নাম শুনলেই জিভে জল, কী ভাবে এল আইসক্রিম...

আইসক্রিমে মন দেয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা – আইসক্রিমেই ভরসা’। আর এর চাহিদা কোনোদিন বাড়বে বই কমবে না।

You Scream! I scream! We all scream for ice cream!

টিং টিং করে ছোট্ট একটা ঘণ্টার শব্দ হয়ে চলেছে একটানা। আর তার সঙ্গে হাঁক, ‘আ – ই – স – ক্রি – ম’। এই হাঁকডাকের সঙ্গে আমাদের ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই ডাক শোনার পরই মায়ের কাছে বায়না শুরু হয়ে যেত আইসক্রিম কিনে খাবার জন্য। নিজের আইসক্রিম শেষ হয়ে যাবার পরেও অন্যের আইসক্রিমে আবার ছোঁ মারার যে আনন্দ তা অতুলনীয়। আইসক্রিম দেখে লোভ সামলানো দায়। ৫-৫০ সকলের কাছে আইসক্রিম লোভনীয় খাদ্য। আইসক্রিমে মন দেয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা – আইসক্রিমেই ভরসা’। আর এর চাহিদা কোনোদিন বাড়বে বই কমবে না।

প্যাচপ্যাচে গরমে আইসক্রিম মুখে দিলে সে যে কি শান্তি তা আর কারে বোঝাই ! যেন স্বর্গের খাবার খাচ্ছি। আইসক্রিমের মধ্যে আছে এক অনবদ্য আকর্ষণীয় ক্ষমতা। তাই ছোট বাচ্চার কান্না থামানো হোক বা গরমে নিজের মনকে শান্ত করতে নয়তো রেগে যাওয়া মনের মানুষকে বাগে আনতে এর থেকে ভালো কিছু আর নেই। কিন্তু এই এত সুন্দর মন মাতানো খাবার এল কোথা থেকে? কার মাথা থেকেই বা এই আইডিয়া বেরিয়েছিল?


আইসক্রিমের আইস-এজ

অতীতে আইসক্রিম ছিল এক বিরল এবং মূল্যবান ডেজার্ট। সাধারণের কাছে এই খাবার ধনীদের মতো সহজলভ্য ছিল না। তাই এই সুস্বাদু খাবারের স্বাদ ধনী ব্যক্তিরাই নিতে পারতেন। আইসক্রিম আসলে কে আবিষ্কার করেছিল তার নাম কেউ জানে না আর তার আবিষ্কারই বা কীভাবে হয়েছিল তা নিয়েও মতভেদ আছে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ শতকে চিনে প্রথম আইসক্রিম তৈরি হয় যখন কিছু মানুষ দুধের সঙ্গে ভাত মিশিয়ে বস্তাবন্দি করে তা বরফের মধ্যে ফেলে রাখে। আবার চিনের রাজা ট্যাং অফ স্যাং দুধ দিয়ে আইসক্রিম তৈরির পদ্ধতি জানতেন। ট্যাং এর নিজস্ব ৯৪ জন লোক মিলে এই খাবার বানাত। এই ডিশ তৈরি করা হত দুধ, ময়দা/আটা এবং কর্পূর মিশিয়ে। তারপর ওই মিক্সচার ধাতব এক বোতলে ভরে বরফের তলায় রেখে দেওয়া হত। এই ডিশ চিনের রাজকন্যারা মজা করে খেতেন। এইভাবেই দুধ দিয়ে আইসক্রিম তৈরির চল প্রথমে চিনেই শুরু হয়।


৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিছু পার্সিয়ান এক অভিনব ঠাণ্ডা পানীয় আবিষ্কার করেন যা গোলাপ জল ও সেমাই দিয়ে তৈরি হয়েছিল। সেই সময় ঐ পানীয় সমাজের অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষকে গরমকালে পরিবেশন করা হত, যাকে আজকের দিনে আমরা ‘ফালুদা’ বলে থাকি। আমরা সকলেই হয়তো জানি যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ফুলের মধুর সঙ্গে বরফ মিশিয়ে খেতে ভালোবাসতেন। আইসক্রিম নিয়ে আরেকটি মিথ প্রচলিত ছিল ৬২ খ্রিস্টাব্দে। রোমের রাজা নিরো ক্লডিয়াস সিজার তার বাবুর্চির কাছে মুখের স্বাদ বদলের জন্য কিছু ভিন্ন ধরণের খাবার খেতে চাইলেন। তার আদেশানুসারে বাবুর্চি এক কর্মচারীকে পাঠালেন অ্যাপেনাইন পাহাড় থেকে কিছু বরফ নিয়ে আসতে। বরফ এলে পরে বাবুর্চি তার সাথে কিছু ফল আর মধু মিশিয়ে রাজাকে পরিবেশন করলেন। রাজা ভয়ে ভয়ে এক চামচ মুখে তুললেন এবং মিনিট খানেক মতো চোখ বন্ধ করে রইলেন। তা দেখে তো রাজার সঙ্গীসাথি সবাই ভয়ে বসে রইলেন। পরক্ষনেই রাজা চোখ খুলে বললেন, ‘ওহ ! কি খাওয়ালে ! কোথা থেকে পেলে এমন মজাদার জিনিস?’ বাবুর্চির রান্না যে হিট হয়েছিল তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। এরপর থেকেই বরফের সাথে ফল আর মধু মেশানো এই খাবার বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।


তবে অনেকের ধারণা আইসক্রিমের ইতিহাস আরও প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের বাজারে বরফ কুচির সাথে মধু আর ফল মিশ্রিত এক খাবার পাওয়া যেত। আবার বাইবেলে আছে রাজা সোলায়মান ফসল কাটার মরশুমে ঠাণ্ডা পানীয় খেতে পছন্দ করতেন।


রোম থেকে এই ঠাণ্ডা পানীয়র জাদু ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এরপর এই এলাহি জিনিস এসে পড়ে বাগদাদের খলিফাদের হাতে। তাদের বাদাম কুচি, পেস্তা, বিভিন্ন শুকনো ফলের জাদুতে এক অন্য মাত্রা প্রায় আইসক্রিম। এই খলিফারাই প্রথম বরফের মিশ্রণে চিনির ব্যবহার শুরু করেন। দশম শতাব্দীর দিকে আরবের প্রধান শহর যেমন বাগদাদ, দামেস্ক এবং কায়রোয় আইসক্রিম ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাদের আইসক্রিমগুলো তৈরি হত বরফ, ক্রিম, বাদাম, দুধ, গোলাপ জল, শুকনো ফল ইত্যাদি দ্বারা। খলিফারাই প্রথম আইসক্রিমের আধুনিক যুগের সূচনা করেন এবং বাণিজ্যিক ভাবে তার প্রসারে সাহায্য করেন।

১০০০ বছর পর ...

বণিক ও পর্যটক মার্কোপোলোর কথা কে না জানে। তাঁর হাত ধরেই চিন থেকে আইসক্রিম তৈরির রেসিপি ইউরোপে প্রবেশ করে। চিনে এই মজাদার খাবার খেয়ে মার্কোপোলোর চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রেসিপি জেনে নিয়েছিলেন তারপর তাঁর সঙ্গে তা ইউরোপে আসে। এই আইসক্রিমের ব্যাপকতা ধীরে ধীরে ইউরোপের উচ্চবিত্ত এবং রাজাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আবার ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নেপলসের ভাইসরয় আন্তোনিও লাতিনি দুধ দিয়ে এক রেসিপি তৈরি করেন যাকে প্রথম অফিশিয়াল আইসক্রিম বলে ধরা হয়।

ভারতে কবে এল আইসক্রিম

১২৬০ সালে ভারতের দিল্লিতে প্রথম আইসক্রিমের চলন শুরু হয়। মোঘল শাসকগন সেই সময় আইসক্রিম খেতেন এবং তাকে বেশ পছন্দও করতেন। তাদের জন্য হিন্দুকুশ পর্বত থেকে ঘোড়ায় করে বরফ আনা হত। সেই বরফ দিয়ে তাদের ও তাদের সঙ্গীদের জন্য তৈরি হত আইসক্রিম।

১৫৩৩ সালে ফ্রান্সে আইসক্রিম আসে। এর পেছনেও আছে এক মজার কাহিনি। ইতালির রাজকন্যা ক্যাথরিন ফ্রান্সের রাজা অরিকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বায়না ধরলেন তাদের বাবুর্চি রগেরিকে সঙ্গে নেবেন কারণ তার কাছে আছে হরেক রকম আইসক্রিম তৈরির রেসিপি। এইভাবেই ফ্রান্সে আইসক্রিম এল।

ইংল্যান্ডেও আইসক্রিম নিয়ে মাতামতি কম হয়নি। রাজা চার্লসের টেবিলে প্রতিদিনই ক্রিম আইস বলে এক খাবার দেখা যেত। তিনি তার বাবুর্চিকে ৫০০ পাউন্ড করে উপহার দিতেন যাতে ইংল্যান্ডে এই আইসক্রিম রেসিপি ছড়িয়ে না পড়ে। প্রথমদিকে কেবল রাজা বাদশা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষের জন্যই এই আইসক্রিম তৈরি হত।


১৬৬০ সালের পর থেকে আইসক্রিম দেশের মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। আমেরিকার হাত ধরে ১৮ শতকে আইসক্রিমের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ফ্লেভারেও চমক আসে। ১৭৬৮-১৭৬৯ সালে প্রথম আইসক্রিমের রেসিপি বুক ‘দ্য আর্ট অফ মেকিং ফ্রোজেন ডেজার্ট’ বের হয়। ১৭৭৭ সালের ১২ মে নিউইয়র্ক গেজেটে আইসক্রিমের প্রথম বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। ১৭৯০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আইসক্রিমের জন্য ২০০ ডলার খরচ করেন। ১৯০০ সাল থেকে আইসক্রিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারা বিশ্বে আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল।


পরবর্তী ইতিহাস

১৯০০ দশকের গোড়ার দিকে বাণিজ্যিক ভাবে রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার এবং কোল্ড স্টোরেজের কারণে আইসক্রিম মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে ধরা দিয়েছে। এখন আইসক্রিম শুধু সমাজের এক স্তরের মানুষের মধ্যে সীমিত নেই আজ আইসক্রিম সকলের জন্য। ১৮৫১ সালের আগে অবধি আইসক্রিমকে এক শিল্প হিসেবে দেখার কথা কেউ ভাবেনি। যিনি আইসক্রিমকে ব্যবসা হিসেবে বেছেছিলেন তিনি হলেন বাল্টিমোরের জ্যাকব ফুসেল। তার হাত ধরেই আইসক্রিমের ব্যবসা শুরু হয়। আইসক্রিমের জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৮৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোল্যান্ড রেগন পুরো জুলাই মাসকেই ‘ন্যাশানাল আইসক্রিম মান্থ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।

 মন খারাপ হোক কিংবা পার্টি বা বন্ধুর সাথে জমিয়ে আড্ডা, খেলা দেখা, সিনেমা দেখা সবেতেই আজ আইসক্রিম চাইই চাই। বলতে গেলে প্রায় সব দেশই এখন নিজস্ব স্বাদের আইসক্রিম ব্র্যান্ডকে আরও সুস্বাদু করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও নানা ধরণের ফ্লেভারের আইসক্রিম পাওয়া যাচ্ছে যেমন - চকোলেট, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, ম্যাঙ্গো, লিচি আরও কত কী। পুরো ভারত জুড়ে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যার আইসক্রিমের নাম শুনেও মুখ ভার হয়ে থাকে। আর চকোলেট আইসক্রিমের সিক্রেট হল খেলেই সকলের মন ভালো হয়ে যায়। ছেলে বুড়ো সকলেই একমত-  "East & West - Ice Cream is Best".

More Articles