মোবাইলের চেয়েও সস্তা চাঁদের জমি! সত্যিই কি চাঁদের মালিক হতে পারেন আপনি?

Buy Land on Moon: চাঁদে বেশ কয়েকটি বিক্রয়যোগ্য অঞ্চল রয়েছে। তাদের নামও এই ধরাধামের তাক লাগানো রিয়েল এস্টেটের মতোই।

ভারত চাঁদে গিয়েছে। বহুকাল পরে জাতি গর্বের এক সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পেয়েছে। চাঁদে ছিল এক বুড়ি, চাঁদ নিজেই ছিল আস্ত মামা। এককালে অধরা চাঁদের সঙ্গে জুড়েছিল রূপকথা, জুড়েছিল কল্পনা। চাঁদে প্রথম মহাকাশযান এবং মানুষ যাওয়ার পর থেকে চাঁদ একপ্রকার উপনিবেশই হয়ে উঠেছে। সেখানে নানা দেশই চায় নিজ নিজ অস্তিত্ব স্থাপন করতে। ফলে যা ছিল কল্পনা, অনেকাংশেই হয়ে উঠছে বাস্তব। প্রেমিকাকে চাঁদ তারা এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রেমিককূল এখন আর কথা দিয়ে কথা না রাখার আওতায় পড়ছেন না। চাঁদ এনে দিতে না পারলেও চাঁদের অংশ দিতেই পারছেন প্রেমিকাকে। উপগ্রহকে বোঝার চেষ্টায় মানুষ এতদূর অবধি গিয়েছে যে চাইলে চাঁদে জমি কেনাও যাচ্ছে। আর কীই বা চাই! চাঁদের জমি কিনছে পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু কীভাবে, কতই বা দাম?

পৃথিবীর বহু ধনী ব্যবসায়ী এবং সেলিব্রিটি চাঁদে জমি কিনেছেন। এখন সাধারণ মানুষও কিনছেন অনেকেই। চাঁদে বিনিয়োগের এই কারণ আসলে কী? তা জানার আগে ভারতীয় তারকাদের চাঁদে জমি কেনার স্বল্প কথা হয়ে যাক। প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত বিজ্ঞান এবং মহাকাশ বিষয়ে নিরন্তর চর্চা করতেন। এই চর্চা ও প্রেম থেকেই চাঁদে এক টুকরো জমির মালিক হয়ে ওঠেন সুশান্ত। চাঁদের এক দূরবর্তী জমি কিনেছিলেন সুশান্ত। যে অঞ্চলটি তিনি কিনেছিলেন তাকে বলা হয় মারে মাসকোভিয়েন্স বা ‘মাসকোভির সাগর’।

বাদশা শাহরুখ খানও কয়েক বছর আগে জানিয়েছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার একজন ভক্ত তাঁকে তাঁর ৫২ তম জন্মদিনে চাঁদে এক টুকরো জমি উপহার দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি গর্তের নামও রাখা হয়েছে এসআরকে-এর নামে। যদি মনে করেন, চাঁদে সম্পত্তির মালিকানা কেবল ধনীদেরই তাহলে আপনার জানা প্রয়োজন চাঁদে কিন্তু যে কেউ সম্পত্তির মালিক হতে পারেন। চাঁদে জমির দাম এবং কীভাবে চাঁদে জমি কেনা যায় দেখা যাক।

আরও পড়ুন- হলিউড সিনেমার অর্ধেক খরচে ভারতের পকেটে চাঁদ!

চাঁদে জমি কেনার জন্য দ্য লুনার রেজিস্ট্রি নামের ওয়েবসাইটে যেতে হবে প্রথম। যে কেউ চাইলে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট দেখতে পারেন এবং যে অঞ্চলে জমি কিনতে চান সেটি নির্বাচন করতে পারেন। চাঁদে বেশ কয়েকটি বিক্রয়যোগ্য অঞ্চল রয়েছে। তাদের নামও এই ধরাধামের তাক লাগানো রিয়েল এস্টেটের মতোই। চাঁদে আছে 'সি অব ট্রাঙ্কুইলিটি', রয়েছে 'লেক অব ড্রিমস', চাইলেই এইসব অঞ্চলে জমি কিনতে পারেন আপনি। পছন্দের অঞ্চল নির্বাচন করার পর আপনাকে আপনার পরিচয়পত্রের যাবতীয় নথি জমা দিতে হবে। সবটা মিটে গেলেই চাঁদে জমির মালিক আপনি৷ চাঁদে এক একর জমির দাম মোটামুটি ৪২.৫ মার্কিন ডলার। মানে ভারতীয় টাকায় প্রায় ৩৫০০ টাকার মতো! মানে লাখ ৩৫ খরচ করলে চাঁদে ২ কামরার বিশাল বাড়ি বানানো সম্ভব। কিন্তু এখানেই আছে এক খটকা।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইন অনুযায়ী কিন্তু পৃথিবীর কোনও দেশের মহাকাশের উপর কোনও অধিকার নেই। চাঁদ হোক, অন্য নক্ষত্র হোক, মহাকাশের যে কোনও সামান্য জিনিস হোক, কোনও কিছুর উপরই কোনও দেশের অধিকার নেই। ফলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইনে চাঁদে জমি কেনার আইনত স্বীকৃতি নেই। তাহলে এই সংস্থাগুলি কীভাবে চাঁদে অনৈতিকভাবে জমি বেছছে? এই সংস্থাগুলির যুক্তি, আইন মোতাবেক চাঁদে কোনও দেশ অধিকার দাবি করতে পারে না, কিন্তু নাগরিকদের বাধা নেই। তাই কেউ চাইলে বৈধভাবে চাঁদে জমি কিনতে পারবেন।

১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন চাঁদের বুকে অবতরণ করেন। সেবারই প্রথম মানুষের পদচিহ্ন পড়ে এই উপগ্রহে। ১৯৭২ সালের পর থেকে আর কোনও মানুষই চাঁদে যাননি। ভারত সদ্য চাঁদে প্রথম সফল অবতরণ করেছে চতুর্থ দেশ হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা যখন চাঁদে প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযান পাঠানোর পরিকল্পনা করে তখনই জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ নামের এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তিতে বলা হয়, কোনও নির্দিষ্ট দেশ চাঁদসহ মহাকাশের অন্যান্য গ্রহ বা উপগ্রহের সার্বভৌমত্ব বা মালিকানা দাবি কিংবা কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১১১টি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।

তবে এই আউটার স্পেস ট্রিটি-তে চাঁদের জমির ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট মালিকানা নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। এই সুযোগটিই নিয়েছে বহু সংস্থা। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘মুন এগ্রিমেন্ট’ নামে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বলা হয়, পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটিকে শুধু বিশ্ববাসীর শান্তির স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে। চাঁদে যদি কেউ কোনও স্টেশন স্থাপন করতে চায় তাহলে জাতিসংঘকে প্রথমেই জানাতে হবে। বিশ্ববাসীর শান্তির লক্ষ্যে কি কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা জমি কিনতে পারে আইনত? অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, চাঁদে ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট মালিকানাও আসলে নিষিদ্ধ।

আরও পড়ুন- চাঁদে বা মহাকাশে কীভাবে অন্তর্বাস কাচেন মহাকাশচারীরা? অবাক করবে যে তথ্য

২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভনেস অ্যাক্ট’ আইন পাশ করে। যাতে মার্কিন নাগরিকেরা মহাকাশের এমন যেকোনও কিছুর মালিক হতে পারবে যেখানে তারা জল এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের জন্য খননকার্য পরিচালনা করতে পারবে। মাত্র ১১টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে, যার মধ্যে আছে ভারতও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চিনের মতো দেশকে এই চুক্তির অনুমোদনে সামিল করেনি।


আসলে পৃথিবীতে এক বর্গফুট জমি কিনতে এত টাকা খসাতে হয় যে চাঁদে এক একর জমি মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় পেলে তখন নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল। আবেগ, উচাটন, স্বপ্ন সব মাখামাখি হয়ে মানুষ কয়েক একর জমি কিনেই ফেলেন। সেখানে বাসা কোনওদিনই গড়া হবে না। তাঁর মৃত্যুর পর সেই জমি উত্তরাধিকারী পাবেন কিনা তাও খুব নড়বড়ে। তবু, এসব যৌক্তিকতার ধার কবেই বা আবেগের কাছে তীক্ষ্ণ হতে পেরেছে? চাঁদ এখন সত্যিই মামার বাড়ি, চাইলেই জমি দেখে আসা যায়।

More Articles