উত্তরপ্রদেশ কী করে মেরুকরণ রাজনীতির সূতিকাগার হলো?
মহাত্মা গান্ধীর আত্মবলিদানের বছর খানেকের মাথায়, সদ্য স্বাধীন ভারত ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস থেকে পুরোদস্তুর প্রজাতন্ত্রে উত্তীর্ণ হবে কি হবে না, এই প্রশ্নে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যে একটা বড়সড় মতভেদ তৈরি হয়। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের শেষ পর্বের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে নেহরু এবং প্যাটেলের মধ্যে মতভেদ ছিল সুবিদিত। নেহরু ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক। আর রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক ছিল সর্দার প্যাটেলের। আরএসএস, হিন্দু মহাসভার যে অবস্থান, সেই অবস্থানের সঙ্গে সর্দার প্যাটেলের অবস্থানের খুব একটা ফারাক কিছু ছিল না। বহু ক্ষেত্রেই গান্ধীজীর ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের সঙ্গে প্যাটেলের মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু কৌশলগত কারণেই প্যাটেল নেহরুর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিজের ভাবনা স্বাধীনতার আগে আনলেও, গান্ধীজির সঙ্গে প্রকাশ্যে তেমন একটা সংঘাতে প্যাটেল যাননি।
মহাত্মার মৃত্যুর পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের ভূমিকা ঘিরে প্রশ্ন তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এবং বিয়াল্লিশের বিপ্লবীবীর জয়প্রকাশ নারায়ণ। এইরকম একটি পরিস্থিতির ভিতরে ব্রিটেনের রাজার ডোমিনিয়ন মর্যাদাকে ঘিরে ভারতের গভর্নর জেনারেলের পদকে রাষ্ট্রপতির পদে উত্তীর্ণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। এই ক্ষেত্রে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর পছন্দ ছিল, প্রথম গভর্নর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীকে। বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী ভিতরে যে আধুনিক নাগরিক দিকটি ছিল, সেটি সদ্য স্বাধীন ভারতের পক্ষে অত্যন্ত ইতিবাচক হবে মনে করেই , তাঁকে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে চেয়েছিলেন নেহরু। তাঁর সঙ্গে রাজাগোপালাচারীর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল।
কিন্তু সর্দার প্যাটেল কোনো অবস্থাতেই চাননি ,আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। এই কারণে কংগ্রেসের ভিতরকার সাম্প্রদায়িক লবিকে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তিনি চেয়েছিলেন গণপরিষদের সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদকে। জাতীয় আন্দোলন চলাকালীন কংগ্রেসের ভেতরে রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতেন সর্দার প্যাটেল। রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন তার মধ্যে অত্যন্ত বিশিষ্ট এক ব্যক্তিত্ব। কংগ্রেসের ভিতরে তখন হিন্দু সাম্প্রদায়িক লবির এতটাই প্রাধান্য যে, প্রধানমন্ত্রী নেহরু চাইলেও উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের ইচ্ছেকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। ফলে কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ কমিটিগুলিতে রাজেন্দ্রপ্রসাদের নামটিকে রাজাগোপালাচারী নামের জায়গায় অনুমোদন করিয়ে নিতে সর্দার প্যাটেলের পক্ষে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।
আরও পড়ুন-নিজের বেডরুমেই ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের!
অন্য দিকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাজাগোপালাচারী মনোনীত করার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি, সেটা রাজাগোপালাচারী আগে জানিয়েছিলেন নেহরু। সর্দার প্যাটেলের কৌশলের কাছে তাঁকে পরাস্ত হতে হয়। ফলে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী কাছে অত্যন্ত অপদস্ত হতে হয় ।আর এই অপদস্ত হওয়ার দরুণ নেহরু অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আজ উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি সামনে তুলে আনছে, তাঁর পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরিতে স্বাধীন ভারতের কী ভাবে ধীরে ধীরে পটভূমির বিস্তার ঘটেছিল ,তা মনে রাখার জন্য কিন্তু আমাদের এই সময়কালের এই সব কর্মকাণ্ড দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার। প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে উত্তরপ্রদেশে মেরুকরণের রাজনীতিকে তীব্র হয়ে উঠছে। ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করতে পেরেছে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। যার প্রভাব ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে পড়েছে। বিজেপি র কেন্দ্রে ক্ষমতায় যাওয়ার পেছনে উত্তরপ্রদেশ একটা বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে এটা ভুললে চলবে না।
রাজনৈতিক মেরুকরণের পরিবেশ-পরিস্থিতি কিন্তু উত্তরপ্রদেশে একদিনে হঠাৎ ঘটেনি। বিজেপি একাও সেই জায়গাটা তৈরি করতে পারেনি। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, একটা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে দীর্ঘকাল ধরে করে এসেছে, উত্তরপ্রদেশকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতির সূতিকাগার পরিণত করার জন্য সেইসব রাজনীতিকদের অবদান কোনো অংশে কম নয়।দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে নিজের প্রার্থী রাজেন্দ্র প্রসাদকে জেতানো পরে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে নেহরুর মতো সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী কংগ্রেসের নেতাদেরকে চাপে রাখবার জন্য সর্দার প্যাটেলের দ্বিতীয় কৌশল ছিল কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচন। সেই নির্বাচনে সর্দার প্যাটেল চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নেহরুর ব্যক্তিগত স্তরের বন্ধু, তাঁর নিজের শহর এলাহাবাদ, যেটাকে আজ বিজেপি প্রয়াগরাজ নামে এক ধর্মের রাজনৈতিক সূতিকাগৃহে পরিণত করেছে, সেই শহরের মানুষ, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডনকে ।
ব্যক্তি নেহরুর বন্ধু হলেও আদর্শগত দিক থেকে ট্যান্ডনের সঙ্গে কিন্তু নেহেরুর এতটুকু মিল ছিল না । রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব কংগ্রেসের যে অংশটা করে চলেছিল ,ট্যান্ডন ছিলেন সেই শিবিরেরই অন্তর্ভুক্ত একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা সহ কোন কিছুর সঙ্গেই আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাভাবনার মানুষ, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক নেহরুর এতটুকু সাদৃশ্য ছিল না। ট্যান্ডন ছিলেন একজন ঘোরতর মুসলমান বিরোধী, বর্ণহিন্দুপন্থী ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনার ধারক বাহক। ধসে যাওয়া এক সামাজিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের সমর্থক।
তাঁকে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তুলে ধরে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক নেহরুকে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার যে বিপদ আজ গোটা ভারতবর্ষে খেয়ে ফেলেছে, তাঁকেও উস্কে দিতে চেয়েছিলেন। পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন এই ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে কিন্তু ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার মতোই উগ্রভাবে সমর্থন করতেন।
আরও পড়ুন-৩২৫ রকম কায়দায় শাড়ি পরাতে পারেন! বলিউড তারকারাও কুর্নিশ করেন ডলিকে
ভাষা ভিত্তিক বিভাজনকেও আরএসএস ,বিজেপি আজকের ভারতবর্ষে যে ভাবে প্রয়োগ করতে চাইছে ট্যান্ডন তাদের পূর্বসূরি। ভারতের বুকে বলপূর্বক হিন্দি চাপিয়ে দেবার জন্য যারা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত কলঙ্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন হলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। বলপূর্বক গোটা ভারতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা ছিল ট্যান্ডনের। আর নেহরু তার তীব্র বিরোধী ছিলেন। পন্ডিত নেহরু প্রকাশ্যে ট্যান্ডনের এই বলপূর্বক হিন্দি চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা সমালোচনা করেছিলেন শুধু তাই নয়, এলাহাবাদে এক সমাবেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শোধ তোলবার কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। সমাবেশটি ছিল উদ্বাস্তুদের। উদ্বাস্তুদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার নাম করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আরএসএসের পাশাপাশি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ এই সাম্প্রদায়িক শক্তির কী ভয়ঙ্কর ভূমিকা ছিল,তা ভাবলে আমাদের শিউরে উঠতে হয় ।
এলাহাবাদের উদ্বাস্তু সমাবেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথা এবং সংখ্যালধু বিরোধী উস্কানির ঘটনায় অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিলেন নেহরু। এই সময়কালে নেহেরু বারবার বলছিলেন, ভারতের কিন্তু সেই সময়ের প্রয়োজন ছিল কোমল হাতে শুশ্রূষার । হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে একটা মিলনের সেতুবন্ধনের জন্য জোরদার নীতি। তাই এই ধরনের মানুষ কংগ্রেসের সভাপতি হলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন একটা বড় রকমের বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেবে এবং দেশভাগে দীর্ণ সংখ্যালঘু সমাজের কাছে অত্যন্ত ভুল একটি বার্তা যাবে, নিজের দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাকে তুড়ি মেরে সত্যের প্রয়োজনে এই কথা প্রকাশ্যে বলতে কিন্তু পন্ডিত নেহরু সেদিন দ্বিধা করেননি ।
আজকের ভারত যখন সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের যুগে প্রবেশ করেছে, তখন সদ্য স্বাধীন ভারতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, রাজেন্দ্র প্রসাদ, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, বসন্ত শ্রীহরি আনে প্রমুখদের যে ভূমিকা এবং সেই ভূমিকা মোকাবিলা করার জন্য পন্ডিত নেহরুর আন্তরিক প্রয়াস, তার কথা যদি আমরা ভুলে যাই, তাহলে সঠিক ইতিহাসবোধের জায়গা থেকে আমরা দূরে সরে যাব।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)