কলকাতার হস্তশিল্প মেলার মুখ চেয়ে বাঁচেন না বাংলার কারিগরেরা

Handicraft Artists of Bengal : কলকাতার হস্তশিল্পের বড় মেলায় আসা কারিগরেরা রোজের হিসেবে আজও মাত্র ৭৫ টাকা পান।

N

বছর এগারো আগে, ২০১৩-র প্রথম দিকে কারিগর সংগঠনের যেসব সদস্য ভদ্রবিত্তের যাপন সাপেক্ষ পণ্য বানাই, সাধারণত গ্রামীণ হাটের বেচা কেনায় খুব বেশি অংশ নিই না (যেমন মালদার বাঁশের কাজ করা মাহালি সম্প্রদায়, দুই দিনাজপুরের মুখা-বাঁশের কারিগর, জলপাইগুড়ি-কোচবিহারের বেতের কারিগর, কোচবিহারের পাটি কারিগর, কুনোরের রাজবংশী মাটির কারিগর), দক্ষিণ দিনাজপুরের মুস্কিপুরে প্রয়াত সম্পাদক মধুমঙ্গল মালাকারের বাড়ি-আপিসে একজোট হয়ে ভাবছিলাম, আবার হাটে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আমাদের সামনে খোলা আছে কি না। ২০০৮-এর দীর্ঘ অর্থনৈতিক মহামন্দার যুগ সবে পেরিয়েছি, ডিজিটাল ব্যবস্থা চেপে বসতে অনেকটা দেরি। কারিগর সংগঠনের সদস্যদের মনে হচ্ছিল, শহুরে কর্পোরেট বাজারের পাশাপাশি আমরা যারা নিয়মিত স্থানীয় বাজারে থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা তাদের স্থানীয় বাজারেও জুড়ে থাকতে পারি কি না। দেড় দিনের আলোচনায় ঠিক হলো, আরও বড় ভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে আলোচনায় যাওয়ার আগে ইটাহার-ফতেপুর, কালিয়াগঞ্জ-গাজোল রাস্তার ফতেপুর মোড়ের আড়াই কিমি দূরে ফতেপুর কাছে ৯০ বিঘার চান্দোল হাটে কারিগরেরা ৭ দিনের মেলা আয়োজন করবেন হাটুরেদের সঙ্গে মিলে। হাটুরে কারিগরের যৌথ মেলায় কী ধরনের অভিজ্ঞতা হলো, সুযোগ পেলে সে রোচক আলাপ অন্যদিন হবে। কিন্তু ৭ দিনের মেলায়-হাটে সারা বাংলা থেকে আসা কারিগররা রাত-দিন থেকে বুঝলাম অন্তত ৪০ শতাংশ নিয়মিত, আরও ৩০-৪০ শতাংশ ‘ডিজাইনারদের থেকে শিক্ষা পাওয়া’ কারিগরই হয় অন্য পণ্য নিয়ে হাটে যান, না হয় স্থানীয় বাজারের সঙ্গে নিত্য জুড়ে থাকেন – জীবিকা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ স্থানীয় বাজার থেকেই অর্জন করেন। বাকিরা স্থানীয় বাজারের সঙ্গে আছেন ঠিকই, তবে তাঁদের জীবনে স্থানীয় হাট বা বাজার খুব বড় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে না। একটা বিষয় পরিষ্কার হলো, পূর্বজদের দেখানো স্থানীয় বাজারের সঙ্গে জুড়ে থাকাটাকে তখনও কোনও কারিগরই দুরছাই করছেন না। মেলা শেষে ঠিক হলো নিজেদের মধ্যে আরও বড় করে নিয়মিত হাটে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কীভাবে আলোচনা চালানো যাবে সে প্রক্রিয়া সদ্য প্রয়াত মধুমঙ্গল মালাকার এবং নেপাল সূত্রধর আর ৪/৫ জন কারিগর মিলে ঠিক করবেন। দুই সম্পাদক, স্থানীয়, রাজ্য, দেশিয় এবং বিদেশি বাজার পরখ করে দেখেছেন এবং তারা তখনও স্থানীয় বাজারকে গুরুত্ব দেন।

যদিও তার আগের এক দশকে দেশজ প্রযুক্তির চরিত্র, ব্যপ্তি, ইতিহাস ইত্যাদি বুঝতে বাংলাজুড়ে ঘুরেছি, কারিগর সঙ্গ করেছি কিন্তু তখনও কারিগর শব্দ ব্যবহার করি না। আমভদ্রবিত্তর ব্যবহার্য লব্জ দেশিয় উৎপাদন ব্যবস্থা বিচ্যুত শিল্পী, হস্তশিল্পী বলি। এই ভদ্রবিত্তিয় ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিল সংগঠনের নামে। ঘোরতর বাম-ভদ্রবিত্ত পরিবারজাত বলেই সংগঠন তৈরির প্রক্রিয়ায় আমাদের কয়েকজনের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন নাম বাছা, কাগজপত্র তৈরি আর আইনি ঝঞ্ঝাট মেটানোর। আমার বা মধুদার, নেপালদার এবং আরও কয়েকজনের যেহেতু হাতেকলমে সংগঠন করার অভিজ্ঞতা আছে, তাই নতুন সংগঠন যাতে বাংলার অন্য ভদ্রবিত্তের নেতৃত্বওয়ালা আরেকটা গ্রামীণদের ‘ভালো করার’ সংগঠনের পথ না ধরে, কারিগরদের সংগঠন হয়ে ওঠে সেটাও দেখা দরকার ছিল। সেই প্রক্রিয়া প্রয়াত কারিগরশ্রেষ্ঠ মধুদা-নেপালদা অনেকটাই নিশ্চিত করেছিলেন।

আরও পড়ুন- রাষ্ট্র ভুলে যায়, ক্ষমতার গদি উল্টে দিতে জানে উচ্ছেদ হওয়া হকাররা

২০১০ সালে সংগঠন তৈরি হওয়ার পর কোচবিহারের লঙ্কাবরে সম্মেলন, ব্রতচারী গ্রাম আর চান্দোল হাটে নিজেদের উদ্যমে, চাঁদায় অনুষ্ঠান আয়োজন আর সংগঠন করার অভিজ্ঞতা বাংলার কর্পোরেট নিরপেক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থায় জুড়ে থাকা কারিগরদের অসামান্য জ্ঞানচর্চার, পরম্পরা, দক্ষতা বুঝতে সাহায্য করেছিল, বুঝতে সাহায্য করেছিল মৌখিক জ্ঞানচর্চার, মরসুমি উৎপাদন ব্যবস্থার অদ্যম্য জীবনীশক্তি, জোরের জায়গাটাও। বুঝেছিলাম, বিকেন্দ্রীভূত কারিগর উৎপাদন ব্যবস্থা মরসুমি কাঠামো নির্ভর বলেই, সারা বছর সব উৎপাদন বাজারে পাওয়া যায় না। যেহেতু কর্পোরেটিয় ভদ্রবিত্ত তার জীবনধারণের সব পণ্য এখন সারা বছর পেতে অভ্যস্ত, তাদের লব্জে বাংলার কারিগরি লুপ্তপ্রায়। লুপ্তপ্রায় যে নয়, সেটা বোঝা যায় সম্বৎসর মেলা বা হাটে ঘুরলে।

বুঝতে শিখলাম, এই বিকেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজি বড় ভূমিকা পালন করে না, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জ্ঞানচর্চা, কারিগরের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিদ্যুৎ নির্ভর প্রযুক্তি, স্থানীয় উৎপাদনের উপকরণ, বাজার ইত্যাদি। কর্পোরেট একটা বাজারকে ধ্বংস করলেও অন্য সব বাজার তার ধাক্কায় ধ্বংস হয় না। তাই কারিগর উৎপাদন ব্যবস্থাটা অনেকটাই কর্পোরেট নিরপেক্ষ। সংগঠন আমার পৃথিবী, দেশ, সমাজ বোঝার প্রক্রিয়া পালটে দিয়েছিল চিরতরে।
বাম-প্রগতিশীল পরিবারে বেড়ে ওঠার সুবাদে আবাল্য কর্পোরেট-জাতিরাষ্ট্র নির্ভরতা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লগুড় হাতে সরকারি থাকবন্দির ভদ্রবিত্তই সমাজ শুধরোনো আর সমাজ নিয়ন্ত্রণের সর্বময় কর্তা, এমন একটা অনতিক্রম্য দৃষ্টিভঙ্গিতে লালিতপালিত হয়েছি। সংগঠন তৈরির জন্য বছর তিনেকের নিরবিচ্ছিন্ন বাংলাজোড়া ঘোরাঘুরির (আগের এক দশকের হকার সংগঠনের সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার অভিজ্ঞতা জুড়ে) হেঁটমুণ্ডঊর্ধ্বপদ জীবনকে মাথা আকাশে, পা মাটিতে রেখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল প্রতি পল। হকার-কারিগরেরা আমার শিক্ষক হয়ে সমাজ-দেশ-রাষ্ট্র ব্যবস্থা নতুন করে বোঝালেন। বিষচক্রী পুঁজিতন্ত্রের প্রগতিশীলতার ধারণা, পিছনের দিকে টেনে নিয়ে চলা সামন্ততন্ত্রের ধারণা, অক্ষর সভ্যতার গুমোরে বাঁচার দাবড়ানি, বিদ্যুৎ নির্ভর ভদ্রবিত্তীয় সুখদ লুটেরা জীবনযাত্রার আরাম, কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থার বিষধ্বংসলুঠচক্রে চিরাচরিত ভদ্রবিত্তিয় আস্থা, ভদ্রবিত্তীয় ইওরোপমন্য কৃষ্টিশীলতার ধোঁকারটাটিতে ডুবে থেকে অন্যদিকে না তাকাবার আবাল্য শিক্ষা, অশিক্ষিত, সভ্যতার ষড়ৈশ্বর্য না দেখা, অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রামে বাস করা, অশিক্ষিতের পটুত্বওয়ালা ছোটলোক উদ্ধারে ভদ্রবিত্তীয় সামাজিক দায়ের বোঝার তত্ত্বকে প্রশ্ন করতে শিখলাম। শিখলাম সাথী উৎপাদকেরা হস্তশিল্পী বা শিল্পী নন, পরম্পরার উদ্যমী কারিগর, দেশিয় উৎপাদন ব্যবস্থার অবচ্ছেদ্য অংশীদার। কারিগরি দক্ষতা ভদ্রবিত্তের ভাষায় অশিক্ষিতের পটুত্ব নয়, প্রত্যেক কারিগর সমাজ দীর্ঘ পরম্পরার হকদার, কেউ পারিবারিক, কেউ গোষ্ঠী, কেউ সামাজিক, কেউ গ্রামীণ উৎপাদনের জ্ঞান, দক্ষতা, প্রযুক্তির পরম্পরা বয়ে চলেছেন আজও।

সম্পাদকের নিদানে কারিগর-ভদ্রবিত্ত সম্পর্ক বাখানে এতক্ষণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বাখান করলাম, কারণ আবাল্য হস্তশিল্পীদের ভদ্রবিত্তীয় সমাজের তৈরি করা আহা-উহু মার্কা মাপকাঠিগুলো প্রয়োগ করেই বুঝতাম এবং কারিগর সংগঠনে জুড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কারিগর উদ্ধার প্রকল্প, এ তথ্য অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার শিক্ষক কারিগদের সঙ্গ করে বুঝলাম গত ৭০ বছর গ্রামের জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি, দক্ষতা, জীবনযাত্রা, গ্রামীণ উৎপাদনকে দুরছাই করে কারিগরদের বিদ্যুৎ নির্ভর প্রযুক্তি, গ্রাম বাজার থেকে উচ্ছেদ করানো এবং কারিগরেরা প্রাচ্যবাদীদের লব্জে ‘এনসিয়েন রেজিম’-এর লুপ্তপ্রায় শিল্পী এবং ভদ্রবিত্ত পরিচালনায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাই শিল্পী ছোটলোক উদ্ধারের একমাত্র রাস্তা, এই ধারণার শেকড় চারাবার ব্যবস্থা হয়েছে। গত ৭ দশকে আমার মতো ভদ্রবিত্ত নিজেদের ছোটলোক উদ্ধারকারী ভেবেছেন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের থাকবন্দির বিভিন্ন খোপে বসে তারা ছোটলোক উদ্ধার প্রকল্প – ডিজাইনারদের দিয়ে নতুন ভদ্রবিত্তীয় জীবনযাত্রা নির্ভর ‘পণ্য’ তৈরি ‘শেখানো’, বৈদ্যুতিক যন্ত্রের কাজে অভ্যাস করানো, সব এফেক্টিভ বাজারের শেষ কথা যে গ্রাম নয় শহর, খুব বেশি হলে জেলা সদরই অরিজিনাল ‘ফোক’-এর ‘হস্তশিল্প’র বাজার - বাস্তবে রূপায়ণ করার কাজ করেছেন। ঝাঁ চকচকে নিউ টাউনের উচ্চভদ্রবিত্তের নবক্রীড়াভূমিতে কংক্রিটের তৈরি ইকো পার্কের চলতি হস্তশিল্প মেলা যে এক অর্থে গ্রামের বাজার থেকে কারিগরদের তুলে এনে শহরে কর্পোরেটদের গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার ভদ্রবিত্তীয় প্রকল্পের অংশ, এ কথা আজকের এই প্রবন্ধে বলা চরম গুনাহ, না-পাক হলেও প্রবন্ধ লেখক নাচার। আমরা যেন মাথায় রাখি পশ্চিম ইওরোপ বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্য তৈরির আগে নিজেদের দেশে উপনিবেশ তৈরি করেছিল ভদ্রবিত্তকে কাজে লাগিয়ে।

কার্ল উইনারলিন্ড ক্যাজুয়ালিটিজ অব ক্রেডিট, দ্য ইংলিশ ফিনানসিয়াল রেভলিউশন ১৬২০-১৭২০ বইতে বলছেন, ১৬০০ থেকেই ইংল্যান্ডে উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সম্পত্তির অধিকারকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার ফলে টিউডর আর স্টুয়ার্ট আমলে বিপুল সংখ্যক কৃষক জমিহীন, কাজহীন পেশাদার উদ্বৃত্ত হয়ে গ্রামাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হলো। আইজাক নিউটন কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা বাঁচাতে সরকারের ডাকে ছোটলোকদের কয়েদ করলেন, ফাঁসিতেও চড়িয়ে হুঁশিয়ারি দিলেন। গোটা পশ্চিম ইওরোপ নবজাগরণের নামে দেশে দেশে কারিগর, চাষি, পশুচারক, ধীবর এবং অন্য পেশাদার নির্ভর বিকেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে কর্পোরেট পুঁজির পরিকল্পনামাফিক ভদ্রবিত্ত পরিচালিত উপনিবেশিক কাঠামো কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে শনৈ শনৈ এগোচ্ছে যাতে আফ্রিকার কালো মানুষদের আমেরিকা আর ইওরোপে নিয়ে এসে দাস বানিয়ে শ্রম লুঠের উদ্বৃত্ত আর বাংলায় উপনিবেশের প্রথমকালে সম্পদ লুঠ বিনিয়োগ করে কেন্দ্রীভূত বড় কারখানায় এই উদ্বৃত্ত কারিগর, চাষি, পশুচারকদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের সময়ে ফোক আর ক্ল্যাসিক্যাল থাকবন্দিত্ব তৈরি হলো। যারা ঘাড় বেঁকিয়ে কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থায় জুড়লেন না, তাদের ‘ফোক’, 'ওরা থাকে ওধারে' ছাপ্পা মারা হলো – সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও তাদের সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করা হলো, আর সগৌরবে পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘু ক্ল্যাসিক্যালকেই আরাধ্য মেনস্ট্রিম বলা হলো।

পুঁজির সমস্যা হলো, ইওরোপে, বিশেষ করে পশ্চিম ইওরোপের দেশে দেশে চাষি, কারিগর, হকার পশুপালকদের শ্রমিক তৈরি করার কেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়ায় বলপ্রয়োগে চাপিয়ে দিতে পেরেছিল (মাইকেল ফিজসিমনস ফ্রম আর্টিজান টু ওয়ার্কারস, গিল্ড, দ্য ফ্রেঞ্চ স্টেট এন্ড দ্য অর্গানাইজেশন অব লেবার, ১৭৭৬-১৮২১), ভারতবর্ষে, বাংলায়, উপনিবেশ খুন জখম, অত্যাচার, লুণ্ঠন, গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েও ইওরোপের মতো সমাজকে কর্পোরেট নির্ভর করানো, কর্পোরেটদের জন্যে গ্রামের বাজারের দরজা হাট করে খুলে দেওয়ার কাজটা সেই প্রাবল্যে করে উঠতে পারেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গেছে, কিন্তু উপনিবেশিক নিয়ম কানুন বহাল তবিয়তে চলছে। সেই প্রচেষ্টা আজও চলছে নগ্নভাবে, কোনওরকম রাখঢাক না রেখেই। কর্পোরেট যতটা দেশিয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে ধাক্কা দেওয়ার কাজে সাফল্য চাইছে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, নোট বাতিল, কোভিড, ডিজটাল অর্থনীতি চালু করে, সাফল্য সেই মাত্রায় আসছে না। তাই বার বার রাষ্ট্রীয়-কর্পোরেটিয় বোর্ডরুমে নত্য নতুন পরিকল্পনা রূপায়ন করে ভদ্রবিত্তদের পঞ্চম বাহিনী হিসেবে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করছে কর্পোরেটের বাজার বাড়ানোর।

আবার ফিরে আসি বাংলার বাস্তবতায়। লাখো রাজনীতি করা ভদ্রবিত্তের মতো হস্তশিল্পীদের উদ্ধার করতে কারিগর সংগঠনে যুক্ত হয়ে দেখলাম বাংলার ৬০ লক্ষ পরম্পরার কারিগরের অধিকাংশই স্থানীয় বাজার নির্ভর; শহরের বাজারে ডাকলে কারিগরেরা যাই বটে কিন্তু আজও শহরের বাজার জীবনজীবিকার প্রধানতম আয়ের উৎস নয়। কলকাতার হস্তশিল্পের বড় মেলায় আসা কারিগরেরা রোজের হিসেবে আজও মাত্র ৭৫ টাকা পান। ফলে গোটা পরিবার নিয়ে মেলায় আসেন একলপ্তে অন্তত হাজার বিশ-পঁচিশ টাকা অর্থাৎ মাসে দেড় থেকে দু’হাজার টাকা বাড়তি রোজগারের জন্য। সে এই হস্তশিল্পের মাঠে বাজারে আপনার পৃষ্ঠপোষকতার উপর ভরসা করে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে না – আপনি যা কিনবেন সেটা তার উদ্বৃত্ত আয়। হে ভদ্রবিত্ত, নিজের বুকের মাঝে হাত রেখে হিসেব করে দেখুন, প্রতিমাসে পারিবারিক রোজগারের কত অংশ কর্পোরেটকে দেন, আর কত অংশ কারিগরদের জন্যে ব্যয় করেন? আপনার মাস খরচের অডিট করলেই বুঝবেন নিউ টাউনে মানুষের বান ডাকা ভিড়ে নিজেদের ছোটলোকদের 'সেভিয়ার' ভাবার ভাবনা কতটাই বানোয়াটি।

কেন বানোয়াটি বলছি? সরকারি হিসেবে বাংলায় পরম্পরার কারিগর ৬০ লক্ষ, এর মধ্যে ৭.৫ লক্ষ তাঁতি, ২.৫-৩ লক্ষ অভিকর শিল্পী, গান করেন, বাদ্য বাজান, অভিনয় করেন ইত্যাদি। সবে মিলিয়ে মোট জনসংখ্যার ৬%এর আশেপাশে। কলকাতার মেলায়, বাংলা জোড়া সদর শহরগুলোয় সব সরকারি বেসরকারি মেলা মিলিয়ে অংশ নেওয়া কারিগরের সংখ্যা যদি ৫ লক্ষ ধরি, তাহলেও বাকি ৯০% মানুষ স্থানীয় কৃষ্টি আর বাজার নির্ভর করেই বছরের পর বছর বেঁচেছেন, পরম্পরা বাঁচিয়েছেন। একটা উদাহরণ দিই, বিশ্বের ১১টা দেশ ঘোরা মধুমঙ্গল মালাকারের পরিবারের মূল শোলা কারিগরির চাহিদা ১০০ কিমি বৃত্তের মধ্যেই এবং সেই বাজার বাড়ছে বই কমছে না। তো যদি প্রত্যেক কারিগরকে বছরে ২০ হাজার টাকা বাড়ি আনতে হয়, তাহলে তাকে কম করে ১ লক্ষ টাকার বাণিজ্য করতে হবে। অর্থাৎ মাত্র ৬% কারিগরের বাজার খুব কম হলে ৬০ হাজার কোটি টাকা, কারিগর সংগঠনের হিসেবে আরও আরও বড়, অন্তত তিনগুণ। তো এই ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজারে, ভদ্রবিত্ত আপনার অংশীদারি কত, প্রশ্ন করা যাবে?

আরও পড়ুন- মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্নের অপমৃত্যু! ‘হর ঘর তিরঙ্গা’-র আলোয় অন্ধকারে রয়ে গেলেন খাদি শিল্পীরা

স্বাধীনতার অমৃত ৭ দশকজুড়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন যজ্ঞে বলি হয়ে বিপুল মানুষের উচ্ছেদ হয়ে শহরে ‘শ্রমিক’ বনে যাওয়ায় গ্রামে তৈরি শূন্যতা সত্ত্বেও কারিগর, চাষি আর ছোট ব্যবসায়ীরা আজও গ্রামের বাজার আগলে আছেন। ফলে আমরা সবুজ বিপ্লবে কর্পোরেটদের কাছে চাষিদের আংশিক আত্মসমর্পণ, ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার বিষচক্র, ২০১৬-র নোট বাতিলের মতো সম্পদ কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা এবং ২০২০-র কোভিড আমলে ডিজিটাইজেশন ভেদ করেও কর্পোরেটের আগ্রাসন রুখে চলেছি।

কারিগর সংগঠন করতে গিয়ে আমি বা আমার বন্ধুরা যেমন নিজেদের আবিষ্কার করেছি, তেমনই আবিষ্কার করেছি যাদের আমরা প্রান্তিক, গরিব, ছোটলোক বলে দেগে দিই সেই বিকেন্দ্রীভূত উৎপাদকদের স্মৃতি নির্ভর মানুষদের জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি চর্চার শেকড়, পরম্পরা, তাদের জোরের জায়গাগুলো। ডিজিটাল ব্যবস্থার শুরু থেকেই উপনিবেশের কোলাবরেটর ভদ্রবিত্তের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে কর্পোরেটদের লাভ আর লোভের আগ্রাসন রুখতে না পেরে। ২০০৮-এর মন্দা হকার কারিগরেরা আটকাতে পেরেছিলাম কারণ আমরা তখনও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার অংশীদার ছিলাম না, যদিও নাম হয়েছিল দেশের অর্থনীতির ফান্ডামেন্টালের। আজও আমরা গ্রামে যে ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার অংশীদার, তাতে কর্পোরেট সহজে দাঁত ফোটাতে পারে না। আমরা আক্রান্ত হচ্ছি কর্পোরেটদের আগ্রাসনে। তা সত্ত্বেও সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধ লড়াইতে আমরা নিবেদিত প্রাণ। এই লড়াইতে আক্রান্ত ভদ্রবিত্তের অংশগ্রহণ জরুরি।

শুরু করেছিলাম স্থানীয় বাজারে মুখ ঘোরানোর উদ্যমের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিতে। শেষ করব বিশ্ববাজারে পৌঁছনোর যৌথ উদ্যমের ডাক দিয়ে। একদা এই বাংলার চাষি-কারিগর বিশ্ব বাজারে প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। গত ২৬৬ বছর আমাদের চাষি, কারিগর, হকারদের নানা বিধি-নিষেধ জারি করে বিশ্ব বাজার থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই বিশ্ব বাজারে পৌঁছতে চাই। এই কাজে বাংলার ভদ্রবিত্ত যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে স্থানীয় বাজারের জোরে দাঁড়িয়ে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছতে পারি – যে বাজারে আজও দক্ষিণ এশিয়া প্রায় ব্রাত্য। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভদ্রবিত্ত আমাদের দুরছাই না করে ভাবুন। সার্টিফিকেট নির্ভর নিশ্চিন্ত চাকরি জীবন কাটিয়ে ব্যাঙ্কে মোটা টাকা রেখে জীবন কাটানোর জীবন কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, এমনকী কর্পোরেট চাকরিও নিশ্চিত নয়। অথচ কারিগরির আজও বিশ্বজোড়া বাজার। ২০২২ সালে ১২০.০৬ মিলিয়ন ডলার কারিগরি রপ্তানি করে ভারত রোজগার করেছে। মধুমঙ্গল মালাকার বেঁচে থাকতে ২০১৬ সালে অধ্যাপক দীপঙ্কর দের সহায়তায় এই বিষয়ে একটা পাঠ্যক্রমের চিন্তাভাবনা করেওছিলাম, নানা কারণে সে উদ্যম সফল হয়নি – কিন্তু আমরা সে ভাবনা মাথা থেকে বার করে দিতেই ইচ্ছুক নই। আমরা দীর্ঘ পরম্পরা ধারণ করা বাংলা কারিগরেরা বাঙালি ভদ্রবিত্ত সমাজের সঙ্গে মিলে আমাদের হারানো বিশ্ব বাজারের অংশীদার হতে চাই। এই ডাকে কারিগর সংগঠনের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে প্রবন্ধ শেষ করলাম। কারিগর ব্যবস্থার জয় হোক। ভদ্রবিত্ত-কারিগর জোট যদি তৈরি হয়, তার জয় হোক।

 

 

(লেখক বঙ্গীয় পারম্পরিক কারিগর ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘের সর্বক্ষণের কর্মী)

More Articles