কোটিপতিদের শহরে সাধারণের মেয়র! কী ভাবে হলেন মামদানি?
Zohran Mamdani: এলিটদের বক্তব্যে কখনও সাধারণ মানুষের কথা, মধ্যবিত্তের সমস্যার কথা উঠে আসেনি; তাদের লক্ষ্য ছিল মূলত দু'টো— এক, হাইপার ক্যাপিটালিজম, আর অন্যটি, হলো জায়োনিজম ন্যারেটিভ প্রচার করা।
' I’m a democratic socialist... '
বছর ৩৪ এর এক যুবকের বলিষ্ঠ কণ্ঠ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বের অগণিত নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের অন্দরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত বিশ্বের দরবারে, তার একটি শহরের মেয়র পদে সম্প্রতি নির্বাচিত হয়েছেন জোহরান মামদানি, উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক মুসলিম যুবক। আয়তনে ভারতের ২২ ভাগের এক ভাগ হওয়া সত্ত্বেও শহরটির জিডিপি আমাদের দেশের অর্ধেকের চেয়েও বেশি। দু'টো নামকরা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাণকেন্দ্র এই নিউইয়র্ক। ইহুদি প্রধান বড়োলোকদের শহরে একজন কমবয়সি মুসলিম যুবক মেয়র! অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের সাথে, আমরা, যারা ভূ-রাজনীতি কম বুঝি, মামদানি জ্বরে কম বেশি সকলেই আক্রান্ত। প্রশ্ন হলো কেন? তিনি তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র, কিন্তু সেই পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে বলতে হচ্ছে— ‘আমি ভোটে দাঁড়ালে মামদানি হেরে যেত’। এখানেই আন্দাজ পাওয়া যায় উত্তাপের বহর।
জোহরানের জেতার কারণ খুঁজতে গেলে আমাদেরকে আগে তাঁর উত্থান বুঝতে হবে, আর সেজন্য আমাদেরকে আগে নিউইয়র্ককে জানতে হবে। এটি আর পাঁচটা মেট্রো শহরের মতো নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী না হলেও এটি পৃথিবীর বিলিয়নিয়ারদের রাজধানী; ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী এই শহরের ১২৩ জন মানুষের হাতে রয়েছে ৭৫৯ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ। সম্পদের এই পরিমাণ কেন্দ্রীকরণ ভাবা যায়! অর্থনীতিবিদরা সাধারণত বলে থাকেন কোনো শহর বা অঞ্চলের মানুষ কেমন আছেন, তা অনুধাবন করতে গেলে আমাদেরকে আগে সেন্ট্রালাইজেশান অফ ওয়েল্থ বুঝতে হবে। তাত্ত্বিক কচকচানি এক পাশে সরিয়ে রেখে আমরা যদি উপরের অঙ্কের দিকে তাকাই, তাহলেও ব্যাপারটা অনেক পরিস্কার হয়। দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়েছে, ড্রাগের ব্যবসা রমরম করছে, লোন ছাড়া উচ্চ শিক্ষা সেদেশে বিলাসিতা-যাঁরা আবার স্টুডেন্ট লোন নিচ্ছে, তাঁদের পরিশোধ করতে গিয়ে অর্ধেক জীবন কেটে যাচ্ছে। চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া। এত বিশাল সম্পদ থাকার পরেও শহরের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষজন লড়াই করতে করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন; তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি কিনতে পারছে না— ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন (তিন দশক আগে মধ্যবিত্তরা কিন্তু বাড়ি বানাতে পারতো)। এককথায় মানুষজন আবাসন সমস্যায় জর্জরিত। ঠিক এই জায়গাটাকে টার্গেট করেছেন মামদানি।
আরও পড়ুন
মীরা নায়ারের পুত্র, মোদি সমালোচক— নিউ ইয়র্ককে দিশা দেখাবেন ভাবী মেয়র মামদানি?
এই লড়াই শুরু বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই; পড়াশোনা শেষ করে জোহরান একজন হাউজিং কাউন্সিলর হিসেবে জীবন শুরু করেন। দীর্ঘদিন বাড়িভাড়া দিতে না পারার জন্য যাদেরকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়, তাঁদের নিয়ে কাজ শুরু করেন জোহরান। তখন বুঝতে পারেন ঝাঁ চকচকে শহরের সাথে আঠার মতো লেগে আছে আবাসন সমস্যা, যার ভুক্তভোগী মধ্যবিত্ত মানুষজন। সেই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য, জোহরান ২০১৭ সালে ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট ফর অ্যামেরিকায়’ (ডি এস এ) যোগ দেন। প্রতিষ্ঠানিক রাজনীতি সেই শুরু। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা, এই মৌলিক অধিকারগুলো থেকে সমাজের কেউ যেন বঞ্চিত না হয়, সেই দাবিতে তাঁদের আন্দোলন চলতে থাকে। কোনো বড় সংস্থা, মিডিয়া হাউজের মাধ্যমে তাঁরা প্রচার চালায়নি, বরং ছোটো ছোটো মনগ্রাহী ভিডিও ও কনটেন্টের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন মামদানি। বরফ জলে চান করতে করতে মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছন— ‘আমি আপনাদের রেন্ট ফ্রিজ করে দেব'।
নিউইয়র্ক বহু ভাষাভাষীর শহর; পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উর্দু, বাংলা , হিন্দি ভাষী মানুষ বাস করেন এখানে। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে তাঁদেরই ভাষাতে পৌঁছে গিয়েছেন সে, না কোনো দোভাষী ব্যবহার করেননি, বরং নিজে যতটুকু জানে সেটাকেই সম্বল করে প্রচার করে গিয়েছেন। বিরোধী ধন-কুবেররা যখন ম্যানেজার রেখে প্রচার চালিয়েছেন, তখন মামদানির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। এক কথায় তাঁর মধ্যে যে মাটির গন্ধ মিশে আছে, সেটাই তাঁকে কয়েক কদম এগিয়ে রেখেছে। এক জরিপে দেখা গিয়েছে, মামদানি তাঁর পূর্ববর্তী পাঁচ জন মেয়রের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন
কোন মন্ত্রে ট্রাম্পের দুর্গে এত বড় ফাটল ধরালেন মামদানি?
নিউইয়র্কের সাধারণ মানুষ বুঝেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের এলিট শ্রেণির অবহেলা থেকে মুক্তি পেতে হলে মামদানির মতো সমাজতান্ত্রিক মানসিকতার এক যুবকের প্রয়োজন। এলিটদের বক্তব্যে কখনও সাধারণ মানুষের কথা, মধ্যবিত্তের সমস্যার কথা উঠে আসেনি; তাদের লক্ষ্য ছিল মূলত দু'টো— এক, হাইপার ক্যাপিটালিজম, আর অন্যটি, হলো জায়োনিজম ন্যারেটিভ প্রচার করা। প্রথমটি চলতে থাকলে বড়োলোক আরও ধনী হতে থাকবে, মধ্যবিত্তের পায়ের তলার মাটি কখনও শক্ত হবে না। অপরদিকে দ্বিতীয়টি চলতে থাকলে দেশের উন্নয়ন ও স্বার্থের চেয়ে ইজরায়েলের স্বার্থ বেশি অগ্রাধিকার পাবে ধনতান্ত্রিক নেতাদের কাছে। এই ক্ষেত্রে মামদানির অবস্থান সম্পূর্ণ ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে; মেয়র হওয়ার আগেই সে ঘোষণা করেছিলেন নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে তাঁকে গ্রেফতার করবেন। এই স্পিরিটটা ভালো লেগেছে শহরবাসীর। ধন-কুবেরদের শোষণ, এলিট শ্রেণির অবজ্ঞা-অবহেলার জবাব একদিন দিতেই হত। তাই মামদানির জয়, যতটা না জয়, তার থেকে বেশি হার ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিভূদের।
একটা সম্ভাবনা ও আশঙ্কার কথা বলে আজ শেষ করব— নির্বাচনের ফলাফলটা যদি অন্যরকম হত, অর্থাৎ মামদানির বিরোধী পক্ষ জিতে যেত, তাহলে কী হত? সে ইজরায়েলের পক্ষে কথা বলত, আর ট্রাম্পের যুদ্ধবাজ নীতিকেই সমর্থন করত। সেগুলো কোনোটাই হলো না এ যাত্রায়। তবে মামদানি যে জনমুখি প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে, সেগুলো কী বাস্তবায়ন হবে? কারণ সেনেটের অনেক সদস্যই মন থেকে বিশ্বাস করতে পারেন না সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনা। ফলে মামদানি যে বাঁধার সম্মুখীন হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও নিউইয়র্কের মেয়রের মধ্যে সাপে-নেউলের সম্পর্ক। দুই লবিরই লোকজন আছেন, যাদের মধ্যে চাপান-উতোর বাড়তে পারে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই আঁচ গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে কিনা তা সময়ই বলবে, নিউইয়র্কের সাধারণ মানুষ বরং এই জয়ের আনন্দটা উপভোগ করুক, কারণ এই জয় তাদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের নির্যাস।

Whatsapp
