মৃত্যুর ৭৪ বছর পরেও বিশ্বের অহিংস রাজনীতির মুখ সেই গান্ধীই
Mahatma Gandhi: বিশ্বজুড়ে নেতারা বারবার অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁর দর্শনে।
মহাত্মা গান্ধীর ১৫৩তম জন্মদিন পেরিয়ে গেল। ঔপনিবেশিক শোষণে জীর্ণ ভারতে মহাত্মা গান্ধী যেন মুক্তির দূত। আজ যখন 'হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী', সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, শোষণ যখন পৃথিবীকে করতলগত করে ফেলেছে- এমন সময়ে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সত্যাগ্রহ, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন যেন আরও সময়োপযোগী হয়ে উঠেছে। কেবল ভারতের রাজনীতিতেই নয়, সারা পৃথিবীর বহু প্রথম সারির নেতা প্রভাবিত হয়েছেন গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনে।
আমেরিকার নাগরিক অধিকার বিষয়ক আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা- বহু নেতাই গান্ধীর রাজনৈতিক মতাদর্শকে গ্রহণ করেছেন। আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে গান্ধীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে শুরু করে তাঁর জীবিত অবস্থাতেই। নাথুরাম গডসের হাতে তাঁর অকালমৃত্যু এবং জীবনের শেষ দিন অবধি হিংসার বিরুদ্ধে অনড় মনোভাব মৃত্যুর পর তাঁর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ধর্মীয় উগ্রপন্থীর হাতে গান্ধীর এই নৃশংস হত্যা দেখে প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ জর্জ বার্নার্ড শ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "গান্ধীর মৃত্যু বুঝিয়ে দিল, ভালো হওয়াও কতখানি বিপজ্জনক।"
'জাতির জনক' মহাত্মা গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবটুকুজুড়েই তিনি অহিংস মতবাদের প্রবক্তা। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরোধিতা থেকে শুরু করে ভারতে ডান্ডি অভিযান, আইন অমান্য আন্দোলন থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন- গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তিই শান্তি ও অহিংসা। আজ গান্ধীর জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক সেইসব বিশ্ব-নেতাদের, যাঁরা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস রাজনৈতিক মতবাদে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন: গান্ধীকে পছন্দ করি না, কেন বলেছিলেন আম্বেদকর?
মার্টিন লুথার কিং
আমেরিকার নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ মার্টিন লুথার কিং ছিলেন গান্ধীর দর্শনের বড় ভক্ত। আততায়ীদের হাতে যখন খুন হন মহাত্মা গান্ধী, তখন মার্টিন লুথারের বয়স মাত্র ১৯। পরবর্তীকালে গান্ধীর বিভিন্ন লেখা পড়ে ও ১৯৫৯ সালে ভারত সফরে এসে গান্ধীর জীবন ও মতাদর্শ সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন মার্টিন লুথার। গান্ধীর অহিংস অসহযোগের রাজনীতি সম্পর্কে বিশদে জানার আগে অবধি আত্মরক্ষার জন্য মার্টিন লুথার সবসময়ই নিজের কাছে অস্ত্র রাখতেন। আমেরিকার নাগরিক আন্দোলনের আরেক নেতা বার্নার্ড রাস্টিনের সৌজন্যেই গান্ধীর মতাদর্শর সঙ্গে লুথার কিং-এর পরিচয় হয়। খ্রিস্টের মতাদর্শের সঙ্গে গান্ধীর অহিংসার নীতির মিলনের পক্ষে সওয়াল করে লুথার কিং লেখেন, "অবদমিত মানুষদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে গান্ধীর মতাদর্শই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।" ১৯৬৪ সালে যখন নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হচ্ছেন মার্টিন লুথার, সেই বক্তৃতায় লুথার বলছেন, "মহাত্মা গান্ধীই প্রথম আমাদের শিখিয়েছেন, কীভাবে বর্ণবৈষম্যর বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হয়। তাঁর এই অদম্য লড়াই তাঁর দেশকে ব্রিটিশদের ২০০ বছরের আর্থিক ও সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে।"
চো মান সিক
কোরিয়ান স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা চো মান সিক তাঁর দেশে কোরিয়ান গান্ধী হিসেবেই পরিচিত। গান্ধীর অহিংস-অসহযোগ এবং স্বদেশি পুঁজির ভাবনায় অনুপ্রাণিত চো মান সিক জাপানি সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে কোরিয়াকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। নিজের রাজনৈতিক গুরু মহাত্মা গান্ধীর মতোই ব্যক্তিগত জীবনে চো মান সিক ছিলেন উকিল। জাপানে পড়াশোনা চলাকালীন গান্ধীর আন্দোলন ও অহিংসার মতাদর্শ তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে।
হো চি মিন
ইতিহাসবিদরা তাঁর ক্ষেত্রে ঠাট্টা করে বলেন তিনি 'আধা লেনিনবাদী-আধা গান্ধীবাদী'। ইতিহাসবিদরা যাই মূল্যায়ন করুন না কেন, তিনি, হো চি মিন, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধর মূল স্থপতি। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে গান্ধীর মতাদর্শর দ্বারা গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত হলেও ভূমি ও আর্থিক সংস্কারের নামে তাঁর অনুগামীদের হিংসার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন ও হতে হয়েছে তাঁকে।
বারাক ওবামা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রতি বারাক ওবামা নিজে ব্যক্তিগত জীবনে বর্ণবৈষম্যর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ভারত সফরে এসে রাজঘাটে গান্ধীর শেষকৃত্যর স্থান পরিদর্শন করেন ওবামা। সেখানকার ভিজিটর্স বুকে লেখেন, "গান্ধীর বিষয়ে মার্টিন লুথার যা বলতেন, তা এত বছর পেরিয়ে এসেও একইরকম সত্যি। গান্ধীর ভাবনা এবং আদর্শ এখনও আমি বর্তমান ভারতের মধ্যে খুঁজে পাই। গান্ধীর অহিংসা ও শান্তির মতাদর্শই যেন পৃথিবীর সমস্ত দেশ ও জাতির কাছে সত্যি হয়ে ওঠে, এটাই আমার একান্ত প্রার্থনা।"
এমনকী, গান্ধী-ভক্ত ওবামা এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, "গান্ধী যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে আমি আমার জীবনের সেই সত্যিকারের গুরুর সঙ্গে একবার নৈশভোজে মিলিত হতাম তাঁর কাছ থেকে রাজনৈতিক দর্শন বোঝার জন্য।"
দলাই লামা
তিব্বত থেকে বিতাড়িত বৌদ্ধ ধর্মগুরু দলাই লামা সেই ১৯৫৯ সাল থেকেই ভারতের বাসিন্দা। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী দলাই লামা মনে করেন, "আমরা বৌদ্ধরা বিশ্বাস করি মানুষের পুনর্জন্ম হয়। আমার ধারণা পূর্বজন্মে কখনও আমার সঙ্গে ভারতের সেই মহান মানুষ গান্ধীর দেখা হয়েছিল।"
বৌদ্ধ ধর্মর অহিংসার আদর্শের সঙ্গে গান্ধীর জীবন ও বিশ্বাস বহুলাংশে মিলে যায়। দলাই লামার মতে যে ব্যক্তি সত্যিই অহিংসার সমর্থক, তিনি অবশ্যই গান্ধীর রাজনৈতিক মত ও পথের একনিষ্ট ভক্ত।
নেলসন ম্যান্ডেলা
মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতেখড়ি নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানকার সাদা চামড়ার মানুষদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গান্ধীই প্রথম সত্যাগ্রহ শুরু করেন। পরবর্তীকালে গান্ধীর অহিংস দর্শনের দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৪৪ সালে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সদস্য হন এবং তারপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে আফ্রিকার অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা শুরু করেন।
১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিরোধিতার জন্য ম্যান্ডেলা এবং তাঁর সঙ্গীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২৭ বছর জেলে কাটিয়ে কারামুক্তির পর ভারতে আসেন ম্যান্ডেলা। তাঁর 'রাজনৈতিক গুরু' মহাত্মা গান্ধীর দেশে এসে তাঁর বিষয়ে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করেন।
আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বহুলভাবেই গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত। তাদের কাজকর্ম, রাজনৈতিক মতামত, বর্ণবাদের বিরোধিতা সবকিছুর নেপথ্যেই আদর্শ হিসেবে থেকে গিয়েছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।