আরজি কর কাণ্ডে ধৃত সঞ্জয় কীভাবে সিভিক ভলান্টিয়ার হলো? কীভাবে নিয়োগ হয় এদের?

RG Kar Civic Volunteer: হাওড়ার আমতায় আনিস খান হত্যাকাণ্ডেও একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম উঠে এসেছিল।

বর্তমান সরকারের থেকে কর্মসংস্থানের আশা যখন প্রায় করা বন্ধ করে দিচ্ছিল সাধারণ মানুষ, ঠিক সেই সময় রাজ্য জুড়ে নতুন এক 'চাকরি'-র জন্ম হয়। সিভিক ভলান্টিয়ার বলে এক বিশেষ পদে পাড়ায় পাড়ায় চাকরি না পাওয়া অজস্র যুবকের নিয়োগ হতে থাকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সামলানো, পুজোর ভিড় সামলানো, বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা, পুলিশের সহযোগী এই সিভিক ভলান্টিয়াররা কারা? পুলিশের অভাব বা পুলিশের পদে নিয়োগ নেই বলেই কি সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ? কীভাবে নিয়োগ হয়? কোন যোগ্যতা থাকলে একজন চাকরিপ্রার্থী সিভিক ভলান্টিয়ার হতে পারেন? গত ১ দশকে সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভূমিকা ঠিক কী এই রাজ্যে?

বলা বাহুল্য, সিভিক ভলান্টিয়ার বিষয়টি শাসকদল তৃণমূলের আমদানি। ২০১১ সালে বাম শাসনের পতন। ২০১১ সালের আগে, সিপিআইএমের শাসনামলে সিভিক ভলান্টিয়ার বলে কোনও পদ ছিল না। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সিভিক ভলান্টিয়ারদের রমরমা। কেন দরকার পড়ল এই ভলান্টিয়ারদের? ২০০৮ সালে রাজ্যে সিপিআইএমের শাসনে রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘গ্রিন পুলিশ’ নামে একটি বাহিনী তৈরি করেছিল কলকাতা পুরসভা। পরে সারা রাজ্যেই গ্রিন পুলিশেদের দেখা যায়। এর কিছু বছর পর ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। পুলিশে পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় ২০১৩ সালে রাজ্যে ৪০,০০০ পুলিশ এবং ১,৩০,০০০ হাজার ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই মুহূর্তে রাজ্যে সিভিক ভলান্টিয়ার আছেন ১ লাখ ২০ হাজারের কাছাকাছি। প্রথমে ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’ নামে নিয়োগ করা হয় ঠিকই কিন্তু এর বিরোধিতা করেন পুলিশের একাংশ। তাই পুলিশ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার না, এই যুবকেরা শুধুই সিভিক ভলান্টিয়ার।

আরও পড়ুন- সকালে ইস্তফা, বিকেলে নিয়োগ! আরজি করের সন্দীপ ঘোষকে বাঁচাতেই উদ্যোগী সরকার?

কীভাবে এই ভলান্টিয়ার নিয়োগ হয়? কোন পরীক্ষায় পাশ করতে হয়? কী কী যোগ্যতা লাগে? এই সংক্রান্ত কোনও রুলবুক নেই। এই নিয়োগ সম্পূর্ণই শাসনে থাকা তৃণমূল দলটির নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। আর্জি-সুপারিশের ভিত্তিতেই মূলত নিয়োগ। বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল নেতারা তাঁদের পছন্দের এবং অনুগত লোকজনকে চাকরি পাইয়ে দেন। ফলে নেতার এলাকায় দখল বাড়ে, আর নেতাদের ছত্রছায়াতে সিভিক ভলান্টিয়াররা দাপট বাড়ায়। বিরোধীরা বারবার বলে এসেছেন, সিভিক ভলান্টিয়ার আসলে শাসকদলের 'ক্যাডার’। চাকরি পাইয়ে দেওয়া নেতার কথায় এই ভলান্টিয়াররা ওঠবস করতে বাধ্য। তোলাবাজি থেকে শুরু করে নির্বাচনের সময়ে শাসকদলের হয়ে কাউকে শাসানো, চমকানো বিবিধ কাজও এই 'স্বেচ্ছাসেবক'-দের করতে হয় নেতার সেবায়। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের চেয়েও বেশি দাপট এদের।

এই সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। হাওড়ার আমতায় আনিস খান হত্যাকাণ্ডেও একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম উঠে এসেছিল। সেই মামলায় হাইকোর্টে তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল গোপাল মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘রাজ্য জুড়ে সিভিক নিয়োগ বন্ধ রাখা উচিত!’’ আনিসের হত্যা নিয়েও কম আলোড়ন হয়নি। সেসব ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। আনিসের বিচার চেয়ে চেয়ে বামেরাও স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। ঠিক এরপরেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে তরুণী চিকিৎসককে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার হয় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। যে কারণে আবারও সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

মুশকিল হলো, পুলিশও বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে কারণ বাহিনীতে পর্যাপ্ত পুলিশই নেই। তবে শাসকদল বলছে, 'বিক্ষিপ্ত' ঘটনায় সমস্ত সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রতি আঙুল তোলার মানেই নেই। পুলিশের চেয়ে অনেক কম বেতনে কাজ করেন এই সিভিক ভলান্টিয়াররা। সেই তুলনায় পরিষেবার মান ভালোই।

আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ড: ভেতরে অনেকে আছে, মেনে নিলেন মমতাও

প্রথমে বলা হয়েছিল, পুলিশ সংখ্যায় কম। তাই পুলিশদের সাহায্য করতে সিভিক ভলান্টিয়াররা কাজ করবেন। এদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করবে স্বরাষ্ট্র দফতর। ছ’মাস অন্তর নতুন চুক্তি হবে। এই ভলান্টিয়ারদের মূল কাজ হবে, কলকাতার বাইরে বিভিন্ন রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ ও মেলা, উৎসবে ভিড় সামলানো। সরকারি নির্দেশে বলা হয়, জেলা স্তরে কমিটি তৈরি করে ভলান্টিয়ারদের বাছাই করা হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক হলেই চলবে। কিন্তু পরে সেই নিয়ম বদলে যায়। নতুন নিয়মে ২০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে যে কোনও বয়সের যে কোনও মানুষই এখন সিভিক ভলান্টিয়ার পদের জন্য আবেদন করতে পারেন। সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাশ। সেটাও সুপারিশের উপর ভিত্তি করে হয়েই যায়, কেউই খতিয়ে দেখেন না। এরা বেতন পান মাসে ৯ হাজার টাকা।

এবছর লোকসভা ভোটের আগে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দৈনিক মজুরি ৩৪ টাকা করে বাড়ানো হয়। ফলে মাসে প্রায় ১০০০ টাকা বেতন বাড়ে তাঁদের। চাকরি না পাওয়া রাজ্যে, নামে মাত্র বেতনে প্রবল খাটনির মানুষ কম নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বাহিনীকে সরকার যে নিজের অনুগত করে রাখবে তাই স্বাভাবিক। কম বেতনেও পাড়ায় রাজনৈতিক দাদা-দিদির হাত মাথায় নিয়ে ছদ্মক্ষমতা ভোগের বাসনাতেই কি সিভিক ভলান্টিয়ারদের এমন দাপট? আরজি কর কাণ্ডে ধৃতের বিরুদ্ধে আগেও স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। থানায় ডায়েরিও হয়। সেই ব্যক্তিকেই দায়িতে দেওয়া হলো মানুষকে সামলানোর? এর দায় কি সরকারেরও না?

More Articles