রাধানাথ শিকদার না থাকলে জানা যেত না উচ্চতা, তাও এভারেস্টের নাম এভারেস্ট হলো কেন?

Radhanath Sikdar and Mount Everest: রাধানাথ ত্রিকোণমিতির অঙ্ক কষে মেপেজুপে জানালেন পিক XV-এর উচ্চতা ২৯,০০০ ফুট!

পাহাড় এক চুম্বকের ডাকনাম, যে চুম্বক শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আকর্ষণ করে চলেছে মানুষকে, কখনও অভিযাত্রী হিসেবে কখনও বা নিছক পর্যটক। যারা খানিক দূর থেকে পাহাড়ের বরফ, পাহাড়ের শূন্যতা, পাহাড়ের মেঘ মাখতে চান, সেই সব মানুষদের জন্য হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল এক খনি। ঠিক সেভাবেই, যারা এই দুর্লঙ্ঘ্য পর্বতের ডগায় উঠে দেখতে চান নিজের চারপাশটা, অনেক উচ্চতা থেকে দেখতে চান সমস্তটা, তাঁদেরও খালি হাতে ফেরায় না হিমালয়। বিশ্বের সর্বোচ্চ তো বটেই, একাধিক উচ্চতম শৃঙ্গ রয়েছে হিমালয় পর্বতমালায়। সবচেয়ে উঁচু যে, তার নাম মাউন্ট এভারেস্ট। বাঙালির আদরের কাঞ্চনজঙ্ঘাও রয়েছে ধারে কাছেই। কিন্তু এই এভারেস্টের নাম এভারেস্ট হলো কীভাবে? সেই কোনকালে স্রেফ হিসেব কষে কীভাবে রাধানাথ শিকদার মেপে ফেললেন এর উচ্চতা?

সাল ১৮৬১, দিনটা ২ অক্টোবর। ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং ভাইসরয় চার্লস ক্যানিং লর্ড এলগিনকে একটি চিঠি লিখলেন। লিখলেন, লেডি ক্যানিং দার্জিলিং ঘুরতে যাচ্ছেন, রওনা দিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে লেডি ক্যানিং যাবেন সিকিমে। সিকিম থেকেই দেখবেন বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গটি, যাকে 'দেওডুঙ্গা' বা মাউন্ট এভারেস্ট হিসেবেই ডাকছেন মাপজোপকারীরা।

কীভাবে মাপা হলো এভারেস্ট?

এভারেস্টের মাপ নেওয়ার বিষয়টি মেজর জেনারেল স্যার অ্যান্ড্রু স্কট ওয়ার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল এবং ভারতের গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিকাল সার্ভের সুপারিনটেনডেন্ট স্যার জর্জ এভারেস্টের উত্তরসূরি। ১৮১০ সালে এক ভারতীয় সৈনিকের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ওয়া। ১৮২৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন ক্যাডেট নিযুক্ত হন তিনি। ১৮৩২ সালে তাঁকে গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিকাল সার্ভেতে নিয়োগ করা হয়।

আরও পড়ুন- এভারেস্টজয়ীরাও ভয় পান! পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বত এটিই…

১৮০২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বৈজ্ঞানিকভাবে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের জরিপ করার জন্য ট্রিগনোমেট্রিকাল সার্ভে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রাথমিকভাবে কোম্পানি ভেবেছিল ভারতকে মোটামুটি পাঁচ বছরের মধ্যেই মেপে ফেলা যেতে পারে। বাস্তবে তা করতে সময় লেগেছিল ৭০ বছর! ১৮২৩ সাল থেকে সার্ভেটি জর্জ এভারেস্টের তত্ত্বাবধানে হতে থাকে। তিনিই ওয়াকে নিযুক্ত করেন এই কাজে। স্যার এভারেস্টই তখন গণিতবিদের সন্ধানে ব্যস্ত। তখন হিন্দু কলেজে (এখন প্রেসিডেন্সি) অঙ্ক পড়াচ্ছেন অধ্যাপক জন টাইটলার। তিনি এভারেস্টকে জানালেন, তারই এক ছাত্র রয়েছেন। বাঙালি, অঙ্কে তুখোড়। ছাত্রটি রাধানাথ শিকদার। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৯। বয়স কম হলে কী হবে, রাধানাথ ছিলেন প্রথম দুই ভারতীয় ছাত্রের একজন যারা নিউটনের সূত্র পড়ে ফেলেছিলেন। ১৮৩১ সালে গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিকাল সার্ভেতে চাকরি করতে ঢুকলেন রাধানাথ। তাঁর পদ হচ্ছে 'কম্পিউটার'। তখনও তো মেশিন কম্পিউটার আবিষ্কার হয়নি। যারা এসব হিসেবের কাজ করতেন তাঁদেরই বলা হতো কম্পিউটার। তা কম্পিউটার রাধানাথ মাইনে পান মাসে ৪০ টাকা! এমন আরও সাতজন কাজ করতেন 'কম্পিউটার' পদে। তবে নজর কাড়লেন রাধানাথ। স্যার এভারেস্টের নির্ভরযোগ্য সহকর্মী হয়ে উঠলেন। ১৮৪৩ সালে যখন এভারেস্ট অবসর নিলেন তখন অ্যান্ডু স্কট ওয়াকেই তিনি তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করে গেলেন।

স্যার জর্জ এভারেস্ট

১৮৩০-এর দশকের শেষের দিকে হিমালয় অঞ্চলে পৌঁছয় এই ট্রিগনোমেট্রিকাল সার্ভের দল। বিদেশিদের নেপাল প্রবেশের অনুমতিই দেওয়া হয়নি, তাই তরাই থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। ১৮৪৭ সাল নাগাদ ওয়া এবং তাঁর দল দেখলেন 'পিক বি' নামে পরিচিত একটি পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও বেশ উঁচুতে রয়েছে। এটিকেই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত হিসেবে মনে করা হতে থাকে।

তবে মুখে বললেই তো হলো না, হিসেব লাগে, প্রমাণ লাগে। গণনা এবং পর্যবেক্ষণ চলতেই থাকে। পিক বি থেকে নাম পালটে রাখা হয় 'পিক XV’। অন্যদিকে, ১৮৫১ সালে পদোন্নতি হলো রাধানাথের। তিনি তখন 'চিফ কম্পিউটার'। কলকাতায় বদলি হলো তাঁর। সেখানে মেটেরিওলজিকাল বিভাগের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হলেন রাধানাথ শিকদার। এই সময়েই রাধানাথ দার্জিলিংয়ের বরফে ঢাকা শৃঙ্গগুলির উচ্চতা মাপতে শুরু করেন। ১৮৫২ সাল নাগাদ গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার অবশেষে জানালেন সেই 'পিক বি' শৃঙ্গটিই পৃথিবীর সর্বোচ্চ। রাধানাথ ত্রিকোণমিতির অঙ্ক কষে মেপেজুপে জানালেন পিক XV-এর উচ্চতা ২৯,০০০ ফুট! কিন্তু ওয়া তাতে আরও ২ ফুট জুড়ে ২৯,০০২ ফুট করে দিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল রাধানাথের মাপজোপে কিছু না কিছু ভুল তো হবেই। তাছাড়া গোটাগুটি ২৯ হাজার কেমন যেন লাগছে। একটু বাড়িয়েই রাখলে ক্ষতি কী! ১৮৫৬ সালে অবশেষে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মাপ ঘোষণা করা হলো ২৯,০০২ ফুট। পরে, ১৯৫৫ সালে আবার এক ভারতীয় সমীক্ষায় মেপে দেখা যায় এভারেস্টের উচ্চতা ২৯,০২৯ ফুট বা ৮,৮৪৮ মিটার।

রাধানাথ শিকদার

আরও পড়ুন- এভারেস্টের চেয়ে খাটো, তবু আজও কেন ‘অজেয়’ কৈলাস, রহস্যে মোড়া শিব ঠাকুরের আপন দেশ!

‘মাউন্ট এভারেস্ট’-এর নাম মাউন্ট এভারেস্ট হলো কেন?

ফিরে আসা যাক আবার ১৮৫০-এর দশকে। পাহাড়ের নামকরণের ক্ষেত্রে সাধারণত স্থানীয় নাম বেছে নেওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু মাউন্ট এভারেস্টের কোনও স্থানীয় নাম খুঁজে পাননি ওয়া। নেপালে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে সেখানে গিয়ে নাম খোঁজার কাজটিও করা যায়নি। এসব ঝামেলার মধ্যেই ওয়া বলেন, পর্বতশৃঙ্গটির নাম 'মাউন্ট এভারেস্ট' হতে পারে। ১৮৬৫ সালে রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি এই নামটিকেই মান্যতা দেয়।

তাহলে এতদিন ধরে এভারেস্টের নামই ছিল না কোনও?

এটা ঠিকই যে নির্দিষ্ট একটি স্থানীয় নাম দেওয়া কঠিন ছিল। তবে, ১৮ শতকের মানচিত্রে এর তিব্বতি নাম কমোলংমা (বা চোমোলুঙ্গমা) অনুযায়ীই এর উল্লেখ মেলে। দার্জিলিংয়ে এটিকে দেওডুঙ্গা বলা হত, যার অর্থ পবিত্র পর্বত। নেপালের প্রকৃতিবিদ ব্রায়ান হাউটন হজসন এই নামটি দেন। কিন্তু যার নামে এই এভারেস্টের নাম হলো, সেই স্যার জর্জ এভারেস্ট তো রেগেই যান। যথেষ্ট আপত্তি করেন। তিনি কখনও এই পর্বতটি দেখেনওনি, এই পর্বত আবিষ্কারও করেননি, খামোখা তাঁর নামে কেন ডাকা হবে এত বড় পর্বতশৃঙ্গকে! তিনি আরও জানিয়েছিলেন, হিন্দিতে তাঁর নাম উচ্চারণ করা কঠিন। কিন্তু কী আর করা যাবে, ততদিনে এভারেস্ট নামেই ডাকা হতে শুরু করেছে এই পর্বতশৃঙ্গকে।

অ্যান্ড্রু স্কট ওয়া ১৮৫৬ সালে রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির স্বর্ণপদক পান এবং ১৮৫৮ সালে রয়্যাল সোসাইটিতে নির্বাচিত হন। ১৮৬১ সালে অবসর গ্রহণ করেন ওয়া। ১৮৭৭ সালে প্রয়াত হন তিনি। রাধানাথ অবশ্য মারা গিয়েছেন তাঁর আগেই, ১৮৭০ সালে।

More Articles