কোথায় সেই সংগীতমাধুর্যে ভরপুর লব্জ! দেশজুড়ে ‘অশুদ্ধ’ ভাষাই বলে ফরাসিরা?
French Language: ১৯৫৯ সালে ভাষাবিদ ম্যাক্স রাট 'ফ্রাংলিশ' শব্দটি তৈরি করেন। বাস্তবে ফ্রান্সের চেহারাটাও খানিক এরকম — পাড়ায় পাড়ায় দোকানের নামে আমেরিকান ইংরেজির প্রভাব।
ফ্রান্সে আসার আগে, এক বছর ধরে মন দিয়ে ফরাসি ভাষা শিখেছিলাম। এ বড় কঠিন ভাষা, কঠিন তার উচ্চারণ, আলঙ্কারিক প্রয়োগ, কথার মারপ্যাঁচ। খানিকটা শেখা হলো, ভাবলাম বাকিটা ও দেশে গিয়েই শেখা হবে। এসে দেখি, এ দেশে মানুষ আমার ক্লাসে শেখা ফরাসি ভাষায় কথা বলে না! দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর তুলুজ-এ শিখলাম সকালে খেতে হয় 'শকলাতিন'। তারপর চলে এলাম দক্ষিণের মার্সেই শহরে। সেখানে দোকানে গিয়ে শকলাতিন চাইলে হা-হা হাসি বা মুচকি হাসি হেসে দোকানি বলে, "আমাদের এখানে ওসব নেই, 'পান ও শকলা' আছে।" হুবহু এক দেখতে, একই পেস্ট্রি, দুই জায়গার মানুষ দু'টি শব্দই বোঝে কিন্তু বলবে না! অঞ্চলভেদে লোকের মুখে নতুন শব্দ, নতুন প্রবাদ, হামেশাই শুনতাম। কমবয়সিদের ভাষা একরকম, বয়স্করা অন্য সিনট্যাক্সে কথা বলে। তাদের কথায় প্রবাদবাক্যগুলির রেফারেন্সের সঙ্গে তরুণদের ভাষার রেফারেন্স আলাদা। দু'টিই বুঝতে গেলে গুলে খেতে হবে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ভূ-রাজনীতি।
ফরাসি ঐতিহ্য এবং জাতিগৌরব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ফরাসি ভাষার সঙ্গে। সব দেশেই তাই, তবে এখানে যেন একটু বেশিই। ফ্রান্সের সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা আছে, "প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে ফরাসি"। ফরাসি ভাষাকে সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি বিষয় হিসেবে দেখা হয়। ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ‘অ্যাফেয়ার দ'এতা', অর্থাৎ গুরুতর রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। এ রাষ্ট্রের ভাষাই Organisation Mondiale de la Francophonie-র কেন্দ্রবিন্দু, যা মূলত ফ্রান্সের নিজস্ব সংস্করণে কমনওয়েলথের মতো কাজ করে। অর্থাৎ, ফরাসিই দেশের একমাত্র সরকারি ভাষা, যদিও মূল ভূখণ্ডে প্রায় ৪০টি ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী রয়েছে এবং ফরাসি সমুদ্রপার অঞ্চলসমূহে অন্যান্য অনেক ভাষা প্রচলিত। মূল ভূখণ্ডের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত 'langues régionales' বা আঞ্চলিক ভাষাগুলির মধ্যে রয়েছে আলসেশিয়ান, অক্সিতান এবং ব্রেটন। অক্সিতানেরও বিভিন্ন উপভাষা রয়েছে, যা অনেকেই মনে করেন স্বতন্ত্র ভাষা। কিছু ভাষা ল্যাটিন থেকে বিকশিত হয়েছে, আবার ব্রেটন বা বাস্ক অঞ্চলে কিছু ভাষার উৎপত্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ফ্রান্সে প্রচলিত ল্যাটিন ভাষা দু'টি প্রধান ভাগে বিভক্ত ছিল:
১. Langue d’oïl (উত্তর ফ্রান্সে ব্যবহৃত হ্যাঁ-এর পুরনো রূপ 'oïl'), যা আধুনিক ফরাসির জন্ম দিয়েছে।
২. Langue d’oc (দক্ষিণ ফ্রান্সে ব্যবহৃত 'oc' যার অর্থ হ্যাঁ), যা দক্ষিণের আঞ্চলিক ভাষাগুলির ভিত্তি।
আরও পড়ুন- বইমেলা নিয়ে কোনও আগ্রহই নেই ফরাসিদের
এত সহজ নিয়মে এ ভাষার বিভাজন হলে অর্ধেক মজাই হারিয়ে যেত। বাস্তবে, ফরাসি ভাষার ইতিহাসে ঢুকলে দেখা যাবে এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোমাঞ্চ! উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, উত্তর দর্দনিয়, হোত-ভিয়েন ও কোরেজ-এ প্রচলিত লিমুজাঁ ভাষা, কিন্তু পেরিগু-এ লাঙ্গুয়েদসিয়ান ভাষা প্রচলিত, যা লিমুজাঁ-র থেকে আলাদা।
বিভিন্ন ভাষা এবং উচ্চারণের নকশিকাঁথা ফ্রান্সের জাতিগত বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্রের পরিচায়ক, আঞ্চলিক পরিচয়ের অন্যতম নিদর্শন, দুঃখজনকভাবে, যা বিলুপ্তির পথে। ফরাসি উচ্চারণকে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় উচ্চারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোন উচ্চারণ? কোন ফরাসি? অন্যান্য যে কোনও বড় দেশের মতো ফ্রান্সেও বিভিন্ন অঞ্চলের ভিত্তিতে উচ্চারণের পার্থক্য রয়েছে। এই আঞ্চলিক উচ্চারণ অনেকের কাছে গর্বের বিষয়। সাঁতোঞ্জুয় ভাষার নাটক ও উৎসব হয়, যা বলা হয় রোমানদের ব্যবহৃত ল্যাটিনের সবচেয়ে কাছাকাছি জীবিত ভাষা। কিছু মানুষ গর্ব করে বলেন, তাঁর মিষ্টি বা সুরেলা অ্যাকসেন্ট শুনে তাঁদের সঙ্গীরা প্রেমে পড়েছিল। কেউ বলেন, "আমার যদি অ্যাকসেন্ট থাকে, তোমারও তো অ্যাকসেন্ট আছে, কে কার অ্যাকসেন্ট নিয়ে হাসবে এবার?"
ফরাসি ভাষা মানেই আমাদের মনে সংগীতমাধুর্যে ভরপুর ভাষার শব্দ কানে বাজে, তা মূলত দক্ষিণের অ্যাকসেন্ট। যেমন, এখানে 'vin' ও 'pain'-এর মতো শব্দকে 'veng' ও 'peng' উচ্চারণ করা হয়, যার ফলে কথায় গানের মতো ছন্দ তৈরি হয়। কিন্তু দক্ষিণ ফ্রান্সে কেবল একটিই অ্যাকসেন্ট চালু নয়। অঞ্চলভিত্তিক অ্যাকসেন্টের সংখ্যা দক্ষিণে অনেক। মার্সেই-র রাস্তায় যে সাউন্ডস্কেপ ধরা পড়ে, দেড় ঘণ্টার দূরত্বের শহর মঁপেলিয়ারে মানুষের গলায় অন্য সুর। আরও পশ্চিমে গেলে ভাষার আবহ বদলে যায়। তাহলে যে ফরাসি ভাষা নিয়ে সারা বিশ্বে এত তোলপাড়, এত প্রেম, এত কবিতা, সেটি ঠিক কোন অঞ্চলের অ্যাকসেন্ট?
আরও পড়ুন-রেডিওর সুরে এক হয়ে যায় আজও ফরাসি আর বাঙালিরা?
আঞ্চলিক অ্যাকসেন্ট নিয়ে যতই রোমান্টিসিজম থাকুক না কেন, কখনও কখনও নির্দিষ্ট অ্যাকসেন্টের সামাজিক বোঝা বহন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। উত্তর অঞ্চলের মানুষরা দক্ষিণের অ্যাকসেন্ট নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। দক্ষিণি চাল-চলন কথাবার্তায় গ্রাম্যছাপ, সফিস্টিকেশনের অভাব। এদের কেউ গুরুত্ব দেয় না, যার ফলে চাকরি ক্ষেত্রে বা নতুন কাজের খোঁজে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েও এই অ্যাকসেন্টের ছাপ লোকানোর চেষ্টা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। এখানে উপর মহলের লোকজন— সরকারি কর্মচারী বা রাজনৈতিক নেতা— সবাই প্যারিসের অ্যাকসেন্টে কথা বলে। যে ফরাসি ভাষা আমরা ক্লাসে শিখেছিলাম, সেটি প্যারিসের লব্জ। যেখানে ক্ষমতা, সেখানকার ভাষা সবসময়ই শক্তিশালী। প্যারিসিয় উচ্চারণে কথা বললে, লোকে মনে করে এর শিক্ষা আছে, জ্ঞান আছে। এর কথা একটু মন দিয়ে শোনা উচিত। জোর যার, মুলুক তার, ভাষাও তার। কিছু বছর আগে দেশের এক বামপন্থী নেতা দক্ষিণ ফরাসি সাংবাদিকের অ্যাকসেন্ট নিয়ে কটাক্ষ করেন। এই সাংবাদিকের প্রশ্ন মনমতো না হওয়ায় জঁ-লুক মেলাংশন বলেন, "মাদাম, আপনার প্রশ্নের অর্থ বুঝলাম না। এখানে কেউ আছেন যিনি আমাকে ফরাসি ভাষায় একটা প্রশ্ন করতে পারেন? তাহলে আমি উত্তর দেব।" এই বিস্ফোরক মন্তব্য স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কের সৃষ্টি করে। মেলাংশনের এই দুর্ব্যবহারের ফলে ফ্রান্সে একটি নতুন শব্দ চালু হয়, 'glottophobie'— অর্থাৎ, অন্য ভাষার প্রতি বৈরিতা। ঘটনার পর, ফরাসিভাষী বেলজিয়ান এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁকেও নানা জায়গায় তাঁর বেলজিয়ান-ফরাসি অ্যাকসেন্ট নিয়ে ব্যঙ্গ শুনতে হয়। "Glottophobie-র চক্করে পড়লে ফ্রান্সে 'শুদ্ধ' ফরাসি খুঁজতে গা উজাড় হবে। দেখা যাবে, ‘অশুদ্ধ’ ভাষা বলার অপরাধে গোটা ফ্রান্সকেই জেলে পুরতে হচ্ছে!"
১৫৩৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি ভাষা আইন আদালত ও প্রশাসনের একমাত্র ভাষা হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকরা বলেন, প্রায় ৩৫০ বছর ধরে মানুষ বাড়ি ও গ্রামে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করত কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ফরাসি ব্যবহার করত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফরাসি সেনাবাহিনী আবিষ্কার করেছিল যে, তাদের অনেক সৈন্য ফরাসিতে দেওয়া যুদ্ধের আদেশ ঠিকভাবে বুঝতে পারছিল না। এরপর রাষ্ট্র ফরাসিকে আরও প্রবলভাবে প্রচার করতে শুরু করে। এখনও অনেক বৃদ্ধ মানুষ বলেন, তারা প্রথমবার ফরাসি শিখেছিলেন স্কুলে এবং সেখানে বাড়ির ভাষায় কথা বললে শাস্তি পেতেন। ১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে রেলপথ ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার পর আঞ্চলিক ভাষাগুলির পতন শুরু হয়। সে নিয়ে প্রতিবাদও চলতে থাকে পুরো দমে। ব্রিটানিতে ব্রেটন ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জাতীয়তাবাদীদের অন্যতম আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, তবে দীর্ঘ প্রচারের পরও দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। শেষমেশ সংবিধানে পরিবর্তন এনে ২০০৮ সালে ৭৫ নম্বর অনুচ্ছেদে "আঞ্চলিক ভাষাগুলি ফ্রান্সের ঐতিহ্যের অংশ" লিখে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে, ভাষা সংরক্ষণের জন্য কাজ করা সংগঠনগুলি এখনও যথেষ্ট সরকারি সাহায্য পায় না। ফরাসি ভাষার আধিপত্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও আঞ্চলিক ভাষাগুলি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে নিজের অঞ্চলে।
দেশের ভেতর আঞ্চলিক ভাষাগুলি চেপে প্যারিসিয়ান ফরাসি প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে চাপানউতোর চলছেই। অন্যদিকে বিদেশি ভাষার (পড়ুন, ইংরেজি) প্রভাব থেকে ফরাসিকে বাঁচানোর জন্য চলছে অপরিসীম প্রচেষ্টা (যদিও, কাকে বলব বিদেশি, আর কাকে বলব ফরাসি, কে ভেতর আর কে-ই বা বাহির, এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে)। ভাষাগত গভীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা, ভাষার অবক্ষয় ও পতন নিয়ে আতঙ্ক — এসব লাল মদের মতোই ফরাসিদের একদিন-প্রতিদিন। ফরাসি ভাষার আনুষ্ঠানিক রক্ষক L'académie française মূলত ১৬৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ইতালিয়ান ভাষার প্রভাব রোধ করার জন্য।
আরও পড়ুন-সর্ষের ভিতর ভূত না, সর্ষের মধ্যে সুখ পেয়েছে ভোজনবিলাসী বাঙালি ও ফরাসি
বছর দশেক আগে ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান দৈনিক লিবেরাসিওঁ তাদের প্রথম পাতা সম্পূর্ণ ইংরেজিতে ছাপিয়েছিল। শিরোনাম ছিল, "Let's do it"। সেই পরিপ্রেক্ষিতে The Guardian-এর সাংবাদিক অ্যান্ড্রু গ্যালিক্স লিখেছিলেন, "যেভাবে ব্রিটিশরা পাউন্ড রক্ষা করে, ঠিক সেভাবেই ফরাসিরা তাদের ভাষাকে রক্ষা করে।" ঘটনাটা খতিয়ে দেখলে গ্যালিক্সের মন্তব্যের কারণ বোঝা যাবে।
"Let’s do it"-এর মতো স্লোগান শুনলে মনে হতে পারে কোনও বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞাপন। গল্পটা অন্য।
ফ্রান্সে এক যুগ আগে একটি বিল পেশ করা হয়, যা অনুমোদিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কোর্স ইংরেজিতে পড়ানো যাবে। উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী জেনেভিয়েভ ফিয়োরাসো ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সীমিতসংখ্যক কোর্স ইংরেজিতে পড়ানোর অনুমতি দিতে চেয়েছিলেন। মূল উদ্দেশ্য হলো চিন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশ থেকে পড়ুয়াদের আকৃষ্ট করা। প্রত্যাশিতভাবেই, বিজ্ঞান মহলে এর প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হলেও সাহিত্য মহলে তেমন হয়নি। L'académie française এটিকে 'ভাষাগত বিশ্বাসঘাতকতা' বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। বিশিষ্ট অধ্যাপক অঁতোয়ান কোম্পানিও মনে করেন, এটি শিক্ষার মান কমিয়ে ফেলতে পারে। সাহিত্যিক বার্নার্ড পিভো যুক্তি দেন, "ফরাসি যদি আধুনিক বিশ্বকে বোঝাতে ইংরেজি ধার নেয়, তবে সেটি মৃত ভাষায় পরিণত হবে।" ভাষাবিজ্ঞানী ক্লদ হাগেজ বলেন, "এটি ফ্রান্সের জাতীয় পরিচয়ের জন্য হুমকি।"
লিবেরাসিওঁ-র সম্পাদকীয় বিভাগ ফরাসিদের উদ্দেশে লিখেছিল, "নিজেদের অবরুদ্ধ গলীয় গ্রামের শেষ প্রতিরোধকারী ভাবা বন্ধ করুন!" (এখানে অ্যাস্টেরিক্স ও ওবেলিক্স কমিক্সের প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ tip-of-the-hat লক্ষণীয়)। ফ্রান্স বহু বছর ধরে নিজেকে অ্যাস্টেরিক্সের গ্রামের সাহসী মানুষদের মতো কল্পনা করেছে — ঘিরে ধরা, কিন্তু অবিনত! গ্যালিক্স লিখেছেন, "ফ্রান্স তাদের আমেরিকান ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীত। যদি যুক্তরাষ্ট্র ফরাসি আধিপত্যের অধীনে আসত, তবে সম্ভবত আজ ফরাসি ভাষাই বিশ্বব্যাপী লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হয়ে উঠত। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা।"
আরও পড়ুন-‘ওগো আমার শুয়োর’! ফরাসিদের বিচিত্র ডাকনামের আজব কিসসা
ফরাসি ভাষার পতনের আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে কারণ 'শত্রু' শুধু বাইরে নয়, ভিতরেও। একদিকে ফরাসি ভাষার রক্ষাকর্তারা নিয়মিতভাবে ইংরেজি শব্দের বিকল্প বের করলেও ফ্রান্সে আমেরিকান শব্দ ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ছে। ফরাসিরা অনেক সময় নতুন ইংরেজি শব্দ বানিয়ে ফেলছে। ইংরেজি ভাষার অবাধ নমনীয়তা এবং ডিজিটাল যুগ এই পরিবর্তন দ্রুত সম্ভবপর করে তুলেছে। অপরদিকে, ফরাসি ভাষার কঠোর নিয়ম। ভাষাবিদ সুসান সোনটাগ একবার বলেছিলেন, "ফরাসি এমন একটি ভাষা, যা একটু বাঁকালে ভেঙে যায়।"
অ্যাস্টেরিক্সের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৫৯ সালে। সেই বছরেই ভাষাবিদ ম্যাক্স রাট 'ফ্রাংলিশ' শব্দটি তৈরি করেন। বাস্তবে ফ্রান্সের চেহারাটাও খানিক এরকম — পাড়ায় পাড়ায় দোকানের নামে আমেরিকান ইংরেজির প্রভাব। অল্পবয়সিদের মুখে ফরাসি-ইংরেজি মেশানো ফ্রাংলিশ, যা শুনে আমার (অনভ্যস্ত) কান এবং মস্তিষ্ক অর্থ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গত, কলকাতায় গিয়ে আজকাল বাংলা শুনলেও আমার মস্তিষ্কের একই বিকলাবস্থা হয়। দোকানে, পাবে আমেরিকান পপ গান বাজে, গিটার হাতে সদ্য কলেজমুখী ছাত্রছাত্রীরা শিখছে কেবল ইংরেজি গান। ফরাসি পুরনো গান হাসি তামাশার বিষয়। অবরুদ্ধ গলীয় গ্রাম হয়ে L'académie française-এর নিয়ম মেনে ফরাসি ভাষার গৌরব কতদিন থাকবে, এ নিয়ে হা-হুতাশ শোনা যায় কেবল টেলিভিশনের আলোচনাসভাগুলিতে।
ভাষা একটি জীবন্ত সম্ভাবনা। সে নদীর মতো, হাওয়ার মতো। রূপ আর দিক বদলায় ক্ষণে ক্ষণে। এর কোনও ব্যতিক্রম মানবেতিহাসে ঘটেছে বলে জানা নেই। ভাষার পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তাও যে নিরবধি, তার সরাসরি অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই নতুন দেশে এসে। আজকের লেখায় ফ্রান্সের গল্পের সঙ্গে বাংলা বা বাঙালির সরাসরি কোনও তুলনামূলক আলোচনা রাখলাম না। ইচ্ছে করেই। মিল-অমিল খুঁজে নেওয়ার হোমওয়ার্ক পাঠকের জন্য তোলা থাকল।