্জুনের এমপি ল্যাডের টাকায় চোখে পড়ার মত কিছু হয়েছে কিনা সন্দেহ।

একেবারে নিজের লোকেদের হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন (NGO)-র মাধ্যমে এমপি ল্যাডের একটা বড় অংশের টাকা অর্জুন স্থানান্তরিত করেছেন এমন অভিযোগও কানাঘুষো শুনতে পাওয়া যায়। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে জনকল্যাণে যে যে প্রতিশ্রুতি অর্জুন দিয়েছিলেন, যেমন মূল ভাটপাড়ার দুটনম্বর ওয়ার্ডে কালী মন্দির সংলগ্ন মাঠে তিনি একটি আইসিসিউ সুবিধে যুক্ত অ্যাম্বুলেন্স দেবেন জনসাধারণের সুবিধের জন্য, সেসবের অবশ্য কোনও কিছুই এখানকার মানুষের ভাগ্যে জোটেনি।

যাঁরা অর্জুনের বাড়িতে কমবেশি যাতায়াত করেন, তাঁরা মজা করে বলেন, অর্জুনের বাড়ির শো-কেসে, দেওয়ালে আজ যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের ছবি শোভা পায়, কাল আবার সেই সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের ছবি সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত শিবিরের লোকেদের ছবি শোভাবর্ধন করে। তাই বলে পুরনো ছবিগুলিকে কিন্তু বাতিল কাগজের ঝুড়িতে অর্জুন ফেলে দেন না। আবার কাজে লাগবে-- এই দৃঢ় ধারণার ভিত্তিতে তিনি যত্ন করে সেগুলি নিজের দেরাজেই রেখে দেন। অর্জুনের ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে আজ যে নেতার সঙ্গে তার ছবি দেখতে পাওয়া যায়, সেটি আজকের রাত অতিবাহিত হওয়ার পর, আবার ঠিক সেই নেতার বিপরীত শিবিরের নেতার সঙ্গে অর্জুনের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এই কারণে চলতি লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির বাইরে সমস্ত রকম রাজনৈতিক শিবির থেকেই অর্জুনকে আদর করে 'পাল্টু সিং ' নাম দেয়া হয়েছে। অর্জুনের একটি কার্টুন এঁকে সেই কার্টুনের গলায় 'পাল্টু সিং' লেখা উত্তরীয় পরিয়ে, তাঁর বিরুদ্ধে কতজন মানুষকে হত্যা করার অভিযোগ ,কতজনকে তিনি হত্যা করবার চেষ্টা করেছিলেন, সেই অভিযোগের তালিকা দিয়ে প্রতিটি ঘরে ঘরে ,খবরে কাগজের সঙ্গে লিফলেট বিলি করা হয়েছে তৃণমূলের তরফে। বড় বড় ফ্লেক্সও দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে। এসব ছাপিয়ে সবথেকে বড় কথা, গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে এককালে দাপিয়ে রাজনীতি করা অর্জুন সিং এই ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের সময় কার্যত একেবারে নিজের কিছু বৃত্তের বাইরে নিজেকে আর বের করতেই পারেননি। যেভাবে তিনি বিগত পাঁচ বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান,বাঙালি-অবাঙালির রাজনীতি করে গেছেন, তাতে বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকায় বা মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় তার প্রচার পর্ব সে ভাবে জমেনি। বহু টাকা খরচ করেছে গেরুয়া শিবির অর্জুনের নির্বাচনে। কিন্তু তাঁর পক্ষে পোস্টার বা ব্যানার সেসব খোদ ভোটের দিনও তেমন ভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি।

রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া সিপিএম এবার ব্যারাকপুরে প্রচার পর্বে অন্তত যেভাবে কর্মীসমর্থকদের জোরে একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছে, তার সিকিভাগও পারেননি অর্জুন সিং। তৃণমূল কংগ্রেসের মিছিল-মিটিংয়ে তো হিন্দু মুসলমান,বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে একটা বড় অংশের মানুষের জমায়েত হয়েছিল। একইভাবে বামপন্থীদের মিছিলেও দেখতে পাওয়া গেছে ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সব অংশের মানুষের অংশগ্রহণ। কিন্তু অর্জুনের মিছিলে কার্যত এতদল মানুষকেই দেখা গিয়েছে, যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং হিন্দিভাষী। তাঁদেরকেই নৈহাটির মিছিলেও দেখা গিয়েছে, আবার হালিশহরের বলিদাঘাটাতেও মিছিলে ভিড় করেছেন তাঁরাই। কাঁচরাপাড়াতেও তাঁরাই আছেন, এমনকী শ্যামনগর থেকে শুরু করে আতপুর-জগদ্দল বা বারাকপুরের ওয়ারলেস গেটেও দেখা গিয়েছে তাঁদেরই। তাঁর মিছিলে স্থানীয় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল কার্যত শূন্য। বিজেপির যে অংশটুকু তাদের তথাকথিত আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে, সকাল-বিকেল দল বদল করা অর্জুন সিংকে বিজেপি টিকিট দেওয়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল তুঙ্গে। বিজেপির মহিলা মোর্চার সভানেত্রী ফাল্গুনী পাত্রের বাড়ি নৈহাটি বিধানসভা এলাকায়। ফাল্গুনীর সঙ্গে অর্জুনের সংঘাতের কথা কারওর অজানিত নয়।

দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করছেন ফাল্গুনী দেবী। অর্জুন সিং নিজের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের দায়ের করা বিভিন্ন মামলা মকদ্দমা ,খুনের অভিযোগ ইত্যাদির হাত থেকে বাঁচতে, যখন ফের গিয়ে তৃণমূল শিবিরে ভেড়েন, তখন যেভাবে বিজেপি নেত্রী ফাল্গুনী পাত্র এবং তার সমর্থকদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিলেন তিনি, তা নিয়ে পুরনো বিজেপি কর্মীদের মধ্যে একটা বড় রকমের ক্ষোভ রয়েছে। ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে দীর্ঘদিন বিজেপি করা বা আরএসএসের প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা গেরুয়াশিবিরের লোকেরা কখনোই দলবদলু অর্জুন সিংকে আবার বিজেপির প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। বাহুবল, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সহ সমস্ত রকমের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজেপি দলের সাংসদ পদ বজায় রেখেই বছর দুয়েক আগে অর্জুন সিং যখন ফের তৃণমূলে যোগ দেন, তখন তৃণমূলের অনেকেই মনে মনে বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এমনকী অনেকেই লোকসভা ভোট থেকে সরে আসারও সিদ্ধান্ত নেন।

অর্জুনের বিরুদ্ধে এই যে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ, যার অনেকটাই খোদ মমতা বন্দোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা জানেন। তা সত্ত্বেও সেই অর্জুনকে কেন বারবার দলে ফেরান মমতা? কেউ কেউ বলেন, ব্যারাকপুরের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গরিব মানুষের উপর অর্জুনের প্রভাব সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা মমতার ছিল। মমতা নাকি তখন মনে করতেন, ২০০১ থেকে '১১, এই সময়কাল পর্যন্ত স্থানীয় মানুষের একটা বড় অংশের উপরে অর্জুনের যে প্রভাব, তা অটুট। আর তার ভিত্তিতেই নাকি অনেকটা সময় পর্যন্ত খোদ মমতা, ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী পদ ঘিরে কিছুটা সংশয়ের মধ্যে ছিলেন।

শোনা যায়, নৈহাটির বিধায়ক তথা মন্ত্রী অর্থাৎ চলতি লোকসভা ভোটে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী যিনি, সেই পার্থ ভৌমিকের উপস্থিতিতেই তৃণমূল নেত্রী নাকি দলীয় সভায় বলেছিলেন, টিকিট পাবে অর্জুন। কিন্তু একটিবারও তৃণমূল নেত্রী বলেননি ,অর্জুন ব্যারাকপুর থেকেই টিকিট পাবেন। এই কথাকেই বিকৃত করে গোটা তৃণমূল শিবিরে ছড়াতে শুরু করেন অর্জুন। বলে বেড়ান, "মমতা তাঁকে কথা দিয়েছেন, তিনি ব্যারাকপুর থেকেই টিকিট পাবেন। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরের খবর, মমতা অর্জুনকে টিকিট দেবেন বললেও, ব্যারাকপুর থেকে টিকিট পাওয়ার বিষয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। আসলে তখন ধীরে ধীরে মমতার অর্জুনের তথাকথিত জনপ্রিয়তা ঘিরে মোহভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ব্যারাকপুর থেকে তিনি আর তৃণমূলের প্রার্থী হচ্ছেন না— এটা জানার পর অর্জুন নাকি কেঁদে পর্যন্ত ফেলেছিলেন ।

মজার ব্যাপার হল তৃণমূলের প্রার্থী হতে পারছেন না জেনে তখনও পর্যন্ত তৃণমূলে থাকা অথচ খাতায়-কলমে বিজেপির সাংসদ অর্জুন সিং নিজের বাড়িতে না ফিরে সোজা চলে গেলেন বিমানবন্দরে। উড়ে গেলেন দিল্লি। গেলেন বিজেপির সদর দপ্তরে। হাতে তুলে নিলেন বিজেপির ঝান্ডা। তারপর যথারীতি পেয়ে গেলেন লোকসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুর কেন্দ্রের টিকিটও। তবে বিজেপির থেকে। ব্যারাকপুরের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ তড়িৎবাবুর বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে একান্তে আলাপ আলোচনা করলেন। যদিও উভয়েই জানান, এই মুলাকাত নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এই সাক্ষাৎ অর্জুনের কোনো উপকারে লাগুক বা না লাগুক, বামপন্থী শিবিরের ভেতরে একটা বড় রকমের সংশয়ের পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। যার খানিকটা খেসারত অবশ্যই সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে বামপ্রার্থী দেবদূত ঘোষকে দিতে হয়েছে।

আরও পড়ুন:‘কুরুক্ষেত্র’ ব্যারাকপুরে দিনভর প্রত্যাখ্যাত অর্জুন! শেষমেশ বাজি জিতবেন পার্থই?


ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির অর্জুন সিংয়ের বাইরে যে দু'জন বিশেষ আলোচ্য প্রার্থী ছিলেন,তৃণমূলের পার্থ ভৌমিক এবং সিপিএমের দেবদূত ঘোষ। উভয়ই তাঁদের নিজের নিজের মতো করে লোকসভা নির্বাচনে প্রচার পর্ব চালিয়েছেন। উভয়ের সৌজন্য, ভদ্রতা, মানবিক আচরণ ঘিরে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে নানা ধরনের আলাপ আলোচনা হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ হয়তো স্থানীয় মানুষ পার্থ বাবুর ব্যক্তিগত আচার-আচরণের অত্যন্ত অনুরাগী। কেউ হয়তো দেবদূতবাবুর অভিনয়ের অনুরাগী বা তাঁর দল সিপিএমের নীতির পক্ষে। সাংগঠনিক দুর্বলতা সত্ত্বেও গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে দেবদূত যেভাবে তাঁর সমর্থক বা বিরোধী উভয় অংশের রাজনীতি সচেতন মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন তার নিরিখে বলা যায় যে, যদি ব্যারাকপুর থেকে সন্ত্রাস, হুমকি বা সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি সরিয়ে ফেলা যায়, তাহলে একদিন যে শিল্পাঞ্চল মেহনতি মানুষ নিজের ঘাম-রক্ত দিয়ে গড়ে তুলেছিল, বামপন্থী রাজনীতির সেই সুদিন ফিরবে ফের ফিরবে ব্যারাকপুরে।

পার্থ ভৌমিক তৃণমূলের রাজনীতি করেন। কিন্তু তিনি সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। তাঁর পারিবারিক পরিমন্ডলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয়তাবাদী ধারা যেমন রয়েছে, তেমনই তাঁর নিজের কাকা ছিলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মানুষ। ছোট থেকে রামকৃষ্ণ মিশনে পড়েছেন পার্থ। ফলে একটি উদার-মানবিক মনন তিনি পেয়েছেন বলেই আস্থা রাখা যায়। কিন্তু অর্জুনের ছত্রছায়ায় থাকা সাম্প্রদায়িক, দাঙ্গাবাজ ,ভাষাবিদ্বেষী ,বাহুবলি , দুর্নীতি-পরায়ণ লোকজন যাতে কোনও অবস্থাতেই পার্থ ভৌমিকের আশেপাশে ভিড় করতে না পারে ,তা নিয়ে গোড়া থেকেই সজাগ হতে হবে খোদ পার্থকে।

More Articles