হাজার চেষ্টার পরও হারায় না পথ, কী ভাবে ঘরে ফেরে পরিযায়ী পাখিরা?
Migratory Birds science : পাখিদের শরীরেও একটি 'ঘড়ি' থাকে। এর সাহায্যে তারা বোঝে, বছরের ঠিক কোন সময়ে তাদের উড়ে যেতে হবে।
বাড়ির পেছনে একটা বকুল গাছ আছে। গত তিন দশক জুড়ে প্রতি বসন্তে এক কোকিল দম্পতি সেখানে এসে বাসা বাঁধে। ঠিক ওই গাছটাতেই। এপ্রিলের প্যাচপ্যাচে গরম শুরু হওয়ার আগেই তারা বিদেয় নেয়। কোনো বছর তার হেরফের হয় না। অবাক লাগে, কী ভাবে শয়ে শয়ে পরিযায়ী পাখি হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। তাও এক-দু’বার নয়। বছরের পর বছর।
অনুসন্ধিৎসু মন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে দীর্ঘদিন। বিজ্ঞানও বহুদিন সেই প্রশ্নের স্পষ্ট এবং বিশদ উত্তর পায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের এই ধারণা আগে থেকেই ছিলো, যে পৃথিবীর বুকে হাজার হাজার রাস্তা পাড়ি দেওয়ার সময় পাখিদের যখন দিক নির্ণয় করার প্রয়োজন হয় তখন তারা সূর্য এবং অন্যান্য তারাদের গতিপথ দেখে নিজেদের যাত্রাপথ বুঝতে পারে। তবে তার পাশাপাশি, পাখিদের শরীরে থাকে একটি চৌম্বকীয় কম্পাস। ঠিক যেমনটা থাকে সীমানাহীন সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া নাবিকের। এই চৌম্বকীয় কম্পাসের সাহায্যে পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকে অনুভব করতে পারে। সেই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের শক্তি অনুভব করে পাখিরা বুঝে যায় পৃথিবীর ঠিক কোথায় তারা আছে এবং কোন দিকে তারা উড়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর বুকে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরির কারণ পৃথিবীর কেন্দ্রে থাকা গলিত পদার্থ। কিন্তু সেই চৌম্বকত্ব এতই ক্ষীণ, বাড়ির ফ্রিজের ব্যবহার করা চৌম্বকও তার থেকে দশ থেকে একশো গুণ বেশি শক্তিশালী। এত ক্ষীণ চৌম্বক ক্ষেত্রকে পাখি কী করে অনুভব করে, আর তাতেই ভরসা করে দিক নির্ণয় করে তারা কী ভাবে পাড়ি দেয় দূর দেশে, সেই প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে বহু দিন। প্রায় পাঁচ দশকের বেশি সময় নিয়ে "এভিয়ান ম্যাগনেটোরিসেপশন" নিয়ে কাজও করেছেন দেশ-বিদেশের গবেষকরা (এভিয়ান ম্যাগনেটোরিসেপশন বলতে বোঝায় পাখিরা কী ভাবে চৌম্বকক্ষেত্রকে অনুভব করে)।
আরও পড়ুন : আকাশ থেকে নেমে আসে মৃত পাখির ঝাঁক, আজও রহস্যময় জটিঙ্গা
আমাদের শরীরে যেমন বায়োক্লক কাজ করে - যা আমাদের বুঝিয়ে দেয় কখন দিন হলো, কিংবা কখন সূর্যাস্ত হল - পাখিদের শরীরেও একটি সেরকম ঘড়ি থাকে। এর সাহায্যে তারা বোঝে বছরের ঠিক কোন সময়ে তাদের উড়ে যেতে হবে। কিন্তু যে পাখি প্রথমবার উড়ে দূর দেশে যাচ্ছে, সে কী করে তার নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে যায়? যেখানে তার অভিভাবকরাও উড়ে গিয়েছিলো? আর এখানেই শুরু হয় জিনের খেলা। পৃথিবীর ঠিক কোথায় তারা উড়ে যাবে, তা আগে থেকেই লেখা আছে তাদের জিনে। ধরা যাক, কোনও পাখি সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ভারতে উড়ে আসে প্রতি বছর ডিসেম্বরে। সে ক্ষেত্রে সেই পাখির গতিপথ এবং যাত্রা শুরুর সময়, পুরোটাই লেখা আছে তার জিনে। পাখিটি সাইবেরিয়াতে জন্মে প্রথমবার ভারতে উড়ে এলেও, তার জিনই তাকে বলে দেবে ঠিক কখন তাকে উড়ান শুরু করতে হবে, কোন পথে তাকে আসতে হবে, এবং কোথায় থাকে থামতে হবে।
যে পরিযায়ী পাখির প্রজাতি বংশপরম্পরায় পৃথিবীর দক্ষিণ-পূর্বে উড়ে গেছে, তার জিনে সব কিছু ঠিক থাকলে, সেই প্রজাতির পরবর্তী প্রজন্মও পৃথিবীর দক্ষিণ-পূর্বে উড়ে যাবে। ঠিক একই বিষয় ঘটবে দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়ে যাওয়া পাখিদের সাথে। কিন্তু যদি এই দুই ভিন্ন দিকে উড়ে যাওয়া পাখিদের মিলনে সন্তান জন্ম নেয়, ? সে ক্ষেত্রে সেই সন্তান দক্ষিণ দিকে উড়ে যাবে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের মাঝামাঝি।
পরিযায়ী পাখিদের দেহে অন্তত তিনটি আলাদা আলাদা ধরণের কম্পাস থাকে। এদের মধ্যে একটি কম্পাস আকাশে সূর্যের অবস্থান জানতে সাহায্য করে, একটি কম্পাস আকাশে বিভিন্ন তারাদের অবস্থা জানতে সাহায্য করে, এবং তৃতীয়টি পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র বুঝতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও কোনো জায়গার নির্দিষ্ট গন্ধ অনুভব করেও পাখিরা বুঝতে পারে সেখানে তারা আগে এসেছিল কি-না। চেনা গন্ধই পরিযায়ী পাখিদের বুঝিয়ে দেয়, তারা যে আবার চেনা রাস্তাতেই ফিরে এসেছে।
আরও পড়ুন : শয়ে শয়ে পাখি, হাজার হাজার ডলফিনের মৃত্যু! যুদ্ধের মাশুল যেভাবে গুনতে হচ্ছে ইউক্রেনের প্রাণীদের
১৯৭০ সালে যখন এভিয়ান ম্যাগনেটোরিসেপশন নিয়ে গবেষণা করছিলেন জার্মান গবেষক ক্লস স্কালটেন, তিনি তখনই জানিয়েছিলেন পাখিদের শরীরে কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন হয়, যার ফলে তারা পৃথিবীর অতি ক্ষীণ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকেও অনুভব করতে পারে। তারও দশ বছর আগেকার একটি গবেষণা স্কালটেনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই গবেষণাতেই বলা হয়েছিলো র্যা ডিক্যাল পেয়ার - যা আদতে দুটি রাসায়নিক পদার্থের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা বা কেমিক্যাল ইন্টারমিডিয়েট - তাদের স্থায়িত্ব খুব সাময়িক হলেও তারা ক্ষীণ চৌম্বকীয় শক্তির প্রভাবেও প্রভাবিত হয়। স্কালটেন সেই কথাই মাথায় রেখে বলেছিলেন, পরিযায়ী পাখিদের শরীরেও তাহলে সেরকম কিছুই হচ্ছে।
র্যাডিকেল হল এমন একটি মলিকিউল যারা পার্শ্ববর্তী কোনো মলিকিউল থেকে একটি ইলেক্ট্রন গ্রহণ করেছে, বা একটি ইলেক্ট্রন ত্যাগ করেছে। ফলে তার এখন বিজোড় ইলেক্ট্রন রয়েছে। স্বভাবতই একটি ইলেক্ট্রন সেখানে একা, সঙ্গীহীন অবস্থায় রয়েছে। এই সঙ্গীহীন ইলেক্ট্রনটিকে বলে "স্পিন অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম" বা সংক্ষেপে স্পিন। এই সঙ্গীহীন ইলেক্ট্রনটিকেই চৌম্বকীয় শক্তি প্রভাবিত করতে পারে। এই র্যাডিকেল গুলো আদতে একপ্রকার মাইক্রোস্কোপিক চুম্বকের মতো আচরণ করে।
যখনই কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে দুটি র্যাডিকেল - অর্থাৎ দুটি সঙ্গীহীন ইলেক্ট্রন তৈরি হয় - তারা হয় সমান্তরাল বা প্যারালালি ঘোরে, কিংবা অ্যান্টি প্যারালালি ঘোরে। এদেরকে যথাক্রমে সিঙ্গলেট এবং ট্রিপলেট দশা বলে। যখনই র্যাডিকেল পেয়ার সিঙ্গলেট দশায় থাকে, তখনই চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে তা ট্রিপ্লেট দশায় রূপান্তরিত হবে। আবার ট্রিপ্লেট দশা থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাবে সিঙ্গলেট দশায়। এই রূপান্তর কয়েক সেকেন্ডে কয়েল লক্ষ বার ঘটে পরিযায়ী পাখিদের দেহে। যে রূপান্তরের নেপথ্যে কাজ করে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র।
আরও পড়ুন : পাখির সঙ্গে যুদ্ধ! মেশিনগান ধরা মানুষকে নাকানিচোবানি খাইয়েছিল সেই বিশাল বাহিনী
কিন্তু পাখিদের শরীরে র্যাডিকেল পেয়ার তৈরি হচ্ছে কী ভাবে? সেই উত্তর পাওয়া যায় স্কালটেনের বক্তব্যেরও প্রায় তিন দশক বাদে। গবেষকরা জানান, এ ক্ষেত্রে কাজ করছে ফোটোকেমিস্ট্রি। অর্থাৎ আলোর প্রভাবে ঘটছে রাসায়নিক বিক্রিয়া। তারা ক্রিপ্টোক্রোম নামের একটি প্রোটিন আবিষ্কার করেন, যেটি পাওয়া যায় পাখিদের চোখের রেটিনাতে। মানুষের পক্ষে দৃশ্যমান আলোয় থাকে সাতটি রঙ। যার মধ্যে নীল রঙ একটি। সেই নীল রঙের আলোর থেকে আসা ফোটন কণায় উত্তেজিত হয় ক্রিপ্টোক্রোম।
এই ক্রিপ্টোক্রোম কেবল পাখি-ই নয়, এটি পাওয়া যায় পতঙ্গ, মাছ, উভচর, এমনকী মানুষের শরীরেও। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি গাছপালাও। সূর্যের আলোকে নির্ভর করে গাছের বৃদ্ধি এবং প্রাণীদের "বায়োক্লক", উভয়কে নিয়ন্ত্রণের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই ক্রিপ্টোক্রোম।
সেইরকমই একটি ক্রিপ্টোক্রোম হল ফ্ল্যাভিন অ্যাডেনাইন ডাই-নিউক্লিওটাইড। যা থাকে পাখির চোখে, এবং নীল আলো শোষণ করে উত্তেজিত হয়। পরিযায়ী পাখির দিক নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফ্ল্যাভিন অ্যাডেনাইন ডাই-নিউক্লিওটাইড। ফ্ল্যাভিন অ্যাডেনাইন ডাই-নিউক্লিওটাইড ছাড়াও বিভিন্ন ক্রিপ্টোক্রোম রয়েছে পাখিদের শরীরে। দেখা গেছে তাদের মধ্যে বেশ কিছু ক্রিপ্টোক্রোমের পরিমাণ উড়ানের ঋতুতে পরিযায়ী পাখিদের শরীরে বেড়ে যায়।
যে র্যাডিকেল পেয়ার পৃথিবীর ক্ষীণ চৌম্বক শক্তিতে প্রভাবিত হয়, সে যে রেডিও তরঙ্গেও প্রভাবিত হবে, সে আর অজানা নয়। রেডিও তরঙ্গের পাশাপাশি দোসর হয়েছে দূষণ,পাখি শিকার। ফলে কমছে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। ফি বছর আমাদের বাড়ি ফেরা হোক না হোক, প্রতি বসন্তে বাড়ির পেছনের বকুল গাছে সেই কোকিল দম্পতি ফিরে আসতে ভোলে না। শুধু ভয় লাগে, দূষণ কিংবা রেডিও তরঙ্গের জেরে ওরা পরের বসন্তে বাড়ির পথ ভুলে যাবে না তো?

Whatsapp
