লেখক কম, প্রকাশকে গিজগিজ করছে বাংলার বইবাজার : সুমন চট্টোপাধ্যায়
Book Publication : বইয়ের বাজারে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর ছলা বই প্রকাশের বাজারে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। লেখে যতজন ছাপে তারও বেশি প্রকাশক? বইবাজারের 'লেখক' হওয়ার নয়া কিসসা লিখলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমার হোয়াটসঅ্যাপ স্ক্রিনে হঠাৎ এক মধুর সংলাপ ভেসে উঠল। সংলাপের দুই প্রান্তে দুই নারী, পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, জিগরি দোস্ত কিনা বলতে পারব না।
জয় হো... এগিয়ে চল, বহুৎ খুশ হুয়া জান। দারুণ ব্যাপার, আমার মন থেকে বলছি, হিংসে থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে।
‘তুমি হিংসে করবে আমাকে?’
করতেও তো পারি।
ড্যাশ, ড্যাশ, ড্যাশ।
‘এই, আমার বই নেই আর তোমার বই বেরিয়ে গেল। হিংসে করব না, আমি কি দয়ার সাগর নাকি?’
এই দুই নারীকেই আমি চিনি, আপনারাও অনেকে নিশ্চয়ই চেনেন। সম্ভ্রম আর গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে আমি নাম বলব না। খুনসুটি থেকে কোথায় যেন চাপা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। ‘আমার বই নেই আর তোমার বই বেরিয়ে গেল?’ সত্যিই তো, এর চেয়ে সাংঘাতিক অপরাধ আর কী হতে পারে।
আরও পড়ুন- পুজো ছিল, পুজো নেই : সুমন চট্টোপাধ্যায়
জীবনে যাহা কিছু প্রথম তাহাই উত্তম আর উত্তেজনাকর। আমাদের জীবনে বোধহয় লাখ লাখ অভিজ্ঞতা হয় প্রথম কিছুর। দেখার, করার, শোনার, বলার, রেলগাড়ি চড়ার, ইস্কুলে যাওয়ার, বিড়ি খাওয়ার ইত্যাদি। কয়েকটি প্রথম অভিজ্ঞতাই কেবল ছায়া হয়ে সঙ্গে থেকে যায় চিরটা কাল- প্রথম প্রেম, প্রথম বিচ্ছেদ, বয়ঃসন্ধির সঙ্গে প্রথম পরিচয় এবং প্রথম বই। এই হারে এত প্রথম বই বাঙালি ছাড়া অন্য কোনও জাতি পয়দা করে বলে মনে হয় না। অন্যদের হাতে এত সময় নেই, এ কথাও ঠিক।
মানব-শিশু ভূমিষ্ঠ হচ্ছে বারো মাস, তিরিশ দিন, চব্বিশ ঘণ্টা, প্রতি মিনিট, সেকেন্ড, ন্যানো সেকেন্ডে। কিন্তু বাংলা বাজারে প্রথম বইয়ের প্রসবকাল বাৎসরিক দুগ্গাপুজোর মতো পূর্ব-নির্ধারিত, বইমেলা-কাল। পদ্য অথবা গদ্য যাই হোক না কেন, নতুন লেখক তার পাণ্ডুলিপিতে তা দিতে থাকে বইমেলায় বইটির প্রথম প্রকাশের জন্য। অষ্টমীর রাতের জন্য সুন্দরী ষোড়শী যেমন অপেক্ষা করে। এই তীব্র আকুলতার কারণ সন্ধানে আমি নামতে চাই না। সাধারণভাবে মনে হয়, ফোকটে দৃষ্টিগোচর হওয়ার একটা বাড়তি সুযোগ তৈরি করে দেয় বইমেলা। কলেজ স্ট্রিটের ভুতুড়ে বইয়ের দোকানে ডাঁই করা বইয়ের স্তুপের তলায় সমাধিস্থ হওয়ার আগে প্রথম বইয়ের গায়ে আলো-হাওয়া খাওয়ানোর একটু চেষ্টা আর কী! সাধু প্রয়াস, কারও কিচ্ছুটি বলার থাকতে পারে না।
আরও পড়ুন- হে খিস্তিবাজগণ, গালাগালির মান উন্নত করুন : সুমন চট্টোপাধ্যায়
ইদানীং শুনতে পাই বইয়ের বাজারে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর ছলা বই প্রকাশের বাজারে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। লজ্জার মাথা না খেয়ে মুখ ফুটে বলে ফেলুন আপনার কী হওয়ার আহ্লাদ - কবি, ছড়াকার, গল্প লেখক, উপন্যাস লেখক, ফিচার লেখেক, ভ্রমণ কাহিনি- যা চাইবেন, যতটা চাইবেন, কোনও সমস্যা হবে না। সব বই হয়ে বেরিয়ে যাবে। অনেক রকম প্যাকেজ আছে, যার যেটা পছন্দ নিতে পারেন, তবে খরচের তারতম্য আছে। এই ধরুন, কবিতা লেখার নামে আপনি ছাইভস্ম লিখে আনলেন, এমন গপ্পো-উপন্যাস লিখলেন যা পড়ে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না চরিত্রগুলির নাম ছাড়া, আপনার ভালো মাল খসবে, কেননা আপনার এই সব লেখা মানুষ করার জন্য আমাদের যোগ্য অভিভাবক খুঁজতে হবে, প্রতিষ্ঠিত কবি বা লেখক। ওদের আবার খাঁইটা একটু বেশি, ছন্দ বোঝে, দ্বন্দ্ব বোঝে। আর যদি আপনি মনে করেন যা লিখেছেন সেটাই ভালো, সুনীল-শক্তির সমতুল্য, কোনও মেরামত করার দরকার নেই তাহলে খরচ অনেক কম। কী করবেন সেটা আপনার ওপর। তবে যে প্যাকেজই নিন ছাপার পরে বইগুলো বিক্রির দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে, আমরা কিচ্ছুটি করতে পারব না।
লোকে ফিল্ম-আর্টিস্ট হতে চায় বুঝি, গায়ক-গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা চায় বুঝি, ক্রিকেটার, ফুটবলার, পলিটিশিয়ান তাও বুঝি। কিন্তু গ্যাঁটগচ্চা দিয়ে কবি-লেখক হওয়ার জন্য এত লোকের পেট গুড়গুড় করাটা আছে একমাত্র বাঙালির ডিএনএ-তে। বন্ধুর বই ছাপা হয়েছে দেখলে তাই আনন্দ যতটা হয়, হিংসে হয় তার চেয়ে বেশি। বই চাই গো বই চাই, বই চাই গো!