কীভাবে গৃহপালিত গাধা বদলে দিয়েছিল সভ্যতার ইতিহাস, বিবর্তনের এই কাহিনি আজও অজানা
Evolution of Donkey: অ্যাস (Ass) এবং ডাঙ্কি (Donkey) দু’টিকেই বাংলায় গাধা বলে ডাকলেও, এদের প্রজাতি কিন্তু ভিন্ন।
সভ্যতার ইতিহাসে প্রাণীদের গৃহপালিতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গরু, ছাগল, ভেড়া, এবং শূকরকে গৃহপালিতকরণ করা শুরু হয় দশ থেকে এগারো হাজার বছর আগে। কারণ সেই সময় প্রয়োজন ছিল মাংসের। তারও বছর পাঁচেক পরে যখন ভারি জিনিস, পণ্য এবং বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এক থেকে আরেক গ্রামে বা আরেক শহরে বয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু হল তখন ঘোড়া, গাধা এবং উটের মতো প্রাণীকে গৃহপালিতকরণের প্রয়োজন পড়ল। সভ্যতার বিকাশে ঘোড়া এবং উটের গুরুত্ব বারেবারে উঠে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু গাধা (Donkey, Equus asinus), যাকে অধিকাংশ মানুষ রীতিমতো হাসির পাত্র হিসেবেi দেখে, সেই গোবেচারা প্রাণীটিও আফ্রিকা থেকে ইওরোপ এবং সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার বেড়ে ওঠা ও নগরপত্তনে সাহায্য করেছে। অথচ সে কথা নিয়ে বিশেষ আলোচনা শোনা যায় না।
পিটার মিশেল তাঁর লেখা ‘দ্য ডাঙ্কি ইন হিউম্যান হিস্ট্রি: অ্যান আর্কিওলজিক্যাল পার্সপেক্টিভ’ বইতে জানাচ্ছেন, গাধারাই (Donkey) প্রথম প্রাণী যাদের চাকাওয়ালা যান টানার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল এবং গাধাদের টানা যানই চড়া হতো একদম শুরুর দিকে। সিরিয়ার ব্রোঞ্জ় যুগের একটি শহর থেকে উদ্ধার হওয়া কিউনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে জানা যাচ্ছে, সেই সময় রাজাদের চড়ার জন্য গাধায় টানা গাড়িই উপযুক্ত বলে মনে করা হতো। অনেকে মনে করেন যিশুও নাকি জেরুজা়লেমে প্রবেশ করেন গাধার পিঠে চড়েই, বলছেন সেন্ট হিউ কলেজের অধ্যাপক পিটার মিশেল। ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সেনারাও নির্ভর করত গাধার উপরেই।
Wild Ass-কে পোষ মানিয়ে, তাদের গৃহপালিতকরণ যখন হচ্ছে, তারাই তখন ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে পরিণত হচ্ছে Donkey-তে। এখানে উল্লেখ্য, অ্যাস (Ass) এবং ডাঙ্কি (Donkey) দু’টিকেই বাংলায় গাধা বলে ডাকলেও, এদের প্রজাতি কিন্তু ভিন্ন। আর সেই জন্যই যাতে পাঠকের বুঝতে অসুবিধে না হয়, আমরা গাধা শব্দটি ব্যবহার না করে অ্যাস (Ass) এবং ডাঙ্কি (Donkey) শব্দ দু’টি ব্যবহার করব।
২০০৪ সালের একটি গবেষণা জানিয়েছিল, খুব সম্ভবত সভ্যতার ইতিহাসে Donkey-দেরকে দুইবার গৃহপালিতকরণ করা হয়। একপ্রকার Donkey-এর উদ্ভব ঘটেছে ন্যুবিয়ান ওয়াইল্ড অ্যাসের (Equus asinus africanus) থেকে। দ্বিতীয় প্রকার Donkey বিবর্তিত হয়েছে Somalian Wild Ass (Equus asinus somaliensis ass)-এর থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা ওলট-পালট করে দিল আগের সমস্ত গবেষণা। নতুন গবেষণা বলছে, Donkey-কে মাত্র একবারই গৃহপালিতকরণ করা হয়। আর সেই প্রক্রিয়া শুরু হয় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই। আর সেই তখন থেকেই বনের পরিবেশ ছেড়ে, তাদের (Wild Ass) গৃহপালিতকরণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে Donkey-তে পরিণত হওয়ার ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে তাদের জিনেই।
কেনিয়ার এবং হর্ন অফ অফ্রিকার পশুপালকরাই শুরু করে donkey-র গৃহপালিতকরণ। তার পরেই Donkey-রা ইউরেশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে তারা ছড়িয়ে পড়ে মিশর এবং সুদানের বিভিন্ন প্রান্তে। আর তার আড়াই হাজার বছরের মধ্যেই ইউরোপ এবং ইশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
সাধারণত বিবর্তন আসে ধীরে, দীর্ঘ একটা সময় জুড়ে। কিন্তু তারও আগে পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে গেলে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশন। দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবর্তিত পরিবেশে থাকতে থাকতে, অভিযোজনের অনেকগুলি ধাপ পেরোতে পেরোতে একদিন আসে বিবর্তন বা ইভল্যুশন।
জিন বড় জটিল জিনিস। একটি প্রাণীর প্রতিটি অভ্যেস, তার পরিবর্তিত পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ছোট-বড় লড়াই, আর সেই ধাপগুলি পেরিয়ে অবশেষে বিবর্তিত হয়ে নতুন রূপে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতিটি হিসেব, প্রতিটি ইতিহাস জিনে গাঁথা হয়ে যায় কেবল কতগুলি কোডের আকারে। জিনের সৌন্দর্য এখানেই! আজ আমরা যা করছি, আমাদের প্রতিটি অভ্যাস জিনে লেখা হচ্ছে প্রতি নিয়ত। দশ হাজার বছর পরে যদি মানুষ টিকে থাকে, জিনের সেই কোডেই আজকের অভ্যাসগুলো প্রতিফলিত হবে। ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে wild Ass-এর donkey-তে উত্তীর্ণ হওয়া বা বলা ভালো বিবর্তিত হওয়ার ইতিহাসের সাক্ষী তাদের জিনই।
আরও পড়ুন- কান্না বিক্রিই পেশা, উচ্চবর্ণের বঞ্চনায় যেভাবে লেখা হয় রুদালিদের বারোমাস্যা!
পল স্যাবেটিয়ার ইউনিভার্সিটির গবেষক ল্যুডোভিক ওর্ল্যান্ডো সারা পৃথিবীর সাঁইত্রিশটি ল্যাবরেটরির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বর্তমানের ২০৭ টি donkey-র জিন এবং কয়েক হাজার বছরের পুরনো ৩১ টি donkey-র কঙ্কাল থেকে জিন সিকোয়েন্স করে ফেলেছেন। জিন সিকোয়েন্সিংয়ে ধরা পড়ে জিনের কোড- যেখানে লেখা থাকে প্রাণীটির বিবর্তনের ইতিহাস। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের donkey-র জিনের বেশ কিছু অংশ একটি অপরটির থেকে বেশ আলাদা। যেখান থেকে বোঝা যায় কীভাবে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল donkey অর্থাৎ Equus asinus।
পুরনো কঙ্কালগুলির মধ্যে ন’টি উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ভূমি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। যেখানে ২০০ এবং ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও সময়ে রোমানদের বাসভূমি ছিল। জিন সিকোয়েন্সিংয়ের ফলাফল বলছে রোমানরা আফ্রিকান এবং ইউরোপীয়ান donkey-দের মিলন ঘটিয়ে বড় আকারের donkey-র জন্ম দেন, যারা লম্বায় প্রায় ১৫৫ সেন্টিমিটার। ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার জেনেটিকস বিশারদ এমিলি ক্লার্কের মতে, “গাধা (Donkey) অভাবনীয় রকমের কর্মঠ একটি প্রাণী। এবং দীর্ঘকাল ধরে এরা যে ভাবে তিলে তিলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে, তার জন্যে আমাদের এই নিরহঙ্কার প্রাণীটির উপর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।”