দেশবিদেশে ছড়িয়ে নারকেলের যাত্রাপথ! কীভাবে জন্ম নিয়েছিল বাঙালির প্রিয় ফল
নারকেল, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Cocos nucifera, তার জন্ম আদতে কোথায় হয়েছিল?
১৯৭৯ সালের ৯ জানুয়ারি স্পেনের সুবিশাল এক জাহাজ ত্রিনিদাদ থেকে কিউবা হয়ে স্পেনের পথে রওনা দিল। ত্রিনিদাদ ও কিউবা থেকে আমদানি করা কাঠ, কিউবান রাম, সিগার, রসুন, প্রভৃতির পাশাপাশি ত্রিনিদাদের নারকেল বোঝাই করে সেই জাহাজ যখন স্পেনের পথে পাড়ি দিয়েছে, জাহাজের নাবিক থেকে কর্মীরা আকণ্ঠ সুরা পান করে নেশায় মত্ত। নেশা এতই বেশি হয়েছিল, জাহাজ এসে লেকওয়ার্থ কাউন্টির তীরে ধাক্কা খেল, যা আদতে ফ্লোরিডার তীরে অবস্থিত। মদ্যপ জাহাজকর্মীরা ভাবলেন তাঁরা বুঝি এসে মেক্সিকোর তীরে ভিড়েছেন।
তীরে তখন হাতে গোনা কয়েক জন মানুষের বাস; তা-য় খাবারের অভাব। স্পেনের এই জাহাজে বয়ে আনা কুড়ি হাজার নারকেল দেখে যেন তীরের বাসিন্দাদের ধড়ে প্রাণ এল। জাহাজে বয়ে আনা এক-একটি নারকেল আড়াইশো সেন্ট করে বিক্রি করেছিলেন স্প্যানিশরা। তবে মাত্র এগারোশো নারকেল বিক্রি হয়। বাদবাকি নারকেলের বেশ কিছু রোপন করা হয়। তার পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে ফ্লোরিডার সেই সমুদ্রতীর ভরে ওঠে সারি সারি নারকেল গাছে।
আরও পড়ুন: জঘন্য ক্রীতদাস প্রথা না থাকলে বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার হতোই না! লজ্জার সেই ইতিহাস
স্পেনের এই জাহাজ ফ্লোরিডার সমুদ্রতীরে ভেড়ার পঞ্চাশ বছর পরে স্থানীয় এক সংবাদদাতা লিখেছেন,
From that wreck has grown the palms that line the streets and parks of Palm Beaches. [..] 20.000 coconuts provided the beginning of trees not indigenous to the area, but quite at home, nevertheless.
Palm Beach Post, Nov 20 1938
বর্তমানে আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দুই তীরেই বিপুল সংখ্যক নারকেল গাছ চোখে পড়ে। কিন্তু নারকেল, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Cocos nucifera, তার জন্ম আদতে কোথায় হয়েছিল?
২ সেপ্টেম্বর পালিত হয় ওয়ার্ল্ড কোকোনাট ডে। নারকেলের গুণাগুণ তো বটেই, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শুরু করে প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগরের দুই তীরে গড়ে ওঠা অসংখ্য নগর, জনপদ, গাঁ-গঞ্জের অর্থনীতি যার ওপর নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল, সেই নারকেল গাছ সংরক্ষণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এই দিনটি পালিত হয়।
নারকেলের মূল জন্মস্থল কোথায়, তা জানতে কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে আরেক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে বিস্তীর্ণ, গভীর মহাসাগর পেরিয়ে, সুপ্রাচীন পথ ধরে যে বানিজ্য চলেছে, তার ইতিহাসের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। কারণ দীর্ঘকাল ধরে এই দেশের নারকেলের সঙ্গে অন্য কোনও দেশের নারকেলের সংকরায়ণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নারকেলটির উৎপত্তি এবং ইতিহাসের দলিল স্পষ্ট পাওয়া যাবে তার জিনে। জিনের খুঁটিনাটি স্পষ্ট বলে বলে দেয় একটি নারকেলের প্রজাতি আরেকটি নারকেলের প্রজাতির আত্মীয় হিসেবে কতটা নিকট। পাশাপাশি জানা যায়, দু'টি ভিন্ন অঞ্চলে বেড়ে ওঠা উদ্ভিদ প্রজাতির (এক্ষেত্রে নারকেল) মধ্যে বাহ্যিক বৈসাদৃশ্য থাকলেও তারা আদতে জিনগতভাবে একই কি-না, সেই ইতিহাসও লেখা থাকে জিনেই।
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কেনেথ ওসলেন এবং তাঁর সহকর্মীরা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মোট ১৩২২টি নারকেল গাছের ডিএনএ সংগ্রহ করেন। ২০১১ সালে একটি 'পাবলিক লাইব্রেরি অফ সায়েন্স' জার্নালে তাঁদের গবেষণা প্রকাশিত হয়। ড. ওসলেন শুরুতে ভেবেই নিয়েছিলেন, বাদবাকি উদ্ভিদ প্রজাতির মতো, নারকেলের জেনেটিক গঠন বুঝি খুব জটিল হবে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ড. ওসলেন দেখলেন, পৃথিবীতে যত নারকেল গাছ ছড়িয়ে রয়েছে, তাদের মূলত দু'টি জিনগত দলে (জেনেটিক গ্রুপ) বিভক্ত। জেনেটিক তথ্য বলে দিচ্ছে, পৃথিবী সমস্ত নারকেল গাছের মধ্যে একদল নারকেল গাছ ভারতের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল থেকে উদ্ভূত হয়েছে; অপরটির উদ্ভব ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে।
ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বাদে পৃথিবীর যে-সমস্ত অঞ্চলে নারকেল গাছ দেখা যায়, তারাও এই দু'টি জেনেটিক গ্রুপের যে কোনও একটির অন্তর্গত। ড. ওসলেন জানাচ্ছেন, ভারতীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রকারের মধ্যে জেনেটিক বৈচিত্র কিন্তু লক্ষ করার মতো। শুধু তাই নয়, তাঁর ধারণা জিনগতভাবে ভিন্ন, দু'টি গাছের বিবর্তনের ধারা, তাদের বিবর্তনের ইতিহাস পরস্পরের থেকে বড়ই ভিন্ন। আর সেই বিবর্তনের ইতিহাসের দলিল এ-ও জানান দিচ্ছে, সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ নারকেলকে একবার নয়, দুইবার চাষ করেছে- প্রথমবার ভারতে; দ্বিতীয়বার মালয় উপদ্বীপে।
মালয় উপদ্বীপে যে নারকেলগুলি চাষ করা হতো, পরবর্তীকালে সেগুলোই ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিকদের হাত ধরে পলিনেশীয় দ্বীপ, অর্থাৎ মধ্য এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। তারও পরে অস্ট্রোনেশিয়ান নাবিক ও বাণিজ্যিকদের হাত ধরে ফিলিপিনস থেকে মধ্য আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় তীরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়িয়ে মালয় উপদ্বীপের নারকেল।
নারকেলের অন্য জিনগত দলটি, অর্থাৎ যেটির উৎস ভারতে, সেটি ধীরে ধীরে ভারতের পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে এটি পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বাণিজ্যিকদের হাত ধরে, আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী আফ্রিকান দেশ এবং ক্রমে দক্ষিণ অফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রথমবারের মতো পৌঁছয় জন্মগতভাবে ভারতীয় এই নারকেলগুলি।
এদিকে মাদাগাস্কারে যে নারকেলের প্রজাতি দেখা যায়, তা আবার ভারতীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় নারকেলের জিনের সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছে। এই দুই জিনগত দলের নারকেলের তফাৎ যে কেবল জিনেই অন্তর্নিহিত রয়েছে, তা কিন্তু নয়। তাদের বাহ্যিক রূপেও ধরা পড়ে সেই তফাৎ।
ইন্দো-আটলান্টিক পথে বিস্তৃত হয়েছিল যে নারকেল, তারা বেশ লম্বাটে এবং খানিকটা যেন তিনকোনা। ভেবে দেখতে গেলে আমরা ভারতীয়রা তো এই আকারের নারকেলই দেখতে পাই আমাদের চারপাশে। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগর-পথে আসা নারকেল একটি যেন গোলাকার।
নারকেলের বিবর্তনের পুরনো ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় আরও আশ্চর্য তথ্য। নারকেল-সহ বিভিন্ন পামজাতীয় গাছের ক্ষেত্রে লম্বাটে ফল দেখা যায় 'ওয়াইল্ড টাইপ' অর্থাৎ প্রাথমিক এবং প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর বুকে অদ্ভূত হওয়া গাছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে চলতি ভাষায় যাকে 'বুনো' প্রজাতি বলা হয়।অন্যদিকে, যে গাছগুলি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের হাতে চাষআবাদের ফলে বেড়ে উঠেছে, অর্থাৎ যারা 'ডোমেস্টিকেটেড', তাদের ফলের আকৃতি আবার গোলাকার। যদিও পামজাতীয় গাছের ক্ষেত্রে পূর্বপ্রচলিত এই তত্ত্বটি আর খাটে না। সমসাময়িক গবেষণার সামনে পুরনো তত্ত্ব বাতিল বলে গণ্য হয়েছে।
তবে নারকেলের জিনগত ইতিহাস আপাতদৃষ্টিতে সহজ ও সাদামাটা। তবু যদি আমরা ইতিহাসের গর্ভ খুঁড়ে সুপ্রাচীন, বাণিজ্যিক পথের দিকে তাকাই, যদি আমরা ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিষ্ঠা এবং পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ধর্মের ভৌগোলিক বিস্তারের কথা ভাবি, তাহলে দেখব জিনের বিবর্তনের ইতিহাসেও কীভাবে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে।

Whatsapp
