ভিন্ন যৌনতার সহজাত একত্রবাস: ঋতুপর্ণের 'বাড়িওয়ালি'
Rituparno Ghosh: এখানে প্রশ্ন জাগে ‘বাড়িওয়ালি’-তে বাড়িওয়ালি কি শুধু বনলতাই? কারণ, ‘বাড়িওয়ালি’ শব্দটির নারীত্বকে ঘিরে আছে ‘বনলতা’ ছাড়াও ওই বাড়িতে বসবাসকারী অন্য দু'টি চরিত্রের জীবন।
এই জীবনটা কার? আমার? কীভাবে? একটা জানালা তার মধ্যে আরেকটা জানালা, তার মধ্যে আরেকটা জানালা, আর তার মধ্যে আরও একটা জানালা। জানালা-জানালা-জানালা।
যত মানুষ আমার জীবনে বাস করছে, প্রকারন্তরে আমিও তো তাদের জীবনে বাস করছি। এভাবেই একে-অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে এই ‘জীবন’ নামক অসীম প্রান্তর। তাই এই জীবনটা আমার একার নয়। আমি এই জীবনের একাকী প্রভু নই। কারণ আমার সঙ্গে সম্পর্কিত বাকি জীবনচরিত্রগুলির ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে আছে আমার নিয়তি!
সিনেমায়, প্রধান চরিত্রগুলির পাশে যারা নীরবে ঘোরাফেরা করে, যাদের সম্পর্কে আমরা ততটুকুই জেনে উঠতে পারি যতটুকু মূল চরিত্রদের পরিণতি ও ঘটনার মনকে দর্শকের সামনে জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন বোধ করেন পরিচালক, সেইসব পার্শ্বচরিত্রদের সম্পর্কে আলাদাভাবে আমার ভাবতে ইচ্ছে করে!
আরও পড়ুন: প্রতিশোধের উত্তাপে সমতার ভূমি খুঁজে চলে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’
আজ এমনই একটি পার্শ্বচরিত্রের কথা বলব। ‘অসুখ’-এর পর, ২০০০ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ তৈরি করেছিলেন ‘বাড়িওয়ালি’ ছবিটি। কয়েকটি জানা তথ্য আরেকবার এখানে মনে করে নেওয়া যাক। ‘বাড়িওয়ালি’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন ঋতুপর্ণ, যা ছবিটি তৈরির অনেক আগেই, পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। একটি পুরনো দিনের বড়ো বাড়িকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মধ্যবয়স্কা নারীর জীবন, তার নিঃসঙ্গতা, পাওয়া এবং না-পাওয়া— এইসব নিয়েই তৈরি হয়ে উঠেছিল ‘বাড়িওয়ালি’।
এখানে মজার বিষয় হল একটি শব্দ: ইচ্ছে। এই ‘ইচ্ছে’ ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনে অগ্নিময় দাপটে ক্রিয়াশীল ছিল। তবে এক্ষেত্রে মজার বিষয় বলছি কেন? কারণ বহু আগে একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষ জানিয়েছিলেন, তাঁর জীবনের ইচ্ছেগুলো যখন দীর্ঘদিন পরিণতি পায় না, তখন তিনি তাঁর সিনেমার চরিত্রদের জীবনে সেই ইচ্ছার পরিণতি দান করেন। তাঁর এই চিন্তার উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি ‘চোখের বালি’-র কথা।
‘উনিশে এপ্রিল’-এর পর থেকেই ‘চোখের বালি’ বানানোর কথা ভাবতেন পরিচালক। ‘অসুখ’ তৈরি হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। সেই সময়ের একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ বলছেন,
‘My next venture is ‘Chokher Bali’… which I am filming.’
অথচ আমরা জানি, ‘চোখের বালি’ তৈরি হয়েছিল এরও চার বছর পর, ২০০৩ সালে। তার মধ্যে ঋতুপর্ণ বানিয়ে ফেলেছেন ‘বাড়িওয়ালি’, ‘উৎসব’, ‘তিতলি’, ‘শুভ মহরৎ’। অর্থাৎ ‘অসুখ’-এর সম সময়ে, সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ যে বলছেন তিনি এখন ‘চোখের বালি’ তৈরি করছেন, তা কোনও না কোনও কারণে তখন হয়ে ওঠেনি।
আবারও দ্বারস্থ হই পরিচালকের উক্ত কথোপকথনটির কাছেই। সেখানে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, যখন দীর্ঘদিন ‘চোখের বালি’ তৈরির ইচ্ছে বিফল হচ্ছে তখন একটা সময় ‘বাড়িওয়ালি’-তে বনলতা-র (কিরণ খের) বাড়িতে শুটিং করতে আসা পরিচালক দীপঙ্কর সেনগুপ্তকে (চিরঞ্জৎ চক্রবর্তী) সেই ইচ্ছেটা নীরবে দিয়ে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। এখানে আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে দীপঙ্কর সেনগুপ্ত যে-ছবিটি তৈরি করতে বনলতা-র বাড়ি এসেছিল, তার নাম ‘চোখের বালি’।
এবার, প্রসঙ্গে ফিরি। কথা শুরু করেছিলাম পার্শ্বচরিত্রদের নিয়ে। ‘বাড়িওয়ালি’-র সম্পর্কে প্রায়শই শোনা যায়, ‘বনলতা’ চরিত্রটির নানা স্তরে কিরণ খের-এর অভিনয় কত নীরব ও সুদূর। এমনকী ‘মালতী’ চরিত্রটি সম্পর্কে প্রশংসাবাক্য এখনও বহমান। কিন্তু আমি মনে করিয়ে দিতে চাই ওই পুরনো বাড়িটির সেই প্রৌঢ় ভৃত্যটির কথা, যার নাম: প্রসন্ন।
ছবিতে, ‘প্রসন্ন’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সূর্য চট্টোপাধ্যায়। কয়েকটি কথা এই চরিত্রটি সম্পর্কে আমাকে বিশেষভাবে ভাবায়। বনলতা-র থেকে বয়সে কিছুটা বড় প্রসন্ন। গ্রাম-মফস্সল বনেদি বাড়িতে, বাড়ির ভৃত্যদের অন্দরমহলে যাতায়াত সাবলীল নয়। কিন্তু ‘বাড়িওয়ালি’-তে আমরা দেখতে পাই বিশাল ও পুরনো বাড়িটিকে আসলে সামলে রেখেছে প্রসন্ন-ই। শুধু তাই নয়, বাড়িটির ভবিষ্যৎ নিয়েও তার চিন্তা সবসময় তৎপর।
এমন তো হতেই পারে। তবে এখানে মনে করতে বলব, ‘প্রসন্ন’ চরিত্রটির অবয়ব বিষয়ে। চরিত্রটির ব্যক্তিত্ব শুধু নমনীয় তাই নয়, তথাকথিত নারীত্বের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়া। এই সূত্রে, ‘বাড়িওয়ালি’ দু'টি দৃশ্য অবাক করে। বনলতা যে লাজুক, তা সম্পূর্ণ ছবি জুড়েই আমরা দেখতে পাই। সেই বনলতার পোশাক পরিবর্তনের সময় অনায়াসেই উপস্থিত থাকে প্রসন্ন। এটা কি বনলতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক? না। কিন্তু প্রসন্ন-র উপস্থিতি বনলতার কাছে স্বাভাবিকের থেকেও হয়তো কিছুটা বেশি।
এর কারণ কি প্রসন্ন-র নারীসুলভ পরিচয়? হয়তো তাই। ‘বাড়িওয়ালি’-তে বনলতার একটি স্বপ্নদৃশ্যে দেখতে পাওয়া যায়, শাঁখ বাজছে, উলু দিচ্ছে এয়োতি-রা। পরনে শাড়ি, গায়ে লাল গামছা, গালে হলুদ— বনলতা জানলা দিয়ে ডেকে বলছে, ‘প্রসন্ন, তাড়াতাড়ি করে কলাপাতাগুলো দাও প্রসন্ন! নীচে ওরা (বরযাত্রী) বসে আছে।’ জানলার নীচে বৃত্তাকারভাবে ঘোমটা দিয়ে কয়েকজন এয়োতি ঘুরছিল। বনলতার ডাকে, তাদের মধ্যে থেকে একজন ঘোমটা তুলে বলল, ‘ওই কলা গাছ তো দেওয়া যাবে না দিদি!’ বনলতা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’ উত্তর এল, ‘ভেলা তৈরি হবে যে। সাপে কাটা মরা তো, কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হবে।’
সেই উত্তরদাত্রী মহিলারূপে আমরা দেখতে পাই প্রসন্নকেই। প্রসন্ন-র মাথায় সিঁদুর, কপালে টিপ, পরনে লাল-রঙা শাড়ি। এখানে, নীরবে ‘প্রসন্ন’ চরিত্রটির ভিন্ন যৌনঅভিমুখকে একটি স্বপ্ন-সংকেতের মধ্যে জাগিয়ে তুললেন ঋতুপর্ণ!
বহু পরে, ২০১১ সালে একটি ইংরেজি সাক্ষাৎকারে আবারও প্রসন্ন চরিত্রটির সমকামিতার দিকটিকে আরও একবার ইঙ্গিত করেছিলেন পরিচালক। ঋতুপর্ণ ঘোষকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল :
Would you like to say something the ‘kinship’ in that household? Banalata lives in this huge crumbling house and she is about to rent a part of it to a film crew for the purposes of shooting a film. Her companions are a cocky young maid and an elderly male servant…
এর উত্তরটি গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুপর্ণ বলেছিলেন,
‘Prasanna is very feminine so it’s like three women of three different ages living in the same house.’
আরও পড়ুন: অনন্ত বিরহের বর্ষায় বৃষ্টি লুকোয় যে ‘রেইনকোট’
এখানে প্রশ্ন জাগে ‘বাড়িওয়ালি’-তে বাড়িওয়ালি কি শুধু বনলতাই? কারণ, ‘বাড়িওয়ালি’ শব্দটির নারীত্বকে ঘিরে আছে ‘বনলতা’ ছাড়াও ওই বাড়িতে বসবাসকারী অন্য দু'টি চরিত্রের জীবন। মালতীর সেই নারীত্বের অধিকার জন্মগত। আর প্রসন্নকে সেই অধিকার দিয়েছে তার ইচ্ছাগত স্বভাব।
প্রসন্নের ছোটবেলা কেমন ছিল? তার জীবনেও কি এসেছিল কেউ? কোনও প্রেম? এই চরিত্রটির পরিণতি কী? এসব কিছুই আমরা জানতে পারি না। কিন্তু দু'জন (বনলতা, মালতী) মূলধারার যৌনতার পাশাপাশি একজন ভিন্ন যৌনতার মানুষের প্রৌঢ়তাময় ভৃত্যজীবন কেমন হতে পারে, তার আঁচ ‘বাড়িওয়ালি’-তে প্রসন্ন দিয়ে যায়। আমরা এটুকু বুঝতে পারি, ছবিতে ওই বিশাল বাড়ির মধ্যে, তিনটি ভিন্ন বয়সের তিনজন নারীর জীবনকে আঁকড়ে-থাকা ‘বাড়িওয়ালি’ কথাটির বিস্তার প্রসন্নকে ছাড়া অসম্পূর্ণ!