দশবার মুখ্যমন্ত্রীর আসনে! নীতীশ কীভাবে বারবার ফিরে আসেন?
Nitish Kumar 10th term: ৭৪ বছর বয়সি এই নেতা ইতোমধ্যেই বিহারের রাজনীতির সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রীদের একজন। বিভিন্ন মেয়াদ মিলিয়ে তিনি মোট প্রায় ১৯ বছর রাজ্যের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
বিহারের রাজনীতিতে আবারও এক বড় মুহূর্ত। নীতীশ কুমার দশমবারের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। পাটনার ঐতিহাসিক গান্ধী ময়দানে অনুষ্টিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ এনডিএ-র শীর্ষ নেতৃত্বরা। নীতিশ কুমার (Nitish Kumar) বিহারের একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। তিনি প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০০ সালে, কিন্তু স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় আসেন নভেম্বর ২০০৫ থেকে। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম দশক (২০০৫–২০১৫)।
ভারতের দীর্ঘমেয়াদি মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় এখন নীতীশ কুমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম। সিকিমের পবন কুমার চামলিং (২৪ বছর), ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক (২৪ বছর), পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসু (২৩ বছর), অরুণাচলের গেগং অ্যাপাং (২২ বছর— এসব নামের পাশে এখন বিহারের নেতা হিসেবেও আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। বহু রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও নিজের অবস্থান ধরে রাখার ক্ষমতা তাঁকে দীর্ঘস্থায়ী নেতৃত্বের প্রতীক করে তুলেছে। বিহারের আগামী রাজনীতি কোন পথে এগোবে, তার অনেকটাই নির্ভর করছে এই নতুন মন্ত্রিসভার কাজকর্ম ও নীতিনির্ধারণের উপর।
৭৪ বছর বয়সি এই নেতা ইতোমধ্যেই বিহারের রাজনীতির সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রীদের একজন। বিভিন্ন মেয়াদ মিলিয়ে তিনি মোট প্রায় ১৯ বছর রাজ্যের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ২০০০ সালে মাত্র ৮ দিনের জন্য প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। তারপর ২০০৫ থেকে শুরু হওয়া তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবেই চলছে। ২০১৪ সালে একবার তিনি পদত্যাগ করেছিলেন, তবে পরের বছরই আবার ফিরে আসেন ক্ষমতায়। বারবার রাজনৈতিক সমীকরণ বদল করেও তিনি নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বিহারের মুখ্য প্রশাসক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। নতুন সরকারে নীতীশ কুমারের সঙ্গে আরও ২৬ জন মন্ত্রী শপথ নিয়েছেন।
২০১৫ সালে নীতীশ কুমার মহাগঠবন্ধন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। তখন তাঁর জোট ছিল RJD (রাষ্ট্রীয় জনতা দল), কংগ্রেস ও JDU (Janata Dal United)-কে নিয়ে একটি বিরোধী জোট যা বিজেপি-কে হারানোর লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল। তখন ভোটাররা নীতীশকে অস্থির রাজনৈতিক জোটের চেয়ে স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবেই দেখেছিলেন।
আরও পড়ুন
কেন বিহারের ভোটার তালিকায় ‘নিবিড় সংশোধন’ নিয়ে বিতর্ক?
২০১৭ সালে মাত্র দু'বছর পর নীতীশ আচমকাই মহাগঠবন্ধন ভেঙে দেন এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন NDA-র সঙ্গে যুক্ত হন। এই পদক্ষেপটি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বড় কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় জোটের সঙ্গে থাকা প্রয়োজন। যদিও এই পদক্ষেপ ভোটারদের মধ্যে কিছু দ্বিধা সৃষ্টি করেছিল; কারণ বারবার জোট পরিবর্তনকে অনেকেই বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন হিসেবে দেখেছিলেন কিন্তু নীতীশ তাঁর রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকেন।
২০২০ সালে বিধানসভা নির্বাচনে NDA বিজয়ী হয় এবং নীতীশ আবারও মুখ্যমন্ত্রী হন। নীতীশের রাজনৈতিক কৌশলে সফলও হন, নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নেতৃত্বের স্থায়িত্ব। ভোটাররা যদিও তাঁর জোট পরিবর্তনের জন্য কিছুটা সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা তাঁকে সঠিক সময়ে সঠিক জোটের সঙ্গে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল।
২০২৫ সালে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে আবারও NDA বিজয়ী হয় এবং নীতীশ ১০ বারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এই দশকের মধ্যে বারবার জোট পরিবর্তন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ভোটারদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কেউ মনে করেন এটি কৌশলী রাজনৈতিক পরিকল্পনা, কেউ আবার মনে করেন এটি বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জ। তবে ফলাফল দেখিয়েছে যে নীতীশের কৌশল তাঁকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নীতীশের বারবার জোট পরিবর্তন মূলত ক্ষমতা ধরে রাখার একটি কৌশল। কিছু ভোটারের কাছে এটা দ্বিধার কারণ হতে পারে, তবে অনেক ভোটাররা এখনও তাঁকে অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং স্থিতিশীল নেতা মনে করেন। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫-এর দশক নীতীশের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক পরীক্ষা ছিল। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, তিনি দেখিয়েছেন সঠিক কৌশল গ্রহণ, অভিজ্ঞতার ব্যবহার এবং জোটকে দক্ষভাবে পরিচালনা করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব। যদিও বারবার জোট পরিবর্তন কিছু প্রশ্ন তুলে, বাস্তবতা হলো, এই কৌশলই তাঁকে ১০ বারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে সাহায্য করেছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বিহারের ভোটের হাওয়া বদলে দিয়েছে মহিলা ভোটাররাও। মহাগঠবন্ধনের বড় প্রতিশ্রুতির চেয়ে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন নীতীশ কুমারের প্রকল্পকে। বছরের পর বছর নীতীশ মহিলা শিক্ষার সুযোগ, স্বনির্ভরতা ও স্বাস্থ্যখাতের জন্য একাধিক প্রকল্প চালু করেছেন। নবম শ্রেণির মেয়েদের সাইকেল কেনার জন্য আর্থিক সহায়তা, মাধ্যমিকে ভালো ফল করলেই নগদ ১০ টাকা পুরস্কার। গ্রামীণ মহিলাদের স্বনির্ভর করতে স্ব-সহায়ক গোষ্ঠী, প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান।
২০২৫-এর নির্বাচনের আগে ১.২০ কোটি মহিলাকে ১০,০০০ টাকা ‘সিড ক্যাপিটাল’ দেওয়া হয়। এটি আসলে সরকারি ঋণ, তবে অনেকেই নির্বাচনী প্রচারে প্রকাশ্যে বলছেন, “ফিরিয়ে দিতে হবে না।” ফলে মহিলাদের জীবনে সরাসরি আর্থিক স্বস্তি এসেছে। এটি এনডিএ-র পক্ষে সমর্থন জোগাতে বিশাল সুবিধা তৈরি করেছে। এই প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর কার্যকর হওয়ায় মহিলা ভোটারদের আস্থা তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় ‘জীবিকা’ সদস্যরা শুধু উন্নয়নেই নয়, ভোট প্রচারেও সক্রিয়। ফলে ২০২৫ সালের নির্বাচনে মহিলাদের ভোট সরাসরি নীতিশের জয় নিশ্চিত করেছে। তবে বিহারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কিছু উন্নতি হলেও কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের ঘাটতি এখনও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।
আরও পড়ুন
মোদি দিদির মন্ত্রণাদাতা থেকে নিজেই ভোটপ্রার্থী! কেন মিলল না প্রশান্ত কিশোরের অঙ্ক?
বর্ষীয়ান সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল নীতীশ কুমারের দীর্ঘ রাজনৈতিক সাফল্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন, যা তাঁর মতে নীতীশের টিকে থাকার রাজনীতির মূল চাবিকাঠি। জয়ন্ত ঘোষালের মতে, "নীতীশ কুমার ভাগ্যবান একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কারণ তিনি কুর্মী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, বিহারের খুবই ছোট অংশ কুর্মী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি— ৫ শতাংশও নয়।" তাঁর কথায়, "মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে নীতীশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির (OBC) সঙ্গে যুক্ত করেছেন। এই কৌশলই তাঁকে বিশাল সামাজিক সমর্থন এনে দিয়েছে। জঙ্গল রাজের ভয়াবহ স্মৃতি যেখানে মানুষের মনে ছিল, সেখানে নীতীশ উন্নয়নমূলক কাজ ‘পারসেপশন’ তৈরি করতে সক্ষম হন; যা তাঁর রাজনৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে।"
জয়ন্ত ঘোষালেরও বিশ্লেষণে নীতীশের রাজনৈতিক দক্ষতার সবচেয়ে বড় দিক হলো জোট-রাজনীতিতে তাঁর অভূতপূর্ব অভিযোজন ক্ষমতা। অল্প ভোটব্যাঙ্ক থাকা সত্ত্বেও কখনও যাদবদের দল RJD-র সঙ্গে, কখনও আবার বিজেপির সঙ্গে জোট করে তিনি ক্ষমতায় টিকে গিয়েছেন— একে তিনি বলেন নীতীশের “সরভাইভালের রাজনীতি”। আবার বিজেপির সংগঠনক্ষমতা ও আসন সংখ্যা বাড়লেও এনডিএ জোটের মধ্যে এখনও নীতীশ কুমারই অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। জয়ন্ত ঘোষালের মতে, বিজেপিও জানে যে একেবারে সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তি হয়ে বিহার দখল করার অবস্থানে তারা এখনও পৌঁছয়নি। তাই দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে তারা নীতীশকে সামনে রেখেই এগোতে চাইছে।
জয়ন্ত ঘোষাল আরও বলেন, "নীতীশ কুমার এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছেন যে তাঁকে সরালে বরং বিজেপিকেই বিহারে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে— 'একজন বিহারী বাবুকে অপমান করা হচ্ছে'; এই বক্তব্য নিয়ে মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে। আর এই সম্ভাবনাকেই নীতীশ কৌশলে কাজে লাগিয়েছেন।" সব মিলিয়ে, জয়ন্ত ঘোষালের মতে নীতীশ কুমারের সাফল্যের কারণ হলো, ক্ষুদ্র ভোটব্যাঙ্ক থেকে উঠে এসে বৃহত্তর সামাজিক জোট গড়া, OBC ও পিছিয়ে পড়াদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করা, উন্নয়নধর্মী ভাবমূর্তি গড়ে তোলা, জোট রাজনীতিতে অসাধারণ টিকে থাকার দক্ষতা এবং নিজের রাজনৈতিক ‘অপরিহার্যতা’ ধরে রাখা। এই সব কারণেই নীতীশ কুমার আজও বিহারের রাজনীতিতে টিকে আছেন এবং দশমবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পেরেছেন বলে মনে করেন জয়ন্ত ঘোষাল।
প্রসঙ্গত, গত দুই দশকে তিনি দেখিয়েছেন, কখন কোন জোটে থাকা উচিত, কীভাবে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলাতে হয় এবং কীভাবে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় স্থায়িত্ব আনা যায়। এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের ভূমিকাও স্পষ্ট করেছে যে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলা বাস্তব প্রকল্পই ভোটারদের মন জয় করে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয় শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। নীতীশ কুমারের নতুন মন্ত্রিসভা এইসব সমস্যার সমাধান করতে কতটা সক্ষম হবে, তার উপরই নির্ভর করছে বিহারের আগামী দিনের রাজনৈতিক বাস্তবতা। দশমবার শপথ নেওয়া নীতীশ কুমারের সামনে এখন সুযোগ— সমালোচনা পেরিয়ে বিহারকে স্থায়ী উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

Whatsapp
