মুখের ভালো ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলছে? রোজের টুথপেস্ট কতটা নিরাপদ?

Toothpaste and Oral Bacteria: আমাদের মুখের মধ্যে ৭০০টিরও বেশি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া রয়েছে! এই ব্যাকটেরিয়াগুলি কেবল যে দাঁত এবং মাড়ির উপরিভাগেই থাকে তা নয়।

দু'বেলা ব্রাশ করলে দাঁতের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, চিকিৎসকরা মোটামুটি এই পরামর্শ সকলকেই দেন। দাঁত ব্রাশ করার লক্ষ্যই হচ্ছে, মুখের দুর্গন্ধ দূর করা এবং দাঁতে কোনওরকম ক্ষয়, বা পচন প্রতিহত করা। অনেকেই জানেন না, আমাদের মুখের মধ্যে নানা ব্যাকটেরিয়ার জটিল এক বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। কিছু ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকর, কিছু ব্যাকটেরিয়া আবার আপনা থেকেই স্বাভাবিক পদ্ধতিতে দাঁতের এবং মৌখিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে থাকে। টুথপেস্ট মুখের দুই ব্যাকটেরিয়ার উপরেই সমান প্রভাব ফেলে। আমাদের ওরাল মাইক্রোবায়োমে যে ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলির বাস, টুথপেস্ট কি তবে সেগুলিও বিনষ্ট করে দেয়?

সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ওরাল মাইক্রোবায়োম আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। এক সুষম ভারসাম্যযুক্ত মাইক্রোবায়োম ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, হজমে সহায়তা করে এবং মাড়িকে রক্ষা করে। কিন্তু নানারকমের টুথপেস্ট কি এই ভারসাম্যকে রক্ষা করে আদৌ? নাকি সেই ভারসাম্য নষ্ট করে আখেরে ক্ষতি করে? এমন কোনও বিশেষ টুথপেস্ট কি আছে যা ওরাল মাইক্রোবায়োম রক্ষা করতে পারে?

আমাদের দেহের নানা অংশেই এমন ব্যাকটেরিয়ার আবাসস্থল রয়েছে। তবে মুখ শরীরের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মাইক্রোবিয়াল আবাসস্থলগুলির মধ্যে একটি। জানলে অবাক হবেন, আমাদের মুখের মধ্যে ৭০০টিরও বেশি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া রয়েছে! এই ব্যাকটেরিয়াগুলি কেবল যে দাঁত এবং মাড়ির উপরিভাগেই থাকে তা নয়। এই উপকারী এবং ক্ষতিকারক দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়াই আমাদের লালাতেও থাকে।

স্বাস্থ্যকর মাইক্রোবায়োমে এমন ব্যাকটেরিয়া থাকে যা মুখের pH মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, খাবার ভাঙতে সাহায্য করে এবং প্রাকৃতিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল যৌগ তৈরি করে। কিন্তু এই ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে, খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ে। খাবারদাবার, মুখের একদম যত্ন না নেওয়া বা চিকিৎসাজনিত কিছু সমস্যার কারণে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া মুখের দখল নেয়। ভালো আর খারাপ ব্যাকটেরিয়ার এই ভারসাম্যহীনতা ডিসবায়োসিস নামে পরিচিত। এর থেকে দাঁতের ক্ষয় এবং মাড়ির রোগ দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন- রামদেবের দন্তকান্তি টুথপেস্ট চিন্তায় ফেলে দেয় বিজ্ঞানীদেরও! কেন একথা বলছে কোলগেট?

টুথপেস্ট আসলে কী করে?

টুথপেস্টের প্রধান কাজ ব্যাকটেরিয়াকে সরাসরি মেরে ফেলা নয় বরং এই ভারসাম্যকে ব্যাহত করা যা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে বৃদ্ধি পেতে জায়গা করে দেয়। যান্ত্রিকভাবে ব্রাশ করলে দাঁত এবং মাড়ি থেকে এই ব্যাকটেরিয়ার বাস্তুতন্ত্র উৎখাত হয়ে যায়।

অনেক টুথপেস্টে ফ্লোরাইডও থাকে, যা দাঁতের এনামেলকে শক্তিশালী করে এবং ক্যাভিটি প্রতিরোধে সাহায্য করে। মজার বিষয় হলো, ফ্লোরাইড নিজে থেকে ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে না, তবে এটি দাঁতের ক্ষয়ের মূল কাণ্ডারী স্ট্রেপ্টোকক্কাস মিউটানসের মতো অ্যাসিড-উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়াকে ক্ষতির কারণ করে তোলে।

কিছু টুথপেস্টে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট রয়েছে, যেমন ট্রাইক্লোসান। এখন কিছু দেশে নিরাপত্তাজনিত কারণে এমন টুথপেস্ট নিষিদ্ধ। ট্রাইক্লোসান ছাড়াও স্ট্যানাস ফ্লোরাইড এবং জিঙ্ক যৌগের মতো নতুন বিকল্পও টুথপেস্টে আজকাল থাকে। এই উপাদানগুলি ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে টার্গেট করে, তবে সেই প্রক্রিয়াটিতে উপকারী জীবাণুগুলিরও ক্ষতি হয় কিনা তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।

টুথপেস্ট ওরাল মাইক্রোবায়োমের উপর ঠিক কী প্রভাব ফেলে, সেই সম্পর্কে গবেষণা এখনও হচ্ছে। কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, কিছু অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট ক্ষতিকারক এবং উপকারী দুই ব্যাকটেরিয়াই কমিয়ে দেয়, তা মাইক্রোবায়োমকে এমনভাবে পরিবর্তন করে যা গবেষকরা এখনও পুরোপুরি বুঝতেই পারেননি। অন্য গবেষণায় আবার বলা হচ্ছে, ব্রাশ করার পরে বেশ দ্রুতই আবার গজিয়ে ওঠে এই মাইক্রোবায়োম, ফলে বিপদের কারণ নেই।

আরও পড়ুন- আক্কেল দাঁত ভুগিয়েছে আপনাকেও? অবাক করবে এই দাঁতের লক্ষ বছরের ইতিহাস

বিজ্ঞানীরা এখন ভবিষ্যতের টুথপেস্ট তৈরি নিয়েই চিন্তিত। উপকারী ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিগুলি সংরক্ষণ, ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া হ্রাস করার মতো কোনও উপাদান টুথপেস্টে যুক্ত করা যায় কিনা এই নিয়ে গবেষণা চলছে। বেশ কিছু গবেষণায় প্রোবায়োটিক এবং প্রিবায়োটিকের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। এগুলি এমন উপাদান যা স্বাস্থ্যকর ওরাল মাইক্রোবায়োমের কোনও ক্ষতি না করে, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

শুধুমাত্র দাঁতের ক্ষয় নয়, মাড়ির রোগের সঙ্গে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং গর্ভাবস্থার ক্ষতি ভীষণভাবে জড়িত। ক্ষতিকারক ওরাল ব্যাকটেরিয়ার ফলে উদ্ভূত প্রদাহ মুখের বাইরে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়াতে পারে। দিনে দু'বার ফ্লোরাইড টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশ করা, আর দাঁতের মাঝের অংশগুলি পরিষ্কার করার ফলে মুখের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া অনেক কমে যায়। নানা রোগের ঝুঁকি কমে যায়।

মাইক্রোবায়োম বাঁচানোর টুথপেস্ট

ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্টের পরিবর্তে, ভবিষ্যতের টুথপেস্টে এমন উপাদান থাকতে পারে যা ক্ষতিকারক প্রজাতিগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে বাঁচিয়ে রাখে। আর্জিনাইন প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন এমন এক অ্যামাইনো অ্যাসিড যা উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ভালো ব্যাকটেরিয়া না মেরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলিকে প্রতিহত করে। তবে এই গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই উপাদানগুলির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নির্ধারণের জন্য আরও প্রমাণের প্রয়োজন। আপাতত, গবেষকদের পরামর্শ, ফ্লোরাইড টুথপেস্ট দিয়ে দিনে দু'বার ব্রাশ করুন, অতিরিক্ত থুথু বের করে দিন এবং প্রতিদিন দাঁতের মধ্যের অংশগুলি পরিষ্কার করুন।

More Articles