বিশ্বজুড়ে যেভাবে ফাঁদ পেতেছে বোয়িং-এয়ারবাস

Boeing-Airbus: বিশ্বব্যাপী বিমান বাজারের ৯৯% নিয়ন্ত্রণ করে বোয়িং (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং এয়ারবাস (ইউরোপ)। বিমানের বাজার শুধুমাত্র এই দুটি সংস্থার হাতে রয়েছে।

আহমেদাবাদ থেকে লন্ডন গ্যাটউইকের উদ্দেশে উড়ান শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই১৭১। এই বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারে ২৪২ জন আরোহী ছিলেন। মাত্র একজন বেঁচে ফিরেছেন। এই ঘটনায় অন্তত ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এখন এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ খুঁজছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ৭৮৭ মডেলটিও যে এতবড় দুর্ঘটনার মুখে পড়়বে, তা কি সত্যি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি সংশ্লিষ্ট বিমানকর্মীরা? বোয়িংয়ের অন্যান্য বিমান, যেমন ৭৩৭ ম্যাক্স, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে সব মিলে ৩৪৬ জন মারা যান। এই ঘটনাগুলো বোয়িংয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দুর্ঘটনাগ্রস্থ বিমানটি কি আদৌ যাত্রী পরিবহণের যোগ্য ছিল? বারবার প্রশ্ন উঠছে, এত উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও কেন ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে?

বিশ্বব্যাপী বিমান বাজারের ৯৯% নিয়ন্ত্রণ করে বোয়িং (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং এয়ারবাস (ইউরোপ)। বিমানের বাজার শুধুমাত্র এই দুটি সংস্থার হাতে রয়েছে। আমরা যদি ভেবে দেখি তাহলে দেখব- যাত্রা করা প্রায় প্রতিটি বিমানই বোয়িং অথবা এয়ারবাস জেটের। এই দুই সংস্থা সিদ্ধান্ত নেয় একজন যাত্রী কোথায় কোন বিমানে করে যাত্রা করবেন। এয়ার ইন্ডিয়া, লুফ্‌ৎহানসা, ইউনাইটেড থেকে ইন্ডিগো এই বিমান সংস্থাগুলি ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। এদের একচেটিয়া আধিপত্য বিশ্বব্যাপী।

কিন্তু কেন কেউ প্রতিযোগিতায় আসতে পারে না? একটি বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা তৈরি করা স্বাভাবিক ভাবেই একটি গাড়ির সংস্থা খোলার মতো নয়। বিমান সংস্থা চালু করতে প্রয়োজন- ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ। উন্নয়ন ও বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তায় গবেষণার ১০ বছরেরও বেশি সময়ের শংসাপত্র থাকতে হয়। বিশ্ব জুড়েই এই রীতি চলছে। এমনকী চিনের COMAC এখনও বিশ্বব্যাপী বিমান প্রতিযোগিতায় আসতে পারেনি।সংস্থাটির উঠে আসতে এখনও কয়েক দশক সময় লাগবে। COMAC (চীন), UAC (রাশিয়া), Boom (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সবাই প্রতিযোগিতায় আসতে চাইছে। কিন্তু সার্টিফিকেশন এবং স্কেল নির্ধারণ এই বিষয়গুলিতে প্রায় কয়েক দশক সময় লেগে যায়।

বোয়িং এবং এয়ারবাস কেবল পারস্পরিক প্রতিযোগিতা করে না, তারা অন্যান্যদের রীতিমতো হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বোম্বার্ডিয়ারের সি সিরিজ (Bombardier CSeries)-কে এয়ারবাস কিনে নিয়েছে। অন্যদিকে, বোয়িং এমব্রায়ার (Embraer)-কে প্রায় এটি অধিগ্রহণ করে ফেলেছে। ম্যাকডোনেল ডগলাস (McDonnell Douglas)- এও বোয়িং হস্তক্ষেপ করছে। প্রতিবার যখনই কোনও সংস্থা প্রতিযোগিতায় আসতে চায়, তখনই দুই সংস্থা ঢুকে পড়ে। এতে নতুন বিমান সংস্থা আর উঠে আসতে পারে না।

প্রায় প্রতিটি এয়ারলাইন কেবল একটি এয়ারক্রাফটের সঙ্গে কাজ করছে। যেমন- ইন্ডিগো: সমস্ত কাজ এয়ারবাস-এর সঙ্গে করছে, অন্যদিকে রায়ানএয়ার: সমস্ত কাজ বোয়িং-এর সঙ্গে করছে। এতে প্রশিক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কমে ঠিকই কিন্তু সিস্টেম ঝুঁকিপূর্ণ হয়। যখন ৭৩৭ ম্যাক্সের দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তখন প্রায় ৩০,০০০ এরও বেশি বিমান বাতিল করতে হয়েছিল। এর অন্যতম কারণ হলো শুধুমাত্র একটি সংস্থার উপর নির্ভর করা।

একটি এ৩২০নিও (A320neo)-এর দাম ৯০০ কোটি ডলারেরও বেশি ($১১০ মিলিয়ন)। একটি সেভেনথ্রিসেভেন(737 MAX)-র দাম? ১,০০০ কোটিরও বেশি। বিমান সংস্থাগুলির সঙ্গে আলোচনার পর এটি ছাড় দেওয়া মূল্য। যখন তারা দাম বাড়ায়, তখন বিমানের টিকিটেরও দাম বাড়ে  এবং যাত্রীদেরই সেই খরচ বহন করতে হয়।

বোয়িং ৭৩৭, ১৯৬৭ সালে চালু হয়। আজকের ৭৩৭ ম্যাক্স সেই ৬০ বছরের পুরনো নকশার উপর ভিত্তি করে তৈরি। ১৯৮০ সালে তৈরি হওয়া এ৩২০(A320) বিমানটিকে এখন নতুন ভাবে সাজিয়ে পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন এগুলি মৌলিকভাবে বিকশিত হয়নি? এই পদ্ধতিতে খরচ কম এবং লাভজনক বলেই কি এই সিস্টেমকেই বেছে নিয়েছেন সংস্থাগুলি?

প্রতিযোগিতায় সঙ্কটে পড়েছে ৭৩৭ এম৮/২০ (737M8/20)। এয়ারবাসের এ৩২০নিও (A320neo)-এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বোয়িং দ্রুত ৭৩৭ ম্যাক্স (737MAX) তৈরি করেছিল। নতুন বিমান তৈরির পরিবর্তে, তারা পুরনো বিমানটি পরিবর্তন করে। তখন ত্রুটিপূর্ণ সফ্টওয়্যার এমসিএএস (MCAS)-তে নজরই দেওয়া হয়নি। এর ফলে দুটি দুর্ঘটনায় ৩৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সংস্থার ইমেলগুলিতে দেখা গেছে, বোয়িং খরচ বাঁচাতে এবং সিমুলেটর প্রশিক্ষণ এড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

একটা সময় বোয়িং-এর এত প্রভাব ছিল যে এফএএ (FAA) তাদের ম্যাক্স (MAX)-এর কিছু অংশে রেজিস্ট্রেশন করতে দিয়েছিল। প্রশ্ন উঠছে, এটা কি স্বার্থের জন্য করতে দেওয়া? মনে রাখতে হবে, ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর, এফএএ (FAA) স্বীকার করে তারা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

২০২৩ সালের জুলাই মাসে, ইন্ডিগো বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিমানের অর্ডার দেয়। ৫০০টি এয়ারবাস এ৩২০নিও (A320neo)জেট নিয়ে এর মূল্য হয়েছিল ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ? ইন্ডিগো দীর্ঘদিন ধরে এয়ারবাসের অনুগত ছিল। এই অর্ডার ভারত-ফ্রান্স শিল্প সম্পর্ককে শক্তিশালী করেছিল। ফরাসি রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোঁ ব্যক্তিগতভাবে এয়ারবাসকে "কৌশলগত অংশীদার" হিসেবে প্রচার করেছিলেন।
বিমান একটি ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

আমেরিকান এয়ারলাইন্স ২০১১ সালে এয়ারবাসকে দেওয়া অর্ডারে বোয়িং-এর রেকর্ড ভেঙে ফেলে। কিন্তু কেন এমন করেছিল আমেরিকান এয়ারলাইন্স? কারণ, বোয়িং বনাম এয়ারবাসের খেলায় বড় বিমান সংস্থাগুলি আরও ছাড়, সুবিধা এবং দ্রুত ডেলিভারি পায়।
এতে ছোটো বিমান সংস্থাগুলি আরও সমস্যায় পড়ে।

বর্তমানে বিমান পরিষেবা এমন কিছু সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, যেখানে সন্দেহের অবকাশ থাকছে। বোয়িং আমেরিকার কাছ থেকে কর ছাড় পায়। এয়ারবাস ইউরোপীয় সরকার থেকে সহায়তা পায়। একটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে ওই সংস্থার কোটি কোটি টাকার শেয়ার মূল্য পড়ে যায়। কিন্তু যখন বাজার ভালো থাকে তখন তাদের রেষারেষিতে নিরাপত্তার দিকটাই সবথেকে অবহেলিত হয়। তারই ফল হয়তো এমন দুর্ঘটনা। পড়ে থাকে একটাই প্রশ্ন, দায় কার?

More Articles