শান্তিনিকেতনে শুধু ফান্ড বাগিয়ে, এসি গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়ানোই এনজিও-র কাজ!
NGO's in Shantiniketan: এমন অনেক এনজিও আছে যাদের বোলপুর বা শান্তিনিকেতনের ঠিকানা থাকলেও তাদের সেই অর্থে এখানে কোনও অস্তিত্বই নেই। যাকে বলে কাগুজে সংস্থা আর কী!
দেখা গেছে, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কিছু মানুষ সমাজ বিবর্তনের ধারায় পিছিয়ে থাকা, মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিপীড়িত জনসমষ্টির জন্য কিছু উন্নতিসাধন করতে চায়। তা সে একজন স্বতন্ত্র ব্যাক্তিই হোক, কোনও সমষ্টিই হোক বা কোনও সংস্থাই হোক। এখানে যখনই কোনও সংস্থার বা সোসাইটির কথা চলে আসবে অর্থাৎ তার ডাকনাম যদি এনজিও হয় তখন বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট দায়-দায়িত্ব সেই উল্লিখিত সংস্থার ওপর বর্তায়, যা কিনা জনহিতৈষণায় সবিশেষ কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে যেমন পরিবেশ রক্ষার কাজ থাকে, তেমনই শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, গ্রামীণ উন্নয়ন বা এই ধরনের নানা সামাজিক উন্নয়নের কাজ বা সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, উন্নত সমাজের সমর্থনে এই সংস্থাগুলির অভিপ্রায় সর্বদা ক্রিয়াশীল থাকে। এগুলো কোনও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয় না। সামাজিক নানাবিধ উদ্বেগের সমাধান করা বা সেই প্রশ্নে ক্রমাগত কাজ করে যাওয়াই এই সব সংস্থার মূল উদ্দেশ্য এবং যা একটি সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এই কর্মযজ্ঞ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সেল্ফলেস সোশ্যাল সার্ভিস।
তবে সব কি এভাবেই চলে? এর সরাসরি উত্তর হলো, না, চলে না। তার মানে এও বলব না যে, কেউই এই পথে থাকে না। এমন অনেকানেক এনজিও আছে যারা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। আবার কোনও কোনও সংস্থা নানাভাবে এই পদ্ধতির ঢালাও অপব্যবহারও করছে। এনজিওগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি নানা অর্থ অনুদান হিসেবে ব্যবহার হয়। এমনকী চাঁদা ও সদস্যদের থেকেও টাকা নেওয়া হয়। এখন সমস্যা হচ্ছে সেই অর্থের বিলিবন্টন নিয়ে প্রায়শই নানা প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে, এই অনুদান ও সাহায্য কতটা তাদের কার্যক্রমে যথাযথ ব্যবহার হয়?
আরও পড়ুন- মদ, মাংস এবং … হোটেল-রিসর্টময় শান্তিনিকেতন এখন যেখানে দাঁড়িয়ে
এ তো গেল অনুপুঙ্খ ভূমিকা। এই পর্যায় থেকেই এবার ঘুরে দেখব শান্তিনিকেতন। এই অঞ্চলের বিবর্তন ও উন্নয়ন কিংবা বলা যায় নানা ক্ষেত্রের অসামঞ্জস্যে এই ধরনের সংস্থাগুলির ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বোলপুর মহকুমায় সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শো বা তার অধিক এনজিও আছে। সংখ্যায় এত বেশি হওয়ার কারণ স্বভাবতই 'শান্তিনিকেতন'। কেননা এটা যেমন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তেমনই রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীও সারা পৃথিবীতেই সম্যক পরিচিত, সে কারণেও। এর ফলে দেশি ও বিদেশি অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। সেই জন্য এমন অনেক এনজিও আছে যাদের বোলপুর বা শান্তিনিকেতনের ঠিকানা থাকলেও তাদের সেই অর্থে এখানে কোনও অস্তিত্বই নেই। যাকে বলে কাগুজে সংস্থা আর কী! কারও একটা বাড়ি আছে কিন্তু আসা-যাওয়া নেই। কেউ কেউ ঘর ভাড়া নিয়েছে শুধুমাত্র ঠিকানার কারণে, শান্তিনিকেতনের কারণে। ওইটুকুই। তবে আর একটা কারণেও এরা এমনটা করে। তা হলো, বীরভূম অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের সারণি বা সূচিতে আনেকটাই নীচের দিকে। এও এক মস্ত প্রবঞ্চনা।
আসলে, চাইলে অনেক কিছুই করা যায়। সরকার সব কাজ করতে পারে না বা করে না। তার জন্য যে সদিচ্ছা প্রয়োজন তার বিন্দুমাত্র নেই প্রশাসনের। কিন্তু এনজিও-গুলি? তারা শুধু ফান্ড গুটিয়ে এসি গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়াবে? মিথ্যে সাজানো ছবি তুলবে আর মনগড়া রিপোর্ট দেবে ফান্ডিং এজেন্সিকে?
সে এক মারাত্মক মিথ্যার বেসাতি। অথচ চাইলে বা সদিচ্ছা থাকলে এতদঞ্চলে কাজের অভাব নেই। অভাব আর অভাব! প্রান্তিক গ্রামগুলো ধুঁকছে। শিক্ষার আলো নিভু নিভু। আদিবাসীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছে। প্রয়োজনের তুলনায় স্কুলের সংখ্যা যেমন কম তেমনই বছর বছর স্কুলগুলোয় লাফিয়ে লাফিয়ে ছাত্রছাত্রীরা অন্তর্হিত (ড্রপআউট) হচ্ছে। এনজিও সংস্থাগুলোর কি কোনও পর্যবেক্ষণ আছে এই বিষয়ে? এর নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম আছে কিন্তু তা নেহাতই অপ্রতুল।
কেন শিক্ষার এমত হাল বীরভূমে? প্রথমত সরকারের তৈরি বিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষার মাধ্যমে পড়ানোর শিক্ষক নেই। ওদিকে শিক্ষক সংখ্যা এমনিতেই খুবই কম। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, প্রান্তিক সমাজের মানুষজন মনে করছে লেখাপড়া করে কী হবে। চাকরি তো আর পাব না! তার থেকে জমিতে কাজ করলে সংসারে সামান্য হলেও আয় বাড়বে। এখানেই এনজিও সংস্থাগুলি কাজ করতে পারত। এদের মধ্যে শিক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি কাজ, যা করতে পারে এনজিও সংস্থারা। এরপরও দুই একটা সংস্থা আছে যারা লাগাতার পরিশ্রম করে কচিকাঁচাদের লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করছে। এদের অনেকের আবার যথেষ্ট অর্থ নেই, বিদেশের ফান্ড নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। যদি এমন দশটা উদ্যোগ শুরু হয়ে থাকে, অর্থাভাবে এখন সাকুল্যে চার পাঁচটি স্কুল চলছে। তাতে সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
আরও পড়ুন- পর্যটনের বহর প্রবল! তবু ভালো হাসপাতাল, রাস্তা নেই সাধের শান্তিনিকেতনে
এরপরও বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগের কথা বলতেই হয়। মঞ্জুশ্রী সোরেন যেমন দীর্ঘদিন ধরে একটি স্কুল ও আদিবাসীদের জন্য একটি হস্টেল চালাচ্ছেন। শান্তিনিকেতনের প্রখ্যাত রবীন্দ্র অধ্যাপক মার্টিন কেম্পশেন চালাচ্ছেন প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের জন্য একটি স্কুল। এদিকে কলকাতা থেকে এসে শ্যামাশ্রী বোস মজুমদার সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে দু-চারজন সাঁওতাল মেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করছেন বাড়িতে রেখে। কিন্তু ওই যে লিখেছি, প্রয়োজনের তুলনায় তা প্রকৃতই অপ্রতুল।

শ্যামাশ্রী বোস মজুমদার
আরও পড়ুন- বাউল কম, শান্তিনিকেতন দাপাচ্ছে বাবুর বাড়ির ‘ফাউল’-রা
স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা আগেই বলেছি। এনজিও সংস্থাগুলো ইতিউতি রক্তদান শিবির আর এক-আধটা চোখ দেখানোর ব্যবস্থা করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? এই সমগ্র এলাকায় ভরসা শুধুমাত্র বোলপুর আর সিয়ান হাসপাতাল। সে দু'টির অবস্থা নিদারুণ। অত্যন্ত কম সংখ্যক ডাক্তার, যন্ত্রপাতি নেই বললেই চলে। অথচ রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে বা তার পরবর্তীতে ছিল বেশ কিছু ক্লিনিক। সেগুলোর অধিকাংশেরই অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। এক্ষেত্রেও এনজিও সংস্থাগুলোর বিশেষ কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি।
আরেকটি দিক হলো, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে যথাযথ রাখার ব্যবস্থা করা। তার জন্য চাই সচেতনতা ও গাছকাটা প্রতিহত করা। যে কাজ এইসব সংস্থা চাইলেই করতে পারত। নতুন প্রজন্মের আদিবাসীরাও কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াই উচ্চমানের জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে চুরি করে গাছ কেটে দেদার বিক্রি করছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রতিটি নির্বাচনের আগে ঢালাও গাছ কাটে তহবিল গড়তে, পকেট ভর্তি করতে। ফলে এক চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে শান্তিনিকেতনের পরিপার্শ্বের গ্রামগুলোতে। এর কোনও প্রতিকার নেই। বালি চুরি মাটি চুরি তো দৈনন্দিনের ঘটনা।
এত কিছু বলার পরেও বলতে হবে 'আমার কুটির'-এর মতো প্রতিষ্ঠানের কথা। গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের এক গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। সুরুলের জমিদারদের কাছ থেকে বিনা পয়সায় পেয়ে একশো একর জমির ওপর এই আশ্রম গড়ে তোলেন সুষেন মুখোপাধ্যায়। পরবর্তীতে যোগ দেন বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এই আশ্রমে তখন দিনে চাষবাস ও ব্লক প্রিন্টিং ও রাতে দরিদ্র কৃষকদের পড়াশোনা চলত। এই আশ্রম সম্পর্কে লোকমুখে প্রচলিত ছিল যে, এখানে "পাত পাড়লেই ভাত"। একটা সময় ব্রিটিশ সরকার 'আমার কুটির' বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৮ সালে এই আশ্রম সোসাইটি রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আসে। এখন অবধি নানা প্রকল্প নিয়ে দিব্য চলছে। এখানে তাঁত বস্ত্র থেকে চামড়ার সামগ্রী সবই প্রস্তুত করা হয়। বর্তমানে ডিজিটালি স্বাক্ষর করারও উদ্যোগ নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এটা এমন একটি সংস্থা যারা কোনও সরকারি বা বেসরকারি অনুদান নেয় না। সম্পূর্ণত স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি সংস্থা যার ওপর প্রায় দুশোর বেশি পরিবার নির্ভরশীল। তাহলে? চাইলে করা যায়। ওই যে লিখেছি, আসল হলো সদিচ্ছা। এটাই মোদ্দা কথা।