হে খিস্তিবাজগণ, গালাগালির মান উন্নত করুন : সুমন চট্টোপাধ্যায়

Evolution of Political Slangs : শশী থারুর বলেছিলেন, ‘ল্যালোচেজিয়া'। মানে অন্যকে গালাগাল দিয়ে আত্মরতির সুখ পাওয়া। তবে, যুগ যুগ ধরেই সাংবাদিকদের খিস্তি দেওয়ার ধরন বদলে বদলে গেছে! সাংবাদিকের 'মেরুদণ্ড' প্রসঙ্গেই এবারের সুমন...

সাংবাদিকতার সঙ্গে আমার গালগাল শোনার বয়সও চার-কুড়ি হয়ে গেল।

গালাগালির গুণগত মান বড্ড নেমে গিয়েছে বলে মাঝেমাঝে বড় বিরক্ত লাগে। কিঞ্চিৎ দুঃখও যে হয় না তা নয়। গালাগালির স্বর্ণযুগ থেকে আজকের এই অধঃপতন, একদিন সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবেন।

য়েমন ধরুন, আমাদের শৈশবে গোটা বাংলায় চোঙা ফুঁকে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন নাকি চুরির টাকায় স্টিফেন হাউস কিনেছেন। মিথ্যে অপবাদ যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের মনটা কত বড় ছিল একবার ভাবুন। ইচ্ছে করলে তাঁরা প্রফুল্লবাবুকে চারটি ফ্ল্যাটের মালিক বলতে পারতেন। কিন্তু সিংহহৃদয় ছিল বলে ডালহৌসি পাড়ার ওই পেল্লাই প্রাসাদটিরই মালিক বানিয়ে দিয়েছিলেন প্রফুল্ল সেনকে। এর সারাৎসারটি হলো গাল কিংবা কুৎসা কিংবা অপবাদ দেওয়ার সময়ও দৃষ্টিভঙ্গিটা বড় রাখতে হবে। মারি তো গণ্ডার নয় লুটি তো ভাণ্ডার।

আমাদের মতো নগণ্য সংবাদজীবীদেরও যেসব কথা বলে গাল পাড়া হত, তাতে নিজেদের খুবই সম্মানিত লাগত। মনে হতো যেন পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণের মতো কোনও খেতাব পাচ্ছি।

যেমন ধরুন, ‘সিআইএ’-র দালাল। শুনলেই হৃদয় নেচে উঠত বর্ষার ময়ূরীর মতো। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর দেশ, তাদের দুনিয়া কাঁপানো গোয়েন্দা সংস্থা কিনা খুঁজে খুঁজে আমাদেরই নিয়োগ করেছে তাদের হয়ে দালালি করতে? আমরা এত কেউকেটা? আনন্দবাজারের পূর্বতন সম্পাদক সত্যিই সিআইএ-র দালাল কিনা তা নিয়ে একদা লোকসভায় সারাদিন ধরে বাগ-বিতণ্ডা হয়েছিল, অনেকেই সে কথা জানেন না। বলার কথা যেটা তা হলো, প্রফুল্ল সেনের মতো এক্ষেত্রেও যথাযোগ্য সম্মান জানিয়েই অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। ইচ্ছে করলে তাঁরা আমাদের ‘র’ কিংবা ‘আইএসআই’ কিংবা ‘মোসাদের’ দালাল বলে চিহ্নিত করতে পারতেন, করেননি। দালাল যদি বানাতে হয় সোজা সিআইএরই বানাও। বক্তব্য যাই হোক, দৃষ্টিভঙ্গিটা হতে হবে আন্তর্জাতিক। গাইবে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল আর পাড়ার পেঁচি পাগলির মতো খিস্তি দেবে, দুটো একসঙ্গে হবে না।

আরও পড়ুন- সাংবাদিক কি সাহিত্যিক হতে পারে : সুমন চট্টোপাধ্যায়

কিংবা ‘বুর্জোয়া শ্রেণিশত্রু’। খায় না মাথায় দেয় কোনও দিন ভালো করে বুঝতে পারিনি কিন্তু এই শব্দবন্ধের ঝঙ্কৃত লালিত্য প্রাণে খুশির তুফান তুলত। দেখেছ কেমন সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণের মতো গালি দিচ্ছে! আমি নিজেকে ‘লিবারেল বুর্জোয়া’ বলে বরাবর পরিচয় দিয়ে এসেছি, তাই আমার গায়ে লাগত না, মনে হতো সত্যি কথাই তো বলছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অতি পরিচিত এই শব্দগুলি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে অথচ বিকল্প শব্দকোষ এখনও তৈরি হয়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে পুনঃপুনঃ জোট করার পরে বুর্জোয়া শ্রেণিশত্রু বলে আর কাউকে ডাকা যায় না। ভাইজানের গলায় বিজয়মালা পরিয়ে দেওয়ার পরে ছেকুলারিজমের বুলি কপচানোও মুশকিল। তাহলে? কী আবার, চলো টুম্পাকে নিয়ে গঙ্গার হাওয়া খেতে যাই।

অভিজাত গালাগালে বরাবর অভ্যস্ত এখন আমাকে শুনতে হচ্ছে কী? না ‘মালটা চোর’ ‘কয়েদ খাটা’ ‘চটি-চাটা’ ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। এমন সব বালখিল্য গালাগাল যা শুনলে হাসি পায় না, রাগও ধরে না। আরে বাবা দেবভাষায় গালাগাল দেওয়ার কথা তো বলছি না, ইংরেজিতেও নয়, কেবল অনুনয় করছি পূর্বসূরিদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করুন। ভাবগম্ভীর গালাগাল দিন, জাতে ওঠার চেষ্টা করুন। কমিউনিস্টদের গালাগাল কমিউনিস্ট সুলভ হওয়া বাঞ্ছনীয়, অন্যথায় এমন পানসে খিস্তি দিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। আপনাদের মাথায় যদি যুৎসই খিস্তি না আসে, আমার সঙ্গে চুপিচুপি যোগাযোগ করবেন, আমিই বলে দেব। এই একটি কাজে আমিও রেড ভলান্টিয়ার হতে রাজি।

কথা দিচ্ছি, গোটা বিষয়টি আমি গোপন রাখব, পাঁচ কান করতে দেব না। এবার ভেবে দেখুন, আমার সঙ্গে জোট বেঁধে আমাকেই গাল দেবেন কিনা।

হে খিস্তিবাজগণ, সোশাল মিডিয়ায় দৃশ্যপটের আড়ালে থেকে আপনারা যে কাজটি করেন, শশী থারুর তার নামই দিয়েছিলেন ‘ল্যালোচেজিয়া'। মানে অন্যকে গালাগাল দিয়ে আত্মরতির সুখ পাওয়া। এই বিশেষ ব্যাধিতে আক্রান্ত যাঁরা আমাকে রোজ গালাগাল করেন, মঙ্গলগ্রহে জলের অস্তিত্ব নিয়ে লিখলেও কমেন্ট বক্সে মাথাটা গলিয়ে আমার কয়েদ-বাস নিয়ে খোঁটা দেন, রীতিমতো গবেষণা করে দেখেছি তাঁরা প্রায় সবাই ফেসবুক-লালফৌজ, লড়াইয়ের মাঠে ফেরারি ফৌজ। আমাকে গালাগাল দিলে কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীর যদি রাতে শোয়ার আগে ইশবগুল বা পেটসাফা খাওয়ার প্রয়োজন না হয়, সে তো উত্তম কথা, পরোপকার। কারও যদি গায়ের খোস-পাঁচড়ায় একটু আরাম বোধহয় তাতেই বা ক্ষতি কী? আমাকে যাঁরা বেশি খিস্তি করেন তাঁদের হৃদয়-বেদনা বুঝতে না পারার মতো মর্কট আমি নই।

ইদানীং লাল-পিঁপড়ের কামড় খানিকটা হলেও কমেছে, তাদের শূন্যস্থান পূরণ করেছে ভাইপো-ব্রিগেড। তারা একেবারে কাঁচা খিস্তি দেয়, একেবারে নাদান, অপরিণত বুদ্ধি, বোধ। বোঝাই যায় লেখাপড়াও যৎসামান্য। যেমন গুরু তেমনি চ্যালা, এই আর কী!

আরও পড়ুন- পথই হয়তো পথ দেখাবে: সুমন চট্টোপাধ্যায়

দয়া করে গালাগালির গুণমানটা একটু উন্নত করুন। চল্লিশ বছর ধরে আমি আপনাদের প্রিয় চাঁদমারি ছিলাম, আছি, পট করে পটল না তুললে থাকবও। এহ বাহ্য। এক ঝাঁক নোংরা খিস্তির মধ্যে কেউ কেউ আবার ভিখিরিকে রুটি ছোঁড়ার স্টাইলে উপদেশ ভাসিয়ে দেন শব্দ-তরঙ্গে। সম্প্রতি অনেকেই যেমন বলছেন, "দাদা, শিরদাঁড়াটা সোজা রাখুন!"

জগতে নব্বই শতাংশ প্রাণীকূলের শিরদাঁড়া নেই, তারা দিব্যি মহানন্দে বেঁচে বর্তে আছে। তাহলে শিরদাঁড়া থাকা না থাকা নিয়ে এমন অহেতুক উত্তেজনা কেন? হোয়াট ইজ দ্য বিগ ডিল!

তাছাড়া আমার শিরদাঁড়া এমনিতেই নড়বড়ে, মাঝেমধ্যে পিঠের অসহ্য যন্ত্রণায় তা মালুম হয়। কয়েক বছর আগে এমন বেদনাদায়ক স্লিপ-ডিস্ক হয়েছিল, কয়েকদিন এক পা হাঁটতেও পারিনি। ডাক্তারবাবু অপারেশন করিয়ে নিতে বলেছিলেন, আমি ভয়ে রাজি হইনি। একটাই তো বাঁকা শিরদাঁড়া, সেটাও যদি ভোগে চলে যায়?

ছেষট্টি ছুঁই ছুঁই বছর বয়সে শিরদাঁড়া সোজা রাখাটা আমার পক্ষে স্বাস্থ্যগতভাবেই অসম্ভব, সেই ঝুঁকিও আমি নেব না। শত প্ররোচনা দিলেও।

এই ঘোর-কলিতে শিরদাঁড়া অথবা মেরুদণ্ড একেবারেই অচল। যেমন সত্য অচল, তথ্য অচল, বিজ্ঞান অচল, প্রশ্ন অচল, যুক্তি অচল, মুক্তি অচল, শিক্ষা অচল, সংস্কৃতি অচল, প্রয়োজনাতিরিক্ত কৌতুহলও অচল। চারপাশে তাকিয়ে দেখুন সবাই কেমন যৌনরোগের মতো মেরুদণ্ড লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, এর অস্তিত্ব স্বীকারই করছে না। মানুষরূপী সরীসৃপে ভরে গিয়েছে চরাচর। ময়দানে নেমে মেরুদণ্ড দেখানোর সাহস নেই যাদের তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই ফেসবুকে বিপ্লব করছেন, যাকে অপছন্দ তাকেই অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছেন, পারলে চারটে জ্ঞান বিতরণও করছেন। ভার্চুয়াল বিশ্বে আত্মগোপন করে যারা গালিগালাজ করেন তারা রয়েছেন মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ দলের প্রথম সারিতে।

আরও পড়ুন- হামদি বে: একটি স্বপ্নের জন্ম ও মৃত্যু

এটাই যখন হকিকৎ, সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে এই বেঁড়ে বেটাকে মেরুদণ্ড প্রদর্শনের হিতোপদেশ শোনানো কেন? আপনাদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি? কার কী ক্ষতি করেছি? আমি সফট টার্গেট বলে এত চুলকানি? এটাও আসলে নিজে অক্ষমতা ঢাকার অচেতন প্রয়াস, আমি যে কাজ পারব না বা করব না অন্যে সেটা করে দেখাক! মামার বাড়ির আবদার আর কাকে বলে!

ন্যাড়া একাই বারেবারে বেলতলায় যাবে কেন? মুণ্ডিত মস্তক বলে তার ঘটে কি এতটুকুও বুদ্ধি থাকতে নেই? দুনিয়া কতটা নির্মম, একাকী লড়াই কতটা অসহনীয় ন্যাড়ার কি সেই শিক্ষা হয়নি? মেরুদণ্ড দেখতে পেলেই দণ্ড দেওয়ার জন্য বাহিনী তৈরি আছে, কম-বেশি গোটা দেশেই। মেরুদণ্ডহীন নাগরিক সমাজ দেখতে দেখতে নানা রঙের শাসককূল এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে অন্যথা দেখলে তারা শায়েস্তা করবেই। তারা বুঝে গিয়েছে হাজতের নির্বাসনে থাকা বেয়াদপকে কেউ প্রকাশ্যে সমর্থন করার হিম্মত দেখাবে না, কুষ্ঠরোগীর মতো তাকে এড়িয়ে চলবে, বরং কিছু লোক পিশাচের মতো উল্লাস করে নিপীড়নকে এক ধরনের বৈধতা দিয়ে দেবে। কোনটা সত্য আর কোনটা অসত্য তা জানার বা বোঝার মতো ক্লেশ কেউ স্বীকার করবে না। ফলে মিথ্যা পেয়ে যাবে সত্যের স্বীকৃতি, সত্য চলে যাবে কালাধারে। ভুক্তভোগীর সঙ্গে সহবাস করবে কেবল অপবাদ, চিতায় ওঠা পর্যন্ত সঙ্গ ছাড়বে না।

আমি অতএব, মেরুদণ্ডটা ব্যাঙ্কের ভল্টে তালাবন্দি করে রেখে দিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়েছি। সুখ পাইনি, স্বস্তি পেয়েছি, এইটুকুই এই মুহূর্তে আমার পক্ষে যথেষ্ট। আপনারা হাসতে পারেন, ক্রুদ্ধ হতে পারেন, আরও চারটে নতুন খিস্তি দিতে পারেন, চাইলে করুণাও করতে পারেন, আমি নির্বিকল্প সমাধি থেকে একচুলও নড়ব না। স্বর্গের ঊর্বশী এসে প্রলুব্ধ করলেও নয়।

জীবনে যত পরীক্ষা দিয়েছি তার মধ্যে এটা সবচেয়ে দুরূহ। সচেতনভাবে নিজেকে বদলে ফেলা। মেটামরফোসিস। যা কোনও দিন ছিলাম না, থাকার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, এখন সেই রূপ ধারণেরই প্রাণপণ প্রয়াস করে যাচ্ছি। বীরপুরুষি অনেক হলো, এবার একজন সাচ্চা কাপুরুষ হওয়া যাক। আজকের বাজারে কাপুরুষেরাই আসল মহাপুরুষ। হাতে বেশি সময় নেই তবু এমন একজন কাপুরুষ হতে পারাটাই আমার জীবনের অন্তিম লক্ষ্য।

 

More Articles