ভয় দেখাচ্ছে গরমের লাল চোখ! যে ভাবে ১০০ বছরে আমূল বদল প্যারিস অলিম্পিকে
Paris Olympics 2024: ১৯২৪ সালের ক্রস কান্ট্রি রেসের দিন প্যারিসের ওই এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। রেকর্ড বলছে, ২০২৪ সালের অলিম্পিক নাকি ভয়ঙ্করতম গরমের সাক্ষী হতে চলেছে।
চাঁদি ফাটানো গরম। আর এ সমস্যা যে কেবল তৃতীয় বিশ্বের, তা নয়। গোটা পৃথিবীই এই মুহূর্তে তাপের রোষে কাঁপছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে যে ভাবে পাল্টে যাচ্ছে জলবায়ু, তা উদ্বেগে ফেলেছে বাঘা বাঘা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের। তবে শুধু যে পরিবেশ বিজ্ঞানীদেরই মাথা ব্যথার কারণ এই গরম তা নয়, গরমের জ্বালায় নাভিশ্বাস উঠেছে প্যারিসের সামার অলিম্পিকেরও।
২০২৪ সালে একশো বছরে পা দিয়েছে প্যারিস সামার অলিম্পিক। তবে দিনকে দিন বাড়তে থাকা গরমের দৌরাত্ম্য কার্যত পাল্টে দিয়েছে সেই অলিম্পিকের ব্যকরণ। ১৯২৪ সালের এক গ্রীষ্মবেলায় শুরু হয়েছিল প্যারিসে এই অলিম্পিক প্রতিযোগিতার। তার পরে গরম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। গত জুন ও জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রত্যক্ষ করেছে একাধিক দেশ। যে ভাবে গরম বাড়ছে, তাতে পৃথিবীর হননকাল আসন্ন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে প্যারিসের এই গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের নাকি জন্মলগ্ন থেকেই সঙ্গী গরম। ১৯২৪ সালের ১২ জুলাই অলিম্পিক গেমসে নেমে প্রচণ্ড গরমে ১০,৬৫০ মিটার কোর্সের ফিনিশ লাইন ছুঁতে পারেননি ক্রস কান্ট্রি রানাররা। ক্রস কান্ট্রি রেস থেকে বাদ পড়েন ২৩ জন প্রতিযোগী। যাঁরা ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে ফেলেছিলেন কোনও মতে, তাঁদের মধ্যে আট জন গরমে জ্ঞান হারান। তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় স্ট্রেচারে করে।
আরও পড়ুন: গত অলিম্পিকে খারাপ হয়ে যায় বন্দুক! প্যারিসে যেভাবে ব্রোঞ্জ জয় মনু ভাকরের
তার পর নরমে-গরমে কেটে গিয়েছে একশোটা বছর। ১৯২৪ সালের ক্রস কান্ট্রি রেসের দিন প্যারিসের ওই এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। রেকর্ড বলছে, ২০২৪ সালের অলিম্পিক নাকি ভয়ঙ্করতম গরমের সাক্ষী হতে চলেছে। এতটাই যে, উদ্বেগ রয়েছে প্রতিযোগীদের স্বাস্থ্য নিয়েও। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক। চলবে জুলাই এবং অগস্ট মাস জুড়ে। এদিকে চলতি বছরকে ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর বলে চিহ্নিত করেছে ইইউ। তাপের কারণে মৃত্যুর হারও গত দুই দশকে বেড়েছে অন্তত এক তৃতীয়াংশ।
চলতি বছর সৌদি আরবে হজ করতে গিয়ে অজস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে গরমে। প্যারিস তুলনামূলক ভাবে ঠান্ডা জায়গা। সেখানে সামান্য গরম বাড়লেই ছটফট করতে থাকেন মানুষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ যে ধরনের গরমে অভ্যস্ত, তার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না এই সব এলাকার। অলিম্পিকের বেশির ভাগ প্রতিযোগিতাই পরিশ্রমের। যেখানে পেশির শ্রম প্রয়োজন হয়। এদিকে অতিরিক্ত ঘাম শরীরে রক্তের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে হৃদপিণ্ডকে রক্ত সঞ্চালনের জন্য দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। ফলে গরম বাড়লে প্রতিযোগীদের স্বাস্থ্য যথেষ্ট সঙ্কটে পড়ে।
১৯২৪ সালের অলিম্পিকের সময়ের আবহাওয়া জলবায়ু ২০২৪ সালে আসতে আসতে নাটকীয় ভাবে বদলেছে। একশো বছর আগে প্যারিস অলিম্পিকের আকার এত বড় ছিল না। ১৭টি খেলায় মোট ১২৬টি ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ২০২৪ সালে ৩২৯টি পদক ইভেন্টে ৩২টি খেলার আয়োজন রয়েছে। ১৯২৪ সালের অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ৩,০৮৯ জন। ২০২৪ সালে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়ে ১০,৫০০ জনে। সেই বছর অলিম্পিক দেখতে জড়ো হয়েছিলেন ৬২৫,০০০ দর্শক। এবার সেই সংখ্যাটা ছাড়িয়েছে ১৫ মিলিয়ন।
সম্প্রতি এই নিয়ে রিংস অফ ফায়ার শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন পোর্টসমাউথ ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিজ্ঞানী এবং তাপ ফিজিওলজিস্টরা। সেই লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯২৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্যারিসের গড় তাপমাত্রা বেড়ে ৩.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দূষণ। ১৯২৪ সালে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা ছিল প্রতি মিলিয়নের প্রায় ৩০৫ ভাগ। এখন সেই মাত্রা ৪০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪১৯ পিপিএম।
স্বাভাবিক ভাবেই সেই উদ্বেগ ছড়িয়ে গিয়েছে প্রতিযোগীদের মধ্যেও। অনেকেই মনে করছেন, প্রচণ্ড গরমে শারীরিক কসরত করতে গিয়ে শরীর শাট ডাউন মোডে চলে যায়। ওই তাপমাত্রায় খেলার জন্য প্রস্তুত করা বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন তাঁরা। যদিও পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আয়োজকরাও নানা কৌশল নিয়েছেন গরম কমানোর। প্রতিযোগিতার সরঞ্জাম হিসেবে এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবস্থা করা, কখনও কখনও দৌড়বিদেরা যে প্ল্যাটফর্মে দৌঁড়বেন, সেগুলিকে ঠান্ডা করা হচ্ছে জল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে।
২০১৬ সালের অলিম্পিকের সময় পেশাদার ট্রায়াথলিট জনি ব্রাউনলির হিট স্ট্রোক হয়। ২০২০ সালেও গরমজনীত অসুস্থতার অন্তত একশোটি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছিল। গত বছর গ্রীষ্মের ভয়াবহ তাপপ্রবাহের সাক্ষী হয়েছিল ইউরোপ। সেই ভয় চোখ রাঙাচ্ছে চলতি বছরের অলিম্পিকের মঞ্চেও। গত গ্রীষ্মে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছুয়েছিল পারদ। এখনও প্যারিস সামার অলিম্পিকের অনেকটা অংশই বাকি। বাদবাকি দিনে গরম আর কতটা বাড়বে, এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হতে পারে আয়োজকদের, তা ভাবাচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।
অনেক খেলোয়ারই এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে কঠোর পরিবেশে প্রশিক্ষণ করেন। বেলজিয়ামের ফিল্ড হকি দল নাকি টোকিও অলিম্পিকের আগে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় প্রশিক্ষণ করত। তবে সেই সুযোগ সকলের যে নেই, সেটাও সত্য কথা। সেক্ষেত্রে আয়োজকরাই খেলার স্থান ঠান্ডা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আবহাওয়াবিদেরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক এল নিনোর জেরে এ বারের গ্রীষ্মটি গত বারের চেয়েও বেশি গরম হতে পারে এই বছরে। এল নিনোর দাপটে গোটা বিশ্বের তাপমাত্রাতেই যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে এবার।
প্যারিসে গরম কোনও নতুন কথা নয়। ২০০৩ সালের অগস্টে তাপপ্রবাহের জেরে ফ্রান্সে ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তার মধ্যে ৭৩৫টি মৃত্যু হয় প্যারিসে। ২০২১ সালের টোকিও অলিম্পিকের পরে সবচেয়ে বেশি উষ্ণতম গ্রীষ্ম হতে চলেছে ২০২৪-এর প্যারিস অলিম্পিক। এমনটাই মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল। এদিকে বাড়তে থাকা তাপমাত্রা বিশেষত ম্য়ারাথন দৌড়বিদদের উপরে বিশেষ প্রভাব ফেলে। ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে বাতাসের তাপমাত্রার ক্ষেত্রে প্রতি ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়লে ম্যারাথন দৌড়বিদদের কর্মক্ষমতা এক মিনিট করে হ্রাস পায়। সাইকেল চালানো বা দৌড়নোর মতো প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আদর্শ তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এদিকে বর্তমানে প্যারিসের তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করছে তিরিশের ঘরে। ফলে ১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড যে প্য়ারিসের অলিম্পিকের সময় স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়, তা কে না জানে। শুধু দৌড়ানোঅ নয়, প্য়াসিভ স্পোর্টিং ইভেন্ট যেগুলি অর্থাৎ তিরন্দাজি বা শুটিংয়ের মতো খেলাগুলোর উপরেও যথেষ্ট প্রভাব পড়তে পারে এই গরমের কারণে।
আরও পড়ুন: জাহাজে চেপে হাজির মশাল! কেন অলিম্পিকের আগুন এত গর্বের?
সতর্কতা হিসেবে ম্যারাথন ও ট্রায়াথলনের মতো ইভেন্টগুলি সকাল আটটার মধ্যে শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের নিয়মিত জল দেওয়ার মতো পদক্ষেপও নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। আয়োজকেরা জানান, তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রির উপরে বাড়লে ট্রায়াথলন স্থগিত রাখা হবে। অলিম্পিকে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর জন্য অলিম্পিক ভিলেজে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট স্থাপন করা হয়নি। তার বদলে অলিম্পিক ভিলেজে জিওথার্মাল সিস্টেম দ্বারা শীতল করার চেষ্টা করা হবে। অলিম্পিক ও প্য়ারা-অলিম্পিক গ্রামগুলিতে ৯ হাজারেরও বেশি গাছ লাগানো হয়েছে। এমনকী প্য়ারিসের বিখ্যাত শ্যেন নদীকে ব্যবহার করেও অলিম্পিক গ্রাম ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকেরা।