বাথরুমে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল উত্তমকুমারকে! কী ঘটেছিল সেদিন
Uttam Kumar: সংগীত পরিচালক হিসেবে কীভাবে অভিষেক হলো মহানায়কের?
অরুণ চাটুজ্জে বাঙালি জীবনের এতখানি জুড়ে রয়েছেন, যে তাঁর কথা একবার উঠলে থামা মুশকিল। কোনও মতে একটা আড্ডার ফাঁক গলে একবার ঢুকে পড়তে পারলে সমস্তটাই দখল করে ফেলতে তাঁর কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে। নিজের জীবনে অভিনয়ের বাইরেও একটা সময় পর্যন্ত নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চা করতেন। চমৎকার ব্যাডমিন্টন এবং টেনিস খেলতেন। আর ছিলেন অতি দক্ষ সাঁতারু। বেশিরভাগ বাঙালির কাছে পর্দার উত্তম নিকটাত্মীয়। আবার পর্দা অতিক্রম করেও তাঁর কাছের লোক কিছু ছিল। প্রতিটি ব্যক্তিরই নিজস্ব বৃত্ত থাকে। উত্তমকুমার তার ব্যত্যয় নন। সেই বৃত্তে আলো সরকার নামের বিষাক্ত চাটুকার যেমন ছিল, তেমনই ছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ ঘোষের মতো অকৃত্রিম বন্ধুও। অনেকেই জানেন, উত্তমকুমার খুব ভালো গান করতেন। ছবির গানে লিপ দেওয়ার সময়ও ব্যাপারটা ধরা পড়ত। গলার শিরা থেকে মুখের চলন—অমন লিপ সিঙ্ক বাংলা সিনেমায় আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু জানেন কি, ভদ্রলোক সংগীত পরিচালনাও করেছেন! শুধু তাই নয় গানের চিত্রায়ণ নিজে করে বাংলা সিনেমায় এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন উত্তম। আজকের আড্ডায় যিনি চায়ের দোকানের কোনে খোঁড়া বেঞ্চটায় এসে আলগোছে বসবেন, তিনি অভিনেতা উত্তম নন, সংগীত পরিচালক উত্তমকুমার।
তিরিশ বছরের তারকাজীবনে মাত্র দু'টি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন উত্তম। তার একটি শচীন মুখোপাধ্যায়ের 'কাল তুমি আলেয়া', আরেকটি পীযূষ বসুর 'সব্যসাচী'। তবে প্রথমটির ক্ষেত্রে উত্তমকে দিয়ে সংগীত পরিচালনা করিয়ে নিতে হয়েছিল। সে এক কাণ্ড! উত্তমের ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে তখন সপ্তাহান্তে আসর বসত। কিঞ্চিৎ গান, কিঞ্চিৎ পান, আর খাওয়াদাওয়া নিয়ে সেই আসরে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠতেন মহানায়ক।
সময়টা ছয়ের দশকের মাঝামাঝি। 'নায়ক'-এর কাজকর্ম শেষ। 'ছোটি সি মুলাকাত'-এর পরিকল্পনা চলছে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝেমধ্যেই যেতেন সেই আড্ডায়। পুলকের বড়দির ছেলে ছিলেন উত্তমের বন্ধু। সেই সূত্রে উত্তম তাঁকে 'মামা' বলে ডাকতেন। সেদিন পৌঁছতে গীতিকারের একটু দেরি হয়েছে, গিয়ে দেখেন আসর শুরু। উত্তম তাঁকে দেখেই, "আরে মামা, এসো এসো!" বলে ডেকে বসালেন। দেবেশ ঘোষও ছিলেন সেখানে। প্রযোজক। গীতিকারের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র। উত্তম ইতিমধ্যে হারমোনিয়াম টেনে নিয়েছেন। সন্ধের আকাশ সবে জানলা চুঁইয়ে ঘরের ভেতরে, সেই আবেশকে পাকের পর পাকে জড়িয়ে নিচ্ছে ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠের গান। সেসব গানের খানিক আজকাল আন্তর্জালে পাওয়া যায়। কিন্তু সামনাসামনি উত্তমের গান শোনার সুযোগ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা বাড়াবাড়ি রকমের প্রিভিলেজড বইকি! সেই গলে আসা সন্ধ্যায় বাড়িতে সুরের জালে আগুন লেগে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: উত্তমের পা জড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন সৌমিত্র! কেমন ছিল দু’জনের সম্পর্ক
ধীরে ধীরে গানে-কথায়-আড্ডায় সন্ধ্যা জমে রাত হয়ে আসে। অতিথিরা সব একে একে বাড়িতে ফেরেন। পুলকবাবু, দেবেশ ঘোষ আর উত্তম গান-আড্ডায় বিভোর। গানটান সেরে উত্তম একটু টয়লেটে গিয়েছেন, সেই ফাঁকে গীতিকার দেবেশকে ডেকে বললেন, "তোমার নতুন ছবি 'কাল তুমি আলেয়া'-র গান আমাকে দিয়ে লেখাবে বললে, কিন্তু মিউজিক ডিরেক্টর কে?"
তাই তো! দেবেশ ঘোষের এতক্ষণে খেয়াল হলো, সংগীত পরিচালক কাউকেই ভাবা হয়নি। হঠাৎ কী খেয়াল হলো, একদৌড়ে টয়লেটের বন্ধ দরজার সামনে। প্রথমে ডাকাডাকি, তারপর রীতিমতো দরজায় ধাক্কা। চেঁচাচ্ছেন, "এই উত্তম, তুই আমার 'কাল তুমি আলেয়া'-র মিউজিক ডিরেক্টর— তুইই আমার 'কাল তুমি আলেয়া'র মিউজিক ডিরেক্টর! যতক্ষণ না 'হ্যাঁ' বলবি ততক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাব।" গীতিকারের মাথায় হাত। কথাটা বলেই ভুল করলেন নাকি! উত্তমেরও অবস্থা তথৈবচ। কী আপদ! শেষে ভেতর থেকে মৃদু গলায় কী বললেন শোনা গেল না, কিন্তু তাতেই কাজ হলো। দেবেশ আশ্বস্ত হয়েই যেন ফিরে এসে গীতিকারের পাশের সোফাটায় ধপ করে বসে পড়লেন।
দরজা আটকিয়ে, দুমদাম ধাক্কা দিয়ে রাজি তো করানো গেল, কিন্তু মিউজিক সিটিং হবে কখন! ওখান থেকে ফেরার সময় পুলকবাবু সেকথা জিজ্ঞেস করতেই উত্তম তাঁর সেই বিখ্যাত হাসিটি হেসে বললেন, "আমি তোমাকে খবর দেব।" দেবেশ ঘোষ উত্তমকে দীর্ঘদিন চেনেন। হাসিটি দেখে তাঁর খুব একটা সুবিধের ঠেকল না। তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, "খবর? খবর আবার কী দিবি? পরশু রবিবার। সকালে এখানে 'স্ক্রিপ্ট' নিয়ে আসছি। তুই তো স্ক্রিপ্ট শুনেছিস— মামাকে সিচুয়েশনগুলো বুঝিয়ে দিবি। ব্যস!" আবার সেই হাসি। মুখে কিছুই বললেন না উত্তম। কথামতো রবিবার গীতিকার হাজির। দেখা গেল, দেবেশ ঘোষ আগেই এসে গিয়েছেন। স্ক্রিপ্ট পড়লেন। সিচুয়েশনগুলো নিয়ে দিব্য আলোচনা হলো। গোটা ছবিতে তিনটিই মাত্র গান। একটা বাইজির কণ্ঠে, একটা সাধারণ এক যৌনকর্মীর কণ্ঠে, আর তৃতীয়টা নেপথ্যে বাজবে। সেটার সিচুয়েশন অত্যন্ত চমৎকার, কিন্তু হবে প্রচলিত কথায় আর সুরে। কাজেই গীতিকারের বা উত্তমের কিছু করার নেই। একথা-সেকথায় গীতিকার ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করলেন, "কীভাবে সুর করবে তুমি? সুরের ওপর লেখাবে না কথার ওপর সুর করবে?" পেশাদার সুরকারের ভঙ্গিতে উত্তম জবাব দিলে— "দুটোই। দুরকমভাবেই করে দেখব— যেটা ভালো দাঁড়ায়।" গীতিকার চমৎকৃত। বাহ্! ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে তাহলে। সেদিনই পরের সিটিংয়ের তারিখ ঠিক হলো। চলে এলেন সবাই।
পরের দিন দু'খানা গান বগলদাবা করে 'মামা' পৌঁছলেন 'ভাগ্নে'-বাড়ি। দেখাই যাক, কী করে! সুরের ওপর লেখায়, না কি কথায় সুর তোলে! তা ভাগ্নেটি মামাকে একটু বসতে বলে বাড়ির ভেতর বেপাত্তা। কে এক ভদ্রলোক এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কাজের কথা। মামা ঘরের লোক। অকাজের মানুষ। সেই ভদ্রলোক চলে গেলে আবার একজন এলেন। মামা অধীর আগ্রহে ঘড়ি দেখছেন। কিন্তু উত্তম আর আসেন না। সেই ভদ্রলোকও এক সময় গেলেন। এবার গীতিকার একটু নড়েচড়ে বসলেন। এই বুঝি ভাগ্নের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। কোথায় কী! আরও দু'জন ভদ্রলোক এলেন। তাঁদের কথাও এক সময় ফুরলো। এভাবে প্রায় ঘণ্টাদেড়েক বাদে উত্তম এই ঘরে এসে বললেন, "মামা, বলো, কী ব্যাপার?"
কী ব্যাপার মানে! আগের দিন তারিখ ঠিক হলো যে! গীতিকার অবাক। বললেন, "'কাল তুমি আলেয়া'-র গান লিখে নিয়ে এসেছি, দেখবে? কথার ওপর সুর করবে—না, সুর দেবে আমি লিখব?"
এইবারে আসল বোমাটি ফাটালেন উত্তম। মুখে সেই হাসি। "তোমার কি মাথা খারাপ? আমি মিউজিক ডিরেক্টর হব? দেবেশকে অনেক সময় অনেক কিছুই বলতে হয়। আমার 'ছোটি সি মুলাকাত'-এর ডেট পড়েছে বম্বেতে। আমি এখন আমার প্রোডাকশন ভাবছি। তুমি শুধু শুধু কষ্ট করে এলে, সরি!"
কী আর করেন! গান নিয়ে ফিরে এলেন পুলক। পরের দিনই দেবেশের ফোন, "উত্তম গান নিয়ে বসেছিল?" সবটাই খুলে বলতে হলো। এই খামখেয়ালিপনা ভাগ্নের নতুন না। সব শুনে দেবেশ বললেন, "আচ্ছা। ঘণ্টাখানেক বাদে আমি তোমায় আবার ফোন করছি।"
যথাসময়ে সেই ফোন এল। জানা গেল, ফের কাল সকালে সিটিংয়ে বসতে রাজি উত্তম। একটুও দেরি না করে গীতিকার যেন চলে যান। কিন্তু পুলকবাবুও ভাগ্নেটিকে কমদিন দেখছেন না। তবু গেলেন এতখানি পথ ড্রাইভ করে। সেই একই কথা। উত্তম মিউজিক ডিরেক্টর হতে পারবেন না। এই 'ছোটি সি মুলাকাত' ফ্লপের ব্যাপারটা অনেকেই জানেন। উত্তমের শরীরের ওপর সারাজীবনের মতো ছাপ ফেলে গিয়েছিল সেই ব্যর্থতা। আর প্রথম বম্বে ডেবিউতে পরিচালনার ভার দিয়েছিলেন সেই চাটুকার আলো সরকারের ওপরে। যিনি জীবনে কখনও ছবি পরিচালনা করেননি। আলো সরকার উত্তমের যা ক্ষতি করেছেন, সে তো করেইছেন, তাঁর চক্করে সংগীত পরিচালক উত্তমকেও আমরা হয়তো পেতাম না। কিন্তু দেবেশ ঘোষের মতো বন্ধুই সেই কেলেঙ্কারির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন উত্তমকে।
যাই হোক, এবার দিনদুয়েক পরে দেবেশ যখন পুলক বন্দ্যোকে ফোন করলেন, গীতিকার আগেভাগেই বলে রাখলেন, "এবার যে-দিনটা ঠিক করবে সেদিন তুমিও উপস্থিত থাকবে।" এল সেই নির্ধারিত দিন। মামার মন সারাটা পথ কু ডাকে। নিশ্চিত আবার ফিরে আসতে হবে। কিন্তু গিয়ে দেখা গেল, সমস্ত কাজ ফেলেটেলে দেবেশ হাজির। মামাকে দেখে ভাগ্নের সেই হাসি! কিন্তু দেবেশের সামনে সেসব কোনও কাজে লাগল না। সঙ্গে সঙ্গে বললে, "কই, গান পড়ো।" গীতিকার বললেন, "দাঁড়াও। হারমোনিয়ামটা বের করুক।" নামবেন যখন আঁটঘাট বেঁধেই নামবেন। উত্তমের স্কেল-চেঞ্জ হারমোনিয়ামটা একজন এঘরে দিয়ে গেল। দেবেশ সঙ্গে সঙ্গে হুকুম করলে, "এই মাদুর পাতো। মাদুরে না বসে গান গাওয়ার মেজাজ পায় না উত্তম।" মেঝেতে মাদুর পাতা হলো। তার ওপর হারমোনিয়াম রাখা হলো। উত্তম তখনও সোফায়। কোনও কথা বলার সুযোগই পাচ্ছেন না। হয়তো মনে মনে গালও দিচ্ছেন একচোট। শেষে দেবেশের চোটপাটে তাঁর দিকে একটা বাঁকা নজর চালিয়ে নামলেন মাদুরে। একরকম বাধ্য হয়েই। 'জয় দুর্গা' বলে মামাও সোফা থেকে মাদুরে নামলেন।
এসপার কি ওসপার আজ একটা হয়ে যাবে। এতক্ষণে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান চাইল ভাগ্নে। পুলকবাবু প্রথমে দিলেন, 'একটু বেশি রাতে'। বারকতক পড়লেন উত্তম। তারপর সুর করতে শুরু করল। সুরের অ্যাপ্রোচ দেখে ঘরের বাকি দু'জন মুগ্ধ। সিচুয়েশনে এর থেকে ভালো সুর আর হয় না। সুর দিতে দিতে মজে গিয়েছেন উত্তম বিভোর হয়ে গাইছেন। এদিকে মামা টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে রাখছেন সেই গান। জানেন, পরে আর সুর মনে থাকবে না উত্তমের। গান শেষ হলে আবার টেপে শোনা হলো। চমৎকার হয়েছে। সকলেরই বেশ পছন্দ। এতক্ষণে হম্বিতম্বি ছেড়ে দেবেশের একগাল হাসি। "দেখলে তো! আমি আসতেই কাজ হয়ে গেল। তোরা কেউই কোনও কম্মের নোস।" মামা ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। সত্যকথন। দেবেশ না হলে বাথরুমের দরজা আটকিয়ে বা বসার ঘর হাইজ্যাক করে উত্তমকে দিয়ে সুর দেওয়ানোর ক্ষমতা তাঁর হতো না। পরের গানটার জন্য আরেকটা তারিখ এবার উত্তম নিজে থেকেই দিলেন। বোঝা গেল, বাঘ এবার রক্তের স্বাদ পেয়েছে।
পরের দিন কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল আত্মবিশ্বাসে 'পাতা কেটে চুল বেঁধে কে টায়রা পরেছে/ কে খোঁপার পাশে পাশ চিরুনি বাহার করেছে' সুর করে ফেললেন উত্তম। দেবেশ তো দারুণ খুশি! "মামা দারুণ লিখেছে। আজ আমি তোদের খাওয়াব।"
—খাওয়াবে তো বলছ। কিন্তু উত্তমকে ওই ব্যাকগ্রাউন্ড সিচুয়েশনটা দাও। নইলে সুরশিল্পী উত্তমকে লোকে ঠিকমতো বুঝবে কেন?
এইবার মামার পাশার দান। হুঁ হুঁ বাওয়া! এতদিন ফিরিয়েছ। এইবারে ঘুঘু তব…। উত্তমকে দিয়ে রেকর্ডে গাওয়ানোরও দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল পুলকের। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি কোনও দিন। যাই হোক, আরেকটা গানের কথা ওঠায় উত্তম ভীষণ আপত্তি করে উঠল, "না না, ওটা প্রচলিত গানই থাক। আমার সুরে এ-দুটো গানই ভালো।" কিন্তু সেদিন মামা সবদিক গুছিয়েই নেমেছেন। সিচুয়েশন অনুযায়ী একটা গান কাগজে লিখে এনেছিলেন। বাড়িয়ে দিলেন। "দারুণ মুডে রয়েছ তুমি। কতক্ষণই বা লাগবে সুর করতে। চেষ্টা করো না একটু।" বেশ। তাই সই। নিমরাজি হয়ে উত্তম বেলো টেনে একটা কর্ড চেপে ধরলেন। কয়েকবার পড়লেন গানটা। তারপর কী মনে হলো, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে বললেন, "শোনো তো মামা— সলিলদার 'আজা রে আ, নিন্দিয়াঁ তু আ' গানটার সুরের স্টাইলটা একটু নিয়ে যদি করি, জমে যাবে মনে হচ্ছে।"
এই হয়। ছিল প্রচলিত গান ব্যবহারের কথা। মামার পাশার দানে সেইদিন উত্তমের ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে যে গানটি তৈরি হল, তার ঐতিহাসিক জন্মলগ্নের সাক্ষী থাকলেন দু'জনমাত্র মানুষ। পুলক বন্দ্যো এবং দেবেশ ঘোষ। জানলার এপার আর ওপার। বাইরে অজস্র যানের আওয়াজ। কলকাতার চিরাচরিত ব্যস্ততা। ছোটাছুটি। ভেতরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে মহানায়ক গাইছেন— "যাই চলে যাই/ আমায় খুঁজো না তুমি/ বন্ধু বুঝো না ভুল/ কাল সে আলেয়া শুধু/ আমি সে আলোর ঝরা ফুল/ আমি যাই চলে যাই/ যাই চলে যাই।" মাত্র একটি মাত্র দেওয়ালের তফাতে শহরের যাবতীয় ক্যাকোফোনি শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে। আবেশে বুজে আসছে চোখ। সেই পলকের নিচে বিদায়বার্তার বেদনা। বেদনা ছাড়া গভীরতার খোঁজ কে কবে হাসিল করেছে! এক সময় গান শেষ হলো। সবাই চুপ। অনুরণন তুলছে ঘর স্বয়ং যেন। পুলকবাবু বললেন, "দেখলে তো কেমন অপূর্ব একটা গান করে ফেললে। তোমার দ্বারা অসম্ভব কী? তুমি ইচ্ছে করলে কী না করতে পারতে!" উচ্ছ্বাসে আগের যাবতীয় অভিমান কোথায় ভেসে চলে গেল। সুরের জগতে পা রাখলেন মহানায়ক। রাজার মতোই। শুধু তাই নয়, এই ছবিতে প্রতিটি গানের দৃশ্যায়ন তিনি নিজে করেছিলেন। এর আগে অবধি এই দায়িত্ব ছিল পরিচালকের। কিন্তু সংগীতের দৃশ্যায়ন যে আলাদা ভাবে করা যায়, বাংলা ছবিতে সেই ধারা উত্তমের হাতেই শুরু হলো। সেদিক দিয়ে বলা যায়, বর্তমানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট গানের যেভাবে দৃশ্যায়ন হয়, সেই পরিচালনার পথপ্রদর্শকও ছিলেন উত্তমকুমার। এও তাঁর বিশাল কর্মতালিকায় রইবে বইকি!
ছায়াছবিটির নেপথ্যে এই গান গেয়েছিলেন হেমন্ত। ক্লোজ শটে মহানায়কের চোখে জল। পাশে সুপ্রিয়া। বিছানায় শায়িত বৌদির (সাবিত্রী) মৃতদেহ। এই একটিমাত্র গান, যাকে হেমন্ত নিজের করে তুলতে পারেননি। ছবির গল্প যে পথেই যাক, সময়ের ফের যে মোচড়ই আনুক না কেন, এ গান যেন উত্তমের নিজস্ব। যে বিপুল ভার ওই দু'টি কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছেন তিন-তিনটি দশক, তা নিংড়ে উঠে আসে এই সুর। অথচ তখনও কতখানি পথচলা বাকি! চিতার আগুন। ক্যামেরা জুম আউট করছে। সিঁড়ির ওপর দুই হাতে মুখ ঢেকে মহানায়ক। একটু একটু করে পুড়ে যাচ্ছে বুক, চোখ, সেই হাসি। মোটা ফ্রেমের আড়ালে পুড়ে যাওয়া ক্লান্ত দু'টি চোখ কেউ দেখতে পাচ্ছে না। অথবা দেখার তাদের উপায়ও ছিল না। তাদেরও তো রুজিরুটি, তাদেরও সংসার।
এই ছবির পর একটি বনবাস। চোদ্দোটি বছর। মাত্র। দেখতে দেখতে হাতের তালুতে রেখার সংখ্যা বাড়ে। দৃষ্টি কমে আসে। মানুষ ঝরে যায়। রয়ে যায় তার বিপুল কর্মকাণ্ড। কেরানি থেকে অভিনেতা, প্রযোজক, সংগীত পরিচালক, সংগীতের চিত্রপরিচালক, পরিচালক—ছবির জগতে এমন ভূমিকা কমই আছে, যেখানে উত্তমকুমার নেই। ছবির বাইরেও এমন চরিত্র পাওয়া ভার, যাঁর মরমে মহানায়ক পায়ের ছাপ রাখেননি একটিও। চুলের সেলুন থেকে বেশ্যালয়ের সাজানো রংমহল, ভদ্রবিত্তর খ্যাতির সূতিকাগার ভেঙে যিনি সিনেমাকে আপামরের কাছে নিয়ে গেছেন, তিনি তো পুড়বেনই, আজীবন, প্রতি পদে। তাই সেই গানের কাছেই ফিরতে হয়, ফিরতে হয় সেই সুরের কাছে, যার প্রতিটি বুননে মহানায়ক রয়ে গিয়েছেন, রয়েও যাবেন। নেপথ্যে বাজে—
যেটুকু সুরভী ছিল
হৃদয় সবই তো দিল
এবার খুঁজবে কাঁটা
তাই ছেড়ে যাই দূর…
আমি যাই চলে যাই
যাই চলে যাই…