ক্রিশপার জিন এডিটিং পদ্ধতি কীভাবে বাঁচিয়ে দিল শিশুর প্রাণ?
Crispr Gene-editing : যদি চিকিৎসাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং অনিচ্ছাকৃত মিউটেশন ঘটায়, তাহলে তা রোগীর শরীরে আজীবনের স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মেও তা স্থানান্তরিত হতে পারে।
সম্প্রতি, ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেন'স হসপিটালের কেজে মুলডুন নামের এক শিশু চিকিৎসা -ইতিহাসে নতুন এক পর্বের সূচনা করেছে। আসলে, একটি বিরল জেনেটিক রোগ নিয়ে শিশুটির জন্ম হয়েছিল। রোগটি প্রতিদিনের সাধারণ প্রোটিনকেই শরীরের শত্রুতে পরিণত করতে শুরু করেছিল। ফলে, কেজে নামক ওই শিশুটিকে থাকতে হত কঠোর খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে। আশঙ্কা ছিল আগত ভবিষ্যতে মস্তিষ্কের বড়ো কোনও ক্ষতি হতে পারে কেজে-র। কিন্তু ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারিতে, মাত্র ছয় মাস বয়সে, সে বিশ্বের প্রথম CRISPR-ভিত্তিক থেরাপি গ্রহণ করে—যা বিশেষভাবে তার অনন্য জেনেটিক ত্রুটির জন্য তৈরি করা হয়েছিল। চিলড্রেন'স হসপিটাল অফ ফিলাডেলফিয়া (CHOP) এবং পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পেরেলম্যান স্কুল অফ মেডিসিনের একটি দল মাত্র ছ-মাসের মধ্যে এই যুগান্তকারী চিকিৎসা-পদ্ধতিটি তৈরি করেছে। চিকিৎসকদের এই সাফল্য শুধু কেজে-কে বাঁচায়নি, বরং জিন এডিটিংকে চিকিৎসার জগতে এক নতুন দিশা দেখিয়েছে।
আরও পড়ুন-
সৌরজগতে ঢুকে এসেছে অচেনা ধূমকেতু, ‘অ্যাটলাস’ সম্পর্কে কী বলছেন বিজ্ঞানীরা?
ভাবুন তো, আপনার শরীর যদি একটি বইয়ের মতো হয়, সেই বিরাট বইতে শুধু একটি টাইপিং ভুল—ডিএনএ-র বিশাল কোডে একটি মাত্র অক্ষরের ত্রুটি। কেজে-র ক্ষেত্রে, এই ভুলটি তার CPS1 জিনে প্রভাব ফেলেছিল, যার ফলে তার লিভার প্রোটিন ভাঙার পর উৎপন্ন বিষাক্ত অ্যামোনিয়া প্রক্রিয়াকরণ করতে পারছিল না। এর অভাবে, অ্যামোনিয়া রক্তে বিষের মতো জমা হতে থাকে। যার ফলে বমি, দুর্বলতা এবং এমনকি কোমা পর্যন্ত হতে পারে। কার্বাময়েল ফসফেট সিন্থেটেজ ১ ডেফিসিয়েন্সি নামক এই রোগটি প্রতি তেরো লক্ষ নবজাতকের মধ্যে প্রায় একজনের হয়ে থাকে, যা রোগীরকে আজীবন কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থাকতে বাধ্য করে।

জিন এডিটিং
এই সমস্যার সমাধান-পথ নিয়ে এসেছে CRISPR, যাকে প্রায়শই ডিএনএ নির্ভুলভাবে কাটা এবং ঠিক করার জন্য 'আণবিক কাঁচি' বলা হয়। সিকেল সেলের মতো সাধারণ রোগের জন্য উপলব্ধ চিকিৎসার বিপরীতে, কেজে-র থেরাপিটি ছিল সম্পূর্ণ কাস্টম-বিল্ট বা ব্যক্তিগতভাবে নির্মিত। বিজ্ঞানীরা রাতারাতি তার জিনোম সিকোয়েন্স করে, সেই নির্দিষ্ট মিউটেশনটি সংশোধন করার জন্য একটি বেস-এডিটিং টুল ডিজাইন করেন এবং এটিকে লিপিড ন্যানো পার্টিকেল (ক্ষুদ্র চর্বির কণা)-এর মধ্যে স্থাপন করেন। এই কণাগুলি একটি IV ড্রিপের মাধ্যমে সরাসরি লিভার কোষে জেনেটিক সমাধান পৌঁছে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনও বড় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়নি এবং ফেব্রুয়ারী, মার্চ ও এপ্রিল ২০২৫-এ তিনটি ডোজ নেওয়ার পর কেজে-র মধ্যে কোনও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি। সে এখন আগের চেয়ে বেশি প্রোটিন সহ্য করতে পারছে, স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে এবং বাড়িতে তার শৈশবের সুন্দর আনন্দময় মুহূর্তগুলি উপভোগ করছে।
কেজে-র এই চিকিৎসাপদ্ধতি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ দ্বারা সমর্থিত এবং FDA দ্বারা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ফাস্ট-ট্র্যাক অনুমোদন পেয়েছে। চিকিৎসকদলের একজন প্রধান ড. রেবেকা আহরেন্স-নিকলাস বলেন,
বছরের পর বছর ধরে অনেকের সহযোগিতার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমরা আশা করি কেজে অনেকের মধ্যে প্রথম হবে।
চিকিৎসকেরা এই চিকিৎসাপদ্ধতিকে গেম-চেঞ্জার হিসাবে দেখছেন, যেখানে 'N-of-1' থেরাপি (একজনের জন্য ডিজাইন করা) লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাঁচাতে পারে। CRISPR-এর কম খরচ এবং অভিযোজন ক্ষমতার কারণে বিশেষজ্ঞরা এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন যেখানে মেটাবলিক ডিসঅর্ডার থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত সবকিছুর জন্য কাস্টম সমাধান তৈরি করা সম্ভব হবে, যা চিকিৎসার গড় পরিধিকে অনেক কমিয়ে আনবে।
আরও পড়ুন-
একটি তারার দু-বার মৃত্যু! বিজ্ঞানীদের পাওয়া নতুন তথ্য কী বলছে?
তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, যদি চিকিৎসাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং অনিচ্ছাকৃত মিউটেশন ঘটায়, তাহলে তা রোগীর শরীরে আজীবনের স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মেও তা স্থানান্তরিত হতে পারে। কেজে-র চিকিৎসাটি ছিল সোম্যাটিক, অর্থাৎ এটি কেবল তার লিভার কোষকে প্রভাবিত করেছে, প্রজনন কোষকে নয়। কিন্তু CRISPR প্রায়শই জার্মলাইন এডিটিং-এর দিকে মোড় নেয়, যেখানে পরিবর্তনগুলি উত্তরাধিকারসূত্রে স্থানান্তরিত হতে পারে, যা 'ডিজাইনার বেবি' এবং ইউজেনিক্স (প্রজনন-শাস্ত্র)-এর মতো ভয়াবহ আশঙ্কা তৈরি করে।

Whatsapp
