ঋতুপর্ণের ‘আবহমান’: শিল্পীর মুহূর্ত, শিল্পের সত্য
Rituparno Ghosh: আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মস্তিকের অন্নজল জোগায় কে? জোগায়, স্মৃতি। ফেলে আসা মুহূর্ত! ‘আবহমান’ জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের কথা বলে।
শঙ্খ ঘোষ ‘জার্নাল’-এ লিখেছিলেন, ‘এই একটি মুহূর্ত চলে গেল, এটা কখনওই ফিরবে না আর, মুহূর্তই মুহূর্তের শেষ।’ এই আচমকা জন্মানো মুহূর্তদের সংগ্রহশালাই তো সিনেমা!
২০১০ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ তৈরি করেছিলেন ‘আবহমান’। পরে এই ছবিটির জন্য ঋতুপর্ণ সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার-ও পান। ছবিটির নামকরণ বিষয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ-কে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, উনি বলেছিলেন আবহমান কাল ধরে চলে আসা মানুষের বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যেকার চিরন্তন কিছু সত্য নিয়ে তৈরি হয়েছে এই ছবি।
এখন প্রশ্ন জাগে, শুধু কি তাই? আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মস্তিকের অন্নজল জোগায় কে? জোগায়, স্মৃতি। ফেলে আসা মুহূর্ত! ‘আবহমান’ জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের কথা বলে। পাশাপাশি, ‘মুহূর্ত’ শব্দটিকে সঞ্চয় করে পৌঁছে যায় সিনেমার অন্তর্বর্তী চিরকালীন কতগুলি সত্যের দিকেও।
যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন ‘আবহমান’-এর প্রধানত চারটি চরিত্র। অনিকেত মজুমদার, পরিচালক। অভিনয় করেছিলেন দীপঙ্কর দে। অনিকেতের স্ত্রী, অভিনয়ে মমতাশঙ্কর। অনিকেতের ছেলে অপ্রতিম, অভিনয় করেছিলেন যীশু সেনগুপ্ত। এবং অনিকেতের ছবির নায়িকা শিখা। অনেকেই হয়তো জানবেন এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অনন্যা চট্টোপাধ্যায় সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিয়ে যায় যে ছবির মুহূর্তরা
প্রসঙ্গে ফিরি। ছবিতে দেখা যায়, অনিকেত অসুস্থ। পাহাড়ে বিশ্রামের জন্য এসেছে। সঙ্গে রয়েছে তার ছেলে অপ্রতিম। অপ্রতিম নিজেও সিনেমা বানায়। ‘আবহমান’-এর প্রথম দৃশ্যে অনিকেত অপ্রতিমকে জিজ্ঞেস করে, ফিল্ম-এ ‘ল্যাটিচিউড’ কথাটির অর্থ কী? অপ্রতিম চুপ করে থাকে। অনিকেত বলে, ‘রেঞ্জ, স্কোপ, টলারেন্স!’ এরপরই দু'জনের কথোপকথনের মধ্যে ঋতুপর্ণ ডেকে আনেন একজন পরিচালকের অন্তরের শিল্পভাবনাকে:
অনিকেত।। তুমি তো ভিডিও-তে কাজ করেছ!
অপ্রতিম।। সেলুলারি ল্যাটিচিউড ভিডিও-র থেকে অনেক বেশি বাবা।
অনিকেত।। ভিডিও-তে ইরেজ করে আবার যখন রেকর্ড করো, সেটা বোঝা যায়?
অপ্রতিম।। তুমি কি ভিডিও-তে কাজ করার কথা ভাবছ? তোমার ভালো লাগবে না বাবা। সেই ডেনসিটি পাবে না। টোন পাবে না। তাছাড়া ফিল্ম-এর লংজিবিটি অনেক বেশি।
অনিকেত।। তাতে লাভ? ক-দিন পর দেখলে সব কাজটাই মনে হয় কিচ্ছু হয়নি। তোমার মনে হয় না?
অপ্রতিম।। এটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলব!
অনিকেত।। বরং এটাই তো ভালো। শুট করলে, ইরেজ করলে, আবার শুট করলে, আবার ইরেজ করলে। পছন্দ হল না, নতুন করে এডিট করলে। আবার ইরেজ করে দিলে। যে-কোনও মোমেন্ট-এ আবার নতুন করে শুরু করা যায়।
নিরন্তর গ্রহণ আর বর্জন, শুট করা আর ইরেজ করে দেওয়া— এখানেই প্রধান হয়ে দেখা দেয় একজন স্রষ্টার মন। চলচ্চিত্র তো আসলে আমাদের জীবনেরই সংরূপ। আর জীবন পরিবর্তনশীল। মন? হ্যাঁ মনের অবস্থাও পালটাতে থাকে। কিন্তু এই নিরন্তর গ্রহণ আর বর্জনের মধ্যেকার মূল উপকরণ হিসেবে উপস্থিত থাকে ‘মুহূর্ত’ শব্দটিই।
সংলাপে, অনিকেতের বলা কথাগুলির আরও একটি আশ্চর্য বিস্তার দেখতে পাই ‘আবহমান’-এর অন্য একটি দৃশ্যে। অনিকেত ও তার ছবির অভিনেত্রী শিখা, দু'জনের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে ফিল্ম ম্যাগাজিনে অপ্রতিম একটি লেখা লেখে। পরবর্তী সময় অপ্রতিমের মনে হয় বিষয়টিকে নিয়ে ছবি করা যায়। এ-সম্পর্কে অনিকেত ও অপ্রতিমের মধ্যে কথাও হয়। দু'জনের সেই কথোপকথনের অংশ এখানে তুলে দিতে চাইব:
অনিকেত।। তোমার ছবিতে আমাকে নেবে?
অপ্রতিম।। তুমি নিজে পার্ট করো না বাবা। তুমি হলে মানাতো। কিন্তু তুমি নিজে করো না।
অনিকেত।। না। তোমার সঙ্গে আমিও বানাব। একটু তুমি বানালে। একটু আমি বানালাম। তারপর আবার তুমি বানালে। আবার আমি বানালাম।
অপ্রতিম।। তাহলে তো মা শুড অলসো মেক দ্য ফিল্ম উইথ আস।
অনিকেত।। হ্যাঁ, বানাবে। তোমার মা একটু বানাবে, আমার মা একটু বানাবে। তারপর ধরো, শিখা একটু বানাল। ওর বোন, লেখা একটু বানাল।
অপ্রতিম।। তাহলে আর শেষ হয়েছে ছবি!
অনিকেত।। শেষ করতে হবে কে বলেছে?
অনিকেত-অপ্রতিম সম্পর্কে পিতা-পুত্র। কিন্তু এখানে তাদের সেই সম্পর্ককে ছাপিয়ে কথা বলে চলেছে দু-জনের পরিচালক-সত্তা। ঠিক যেমন, ‘ঋতুপর্ণ নির্জন সিনেমন’-এর আগের লেখাটিতে আমরা দেখেছিলাম ‘দ্য লাস্ট লিয়র’-এ অমিতাভ বচ্চন আর অর্জুন রামপাল-এর প্রথম কথোপকথনটি দু-জনের অস্তিত্বকে ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল থিয়েটার আর সিনেমার কথোপকথনে। ‘আবহমান’-এও ঠিক তেমনটাই ঘটেছে। এবং প্রধানত অনিকেতের সংলাপের মধ্যে দিয়ে সিনেমা বানানোর রীতিপদ্ধতির ঊর্ধ্বে এখানে দেখা দিয়েছে তার শিল্পমনের স্বাধীনতা! এমন একটি ছবি তৈরি করার কথা বলছে অনিকেত যা একইসঙ্গে অনেকে মিলে বানাবে। অপ্রতিম বানাবে। অনিকেত বানাবে। অনিকেতের স্ত্রী বানাবে। বানাবে তাঁর মা। শিখা, শিখার বোন— সবাই মিলে বানাবে!
এমন কি সত্যি হতে পারে? না। আমরা জানি, যে-কোনও শিল্পনির্মাণের নিজস্ব কিছু কারুপ্রক্রিয়া থাকে, যা শিক্ষা করতে হয়। বাকিদের কথা যদি ছেড়েও দিই, ছবিটি দেখলেই বোঝা যায় অনিকেতের মা কিংবা শিখার বোন, এদের পক্ষে বাস্তবে কোনওদিনই ছবি বানানো সম্ভব নয়। তাহলে এমন কথা কেন বলছে অনিকেত? উত্তর: জীবন। আমি যে-জীবনের ভিতর বাস করি তা কি কেবল আমার একার? আমার চারপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও তো আমার জীবনের অংশ। আমিও অংশ অন্যদের জীবনের। আমার নিজস্ব মুহূর্ত তাই ছুঁয়ে আছে অন্যের নিজস্বতাকে। এমনভাবেই অনেকের ভূমিকায় গড়ে ওঠে আমাদের জন্মের ধারণা। তাই অনিকেতের বলা কথাগুলির সামনে দাঁড়ালে মনে হয় আমাদের সকলের জীবনই আসলে এক চলমান চলচ্চিত্র।
আরও পড়ুন:ভিন্ন যৌনতার সহজাত একত্রবাস: ঋতুপর্ণের ‘বাড়িওয়ালি’
‘আবহমান’-এর শুরুতেই অনিকেত প্রশ্ন করেছিল, ‘ওয়াট ইজ আ ফিল্ম অল অ্যাবাউট?’ সম্পূর্ণ ছবিটি দেখার পর আমরা আবারও মুখমুখি হই ‘আবহমান’-এর সূচনাদৃশ্যের এই একই প্রশ্নের সামনে। প্রথমে প্রশ্নটি ছিল শুধুই একটি জিজ্ঞাসামাত্র। কিন্তু ছবির শেষে যখন আমরা প্রশ্নটির কাছে ফিরে আসি, তখন আমাদের মনে যুক্ত হয়ে তাকে সম্পূর্ণ ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা। সিনেমা আসলে কী— অপ্রতিম উত্তর দেয়, ‘মোমেন্টস্… মে বি!’। মোমেন্টস অর্থাৎ মুহূর্ত! আমাদের বেঁচে থাকার খণ্ড খণ্ড মুহূর্ত সব! এবং এরপরই অনিকেত বলে, ‘আমরা সব ফ্লিটিং মোমেন্টস্-কে ধরে ফেলি, বলি ক্যাপচার, নট ফেয়ার!’। ঠিক এখানেই ‘ওয়াট ইজ আ ফিল্ম অল অ্যাবাউট?’ প্রশ্নটি যেন খুঁজে পায় ছবিতে অনিকেতের জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিজের সম্পূর্ণকে। আমরা বুঝতে পারি এ হল একজন স্রষ্টার চিন্তার স্বরূপ।
ঋতুপর্ণ ঘোষের শেষের দিকের ছবিগুলির এই এক মজা। আমি এখুনই অন্তত চারটি ছবির নাম বলতে পারি, যেমন ‘দ্য লাস্ট লিয়র’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’, ‘আবহমান’ এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’। এই সব ক’টি ছবির প্রধান চরিত্র একজন আর্টিস্ট। এই চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে ঋতুপর্ণ প্রায়শই নিজের শিল্পচিন্তার ও তার বিচিত্র সব ক্রাইসিসকে বলে গেছেন। ‘আবহমান’ তার মধ্যে প্রধানতম!