কেন ভারতীয় পুরুষরা আক্রান্ত হচ্ছেন স্তনের ক্যান্সারে? কীভাবে বাঁচাবেন নিজেকে?
Male Breast Cancer: পুরুষদের স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করার কোনও উপায় নেই, ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক উপায়েই কমানো যেতে পারে।
ব্রেস্ট ক্যান্সার। সাধারণত মহিলাদের মধ্যেই অতি পরিচিত ধরনের এক ক্যান্সার! তবে পুরুষদের যে এই রোগ থেকে কোনও বিপদ নেই, তা একেবারেই না। মহিলারা এখনও স্তনের ক্যান্সার নিয়ে সচেতন নন। যার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ সমাজলালিত মহিলাসুলভ লজ্জা। স্রেফ সময়ে ধরা না পড়ার কারণে বহু মহিলা স্তন ক্যান্সারে প্রাণও হারিয়েছেন। একই সমাজ পুরুষদেরও লজ্জিত হতে শিখিয়েছে এই রোগ নিয়ে। পুরুষের স্তনের ক্যান্সার শুনে লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই তা প্রকাশ করেন না, যার ফল হয় বিপজ্জনক। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি বলছে, পুরুষদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার বিরল। সমস্ত স্তন ক্যান্সারের ১% এরও কম পুরুষদের মধ্যে ঘটে। তবে ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষদের মধ্যে আক্রমণাত্মক স্তন ক্যান্সারের প্রায় ২,৩৫০ টি নতুন ঘটনা সামনে আসে। আর মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার ইদানিংকালে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা।
পুরুষদের স্তন ক্যান্সার কী?
পুরুষ স্তন ক্যান্সার এমন এক বিরল ক্যান্সার যা পুরুষদের স্তনের টিস্যুতে কোশের বৃদ্ধির ফলে দেখা যায়। মায়ো ক্লিনিকের তথ্য বলছে, সাধারণত বয়স্ক পুরুষদের মধ্যেই এটি ঘটে। তবে যেকোনও বয়সেই এখন এই স্তন ক্যান্সার ঘটতে পারে। বয়ঃসন্ধির সময়, মহিলাদের স্তনের টিস্যু বেশি বৃদ্ধি পায়। পুরুষরা তা পায় না। যেহেতু প্রত্যেকেই দেহেই অল্পবিস্তর পরিমাণে স্তনের টিস্যু থাকেই জন্ম থেকে তাই যে কারও স্তন ক্যান্সার হতে পারে।
পুরুষদের স্তন ক্যান্সার সাধারণত দুই ধরনের হয়: ডাক্টাল কার্সিনোমা এবং লোবুলার কার্সিনোমা। প্রথমটিতে, ক্যান্সার কোশগুলি দুগ্ধনালির মধ্যে শুরু হয় এবং তারপরে স্তনের টিস্যুর অন্যান্য অংশে ওই দুগ্ধনালিগুলির বাইরে বৃদ্ধি পায়। এটি পুরুষের স্তন ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ ধরন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, বুকের দুধ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে এমন গ্রন্থিগুলিতে ক্যান্সার শুরু হয়। এই গ্রন্থিগুলোকে লোবিউল বলা হয়।
আরও পড়ুন- মহিলাদের জন্য কতটা নিরাপদ সারভাইক্যাল ক্যান্সারের টিকা? আতঙ্ক বাড়াবে ভ্যাকসিনের এই রহস্য
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি অনুসারে, এই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের প্রায় ২,৭৯০ টি নতুন ঘটনা ধরা পড়েছে এবং প্রায় ৫৩০ জন পুরুষের স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। তথ্য বলছে, স্তন ক্যান্সার শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের তুলনায় শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে প্রায় ১০০ গুণ কম সাধারণ। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে এটি প্রায় ৭০ গুণ কম সাধারণ।
ভারতে, পুরুষের স্তন ক্যান্সারের ঘটনা ১.০৩% কিন্তু ভারতে তিনটি গবেষণা ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল প্রকাশ করেছে। বেঙ্গালুরুর কিদওয়াই মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট অফ অনকোলজির সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট চিকারাদ্দি এসবির একটি সমীক্ষা বলছে, সমস্ত স্তন ক্যান্সারের হার ০.৪%। রাই বি এট আলের একটি গবেষণা বলছে পুরুষের স্তন ক্যান্সারের ঘটনা ০.৫%। আর কাশ্মীরের শাহ পি এট আল সমীক্ষা বলছে পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের হার ৪.১%।
কোন পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি?
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। দেখা গেছে, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষদের বয়স গড়ে প্রায় ৭২, যে সময়ে তাদের এই ক্যান্সারটি ধরা পড়ছে। যদি কোনও পুরুষ ইস্ট্রোজেন-সম্পর্কিত ওষুধ খান, যেমন প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসায় হরমোন থেরাপির জন্য ব্যবহৃত হয় এই ওষুধ ব্যবহৃত হয়, তাহলে তাঁর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বুকের কাছাকাছি অংশ যদি মাত্রাতিরিক্ত বিকিরণের কাছে বেশিক্ষণ থাকে তাহলে পুরুষের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। স্থূলতার কারণেও পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে কারণ এর ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যায়।
পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের আরেকটি কারণ হল ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম। এই সিন্ড্রোম থাকা পুরুষদের দেহে X ক্রোমোজোমের একাধিক অনুলিপি থাকে। সেভাবেই তাঁদের জন্ম হয়। ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম অণ্ডকোষের বিকাশকে প্রভাবিত করে। এটি শরীরের হরমোনের ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটায়, যা পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
লিভারের সিরোসিসের মতো কিছু ক্ষেত্রে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য ঘেঁটে যায় যার ফলে পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের উপসর্গ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলি মহিলাদের মতোই। বুকের ওই অংশে ব্যথাহীন পিণ্ড, বা বুকের চামড়ায় পরিবর্তন, ফোলাভাব বা ত্বকের রঙের পরিবর্তন হতে পারে। বুকের অংশে ত্বকের লাল হওয়াও পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। কিছুক্ষেত্রে বুক থেকে সামান্য রক্তক্ষরণও হতে পারে।
ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বলছে, বুকে ঘা বা আলসারের পাশাপাশি স্তনবৃন্তের আকার বা চেহারায় পরিবর্তনও এর লক্ষণ। উল্টানো স্তনবৃন্ত বা স্তনবৃন্তে ফুসকুড়িও পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
আরও পড়ুন- দুই স্তন কেটে কলাপাতায় মুড়ে তুলে দিয়েছিলেন হাতে! দলিত নাঙ্গেলি কেন প্রতিবাদেরই ছদ্মনাম?
কীভাবে পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব?
পুরুষদের স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করার কোনও উপায় নেই, ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক উপায়েই কমানো যেতে পারে।
যদি পরিবারে BRCA1 এবং BRCA 2-এর মতো কিছু ডিএনএ পরিবর্তন ঘটে তাহলে সেই পরিবারের পুরুষের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। জেনেটিক পরীক্ষা এবং ব্রেস্ট স্ক্রিনিং করা এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করলেই পরীক্ষা করানো দরকার।
পুরুষদের স্তন ক্যান্সারের প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে অস্ত্রোপচার। সবচেয়ে সাধারণ অস্ত্রোপচার হচ্ছে মডিফায়েড র্যাডিকেল ম্যাস্টেক্টমি। এতে, স্তনবৃন্ত সহ সম্পূর্ণ স্তন এবং কখনও কখনও বুকের নীচের কিছু পেশি এবং বগলের নীচের লিম্ফ নোডগুলি বাদ দেওয়া হয়।
অন্যান্য চিকিত্সার মধ্যে আছে -
রেডিয়েশন থেরাপি: অস্ত্রোপচারের পরে রেডিয়েশন ক্যান্সারের সেই কোশকে মেরে ফেলতে পারে যা অস্ত্রোপচারের সময় দেখা যায় না। টিউমার সঙ্কুচিত করার জন্য অস্ত্রোপচারের আগেও রেডিয়েশন দেওয়া যেতে পারে। কেমোথেরাপির সঙ্গেই রেডিয়েশন দেওয়া যেতে পারে।
কেমোথেরাপি: ক্যান্সারের কোশগুলিকে মেরে ফেলার জন্য অ্যান্টিক্যান্সার ওষুধের ব্যবহার হয় কেমোথেরাপির মাধ্যমে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেমোথেরাপি ক্যান্সারের কোশের বৃদ্ধি বা পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা কমিয়ে দিতে কাজ করে।
হরমোন থেরাপি: ক্যান্সারের চিকিত্সা হিসাবে হরমোন থেরাপির মাধ্যমে হরমোনের কার্যকলাপে বাধা দেওয়া বা হরমোন উত্পাদন বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। হরমোন থেরাপি শুরু হওয়ার আগে, ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর উপস্থিত আছে কিনা তা দেখতে হরমোন রিসেপ্টর পরীক্ষা করেন ডাক্তাররা।
যে পুরুষদের জেনেটিক মিউটেশন আছে, তাদের ৩৫ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করা উচিত। বছরে একবার পরীক্ষা করানো প্রয়োজন আর ৫০ বছর বয়সে গিয়ে একবার ম্যামোগ্রাফি করানোও অত্যন্ত জরুরি।