স্টেশন যেন শপিংমল, রেলে ঠাঁইহারা হকাররাই

Howrah Station Hawker Eviction : রেল যা বলে না তা হচ্ছে, রেলওয়ে প্লাটফর্মস আর ফর কর্পোরেট শপস অ্যান্ড নট ফর হকারস।

২০২০ সালের লকডাউনে ভারতে সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ হকারি করে রুটিরুজি চালাতেন। স্বাভাবিকভাবেই রাতারাতি তাঁদের কাজ চলে যায়। অসংখ্য মানুষ দেনায় ডুবে যান। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যা অবধি করেন। দুই বছর প্রায় ট্রেনে এমন নানা সমস্যা দেখা গিয়েছিল, ট্রেন চলেওনি এক বছর প্রায়। ২০২১ সালের অগাস্টের শেষের দিকে যখন ট্রেন ফের চালু হয় মহামারী কাটিয়ে, তখন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে পূর্ব রেল। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখন থেকে রেলে কাউকে হকারি করতে দেওয়া হবে না। তার সঙ্গে সঙ্গেই রেল একটি বেসরকারি সংস্থাকে টেন্ডার দেয়, তারা ট্রেনে পণ্য বেচবে। একজন হকার স্বাধীনভাবে কাজ করেন। এই অর্থনীতি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলে। খাবার হকাররাই তৈরি করেন, তাঁরাই বিক্রি করেন, এই অর্থনীতিকে ধ্বংস করে একটি কর্পোরেট সংস্থাকে সামনে রেখে নতুন অর্থনীতি আমদানির চেষ্টা হয়। অর্থাৎ এই কর্পোরেট সংস্থা এবার হকারদের 'সেলস পার্সন' হিসেবে কাজ রাখবে। তাঁদের জামা দেবে, লাইসেন্স দেবে, রেল তাঁদের স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু এই হকাররা সেই জিনিসই বিক্রি করবেন যা কর্পোরেট তাঁদের বেচতে বলবে। এতদিন ধরে নিজেরা যা বানিয়েছেন, বিক্রি করেছেন, কিনেছেন তা আর হবে না। হকাররা হয়ে যাবেন অঘোষিত সেলসম্যান!

হকাররা এই অদ্ভুতুড়ে বিষয় মানতে চাননি, তাই তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন। ২৪ মাস হয়ে গেল এই আন্দোলন চলছে। রেল ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। ২ বছর ধরে আমরা, জাতীয় বাংলা সম্মেলন প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছি। ফলত যা হয়, চারবার রেল ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। শেষবার তা হলো ১৬ সেপ্টেম্বর, হাওড়া স্টেশনে। এর আগে মেচেদায়, সাঁতরাগাছিতে, ডানকুনি স্টেশনে হামলা হয়েছে। বিভিন্ন সময় হকারদের বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা হয়। কখনও চেন টানার কেস দেওয়া হয়, কখনও জিনিস চুরি যাওয়ার কেস, দুর্ব্যবহার তো আছেই! যে হকার হয়তো ৩০ বছর ধরে স্টেশনে জিনিস বিক্রি করছেন তাঁর থেকে প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে ওই স্টেশনে দোকান থাকার!

রেলকলোনিতে প্রচুর বস্তিও আছে। সেখানে কোনও একটি বাড়ির চাল ভেঙে গেলে, টিনের চাল বা টালি মেরামত করতে রেল আধিকারিকরা ২০ হাজার টাকা, ৪০ হাজার টাকা অবধি ঘুষ চান। ঘুষ না দিয়ে নিজেরা সারাই করতে গেলে এই মানুষদের এমন কেস দেওয়া হয় যা বুঝতে, লড়তেই সেই গরিব মানুষটির জীবন কেটে যায়! অথচ এই বাড়িগুলি ৬০, ৭০ বছর ধরেই আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের দেশে এভাবে রেলের ধারেই থাকে। গত মাসে সরকার অমৃতভারত স্টেশন বলে একটি প্রকল্প ঘোষণা করে। পশ্চিমবঙ্গের স্টেশনগুলি নাকি বিমানবন্দরের মতো করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্টেশনগুলোর কোনও সোশ্যাল অডিট হয়েছে? প্রতিটি স্টেশনকে কেন্দ্রে করে একটি অর্থনীতি চলে।সেই স্টেশনে অসংখ্য দোকান আছে, হকার আছেন। হাওড়া, শিয়ালদহর মতো বড় স্টেশনগুলিতে কম করে ৫ থেকে ৬ হাজার মানুষের রুটিরুজি চলে। এই স্টেশনগুলিই এক একটা শিল্প! ছোট স্টেশনেও ৫০০ থেকে ২০০০ মানুষ এভাবেই জীবন চালান। রেল কোনও সামাজিক অডিট করেনি, পুনর্বাসনের কথা বলেনি, ক্ষতিপূরণের কথা বলেনি। সোজা জানিয়ে দিয়েছে, আধুনিকীকরণ হবে এবং যা আছে সব গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। জি ২০ সম্মেলনে আমরা দেখেছি দিল্লিতে ব্যাপক উচ্ছেদ চলেছে। হকার, বস্তি সব পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে! দারিদ্রকে পর্দার তলায় আনতে চেয়েছে সরকার, এই আধুনিকীকরণ কি দেশ চেয়েছিল? দারিদ্র দূর করতে পারেনি রাষ্ট্র অথচ বুলডোজার দিয়ে তা মাটিতে মিশিয়ে দিতে তৎপর!

প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রকল্প ছিল যেখানে বলা হয়, ২০২২ সালের মধ্যে প্রত্যেক ভারতীয় পাকাবাড়ি পাবেন। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে ২০২৩-এ বুলডোজার দিয়ে কী উচ্ছেদ করা হচ্ছে? কৃষ্ণনগর স্টেশনে বুলডোজার দিয়ে অস্থায়ী সব দোকান ভেঙে দেওয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই এই চলছে। রেল আধুনিকীকরণের নামে যে বেসরকারিকরণ চালাচ্ছে, তাতে হকারদের জায়গা নিচ্ছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। বড় পুঁজিপতিরা দোকান দিচ্ছে। রেলের কি সামাজিক কোনও দায়িত্ব নেই? রেল কি কর্পোরেট সত্তা? একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা? যদি তাই হয়, সরকার যদি কর্পোরেট হয় আর মানুষ যদি তার শেয়ারহোল্ডার, তাহলে তো মানুষ প্রশ্ন করবেই, শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ট কোথায়? ৭৫ বছর ধরে সরকারকে যে কর দিয়েছি আমরা, তা দিয়েই রেল গড়ে উঠেছে। ১ লক্ষ কোটি টাকার বুলেট ট্রেন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার ধার আমাদের এই সরকারের পর আরও ১০ টা সরকার এসেও মেটাতে পারবে না। তাহলে সাধারণ মানুষের ডিভেডেন্ট কই?

সরকার আসলে কর্পোরেটও না, সাধারণ মানুষেরও না। সরকার আসলে সম্পূর্ণ বেসরকারি সংস্থার দালাল। পশ্চিমবঙ্গে ১০ লক্ষর উপর মানুষ রেলে হকারি করে দিন চালান। একদিন তিনি কাজ না করলে তাঁর পরিবারের ৫ থেকে ৭ জন মানুষ অভুক্ত থাকবেন। এবার হাওড়াতে কদিন আগে যা ঘটনা ঘটল, তার কথা একটু বলি। কোন্নগর স্টেশনে ২০ টি দোকান আছে। এই দোকানগুলি ৩০ বছরের পুরনো। কারও হয়তো বাবা দোকান চালাতেন, বাবার মৃত্যুর পর ছেলে দোকান চালান। সেই দোকানগুলি কিছুদিন আগে একটি সাবওয়ে তৈরির জন্য সরাতে বলে রেল। বলা হয়, দিন দুয়েকের জন্য দোকান সরিয়ে নিতে কারণ মাপজোপ চলবে। হকাররাও দু' দিনের জন্য দোকান সরিয়ে দেন। পরে দোকান ফের বসাতে গেলে রেল বাধা দেয়। সাবওয়েও হয়নি, মাপজোপ করে কর্তৃপক্ষও চলে গেছে কিন্তু দোকান আর বসতে দেওয়া হচ্ছে না। শেষে কোন্নগরের হকাররা সিদ্ধান্ত নেন, এভাবে চলবে না। পরিবার চলছে না, আত্মহত্যা করার জোগাড়। যদি আত্মহত্যাই করতে হয় তাহলে রেললাইনে বিক্রি করতে করতেই মরবেন, পরিবারকে নিয়ে নয়। তারা ফের দোকান বসিয়ে কাজ শুরু করেন। রেল একদিন রাত্রি ৩ টে নাগাদ দোকানগুলিকে তুলে ফেলে দেয়। হকাররা ফের দোকান উদ্ধার করে এনে বসেন, রেল আবার ভেঙে দেয়। যখন হকাররা উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদ করতে যান, রেল আধিকারিকরা জানান হাওড়া স্টেশনের ডিআরএম এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফলে এই অভিযোগ বা বক্তব্য তাকেই জানাতে হবে।

সেই মোতাবেক, হকাররা ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশনে ডিআরএমের সঙ্গে কথা বলতে রওনা দেন। প্রয়োজনে ডেপুটেশন দিতেও প্রস্তুত তাঁরা। ট্রেন থেকে নামতেই হকাররা দেখেন, প্রায় ১৫০ আরপিএফ হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে নির্মমভাবে এলোপাথাড়ি লাঠি চালানো হয় এই নিরস্ত্র হকারদের উপর! যেন সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা! যাত্রী, হকার, সাংবাদিক কাউকে রেয়াত করা হয়নি। হকারদের মাথা ফেটে যায়, জিনিস নষ্ট হয়, পশুর মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, ২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ২জন ছিলেন সাধারণ যাত্রী! তারা বারবার জানান যে তারা সাধারণ যাত্রী, টিকিট কাটা যাত্রী! রেল কর্ণপাত করে না। হাজতে ঢুকিয়ে দেয়। জাতীয় বাংলা সম্মেলন যখন ডিআরএম অফিসে যায়, শান্তিপূর্ণ অবস্থানে বসে, সংগঠনের সদস্যদের উপরেও লাঠিচার্জ করা হয়। মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। রাত্রে পূর্ব রেলের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়, রেলওয়ে প্লাটফর্মস আর ফর প্যাসেঞ্জারস, নট ফর হকারস।

রেল যা বলে না তা হচ্ছে, রেলওয়ে প্লাটফর্মস আর ফর কর্পোরেট শপস অ্যান্ড নট ফর হকারস। যদি সত্যিই প্লাটফর্ম যাত্রীদের হয়, তাহলে সেই যাত্রীরা তো হকারদের থেকেই পণ্য কিনতে ভালোবাসেন। তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে হকারদের থেকে না কিনে কর্পোরেটদের শরণাপন্ন হতে। দশ লক্ষ হকার রোজ যদি ৫০০ টাকা উপার্জন করেন, তাহলে এই যে দৈনিক ৫০/৬০ কোটি টাকার ব্যবসা, তার নিশ্চয়ই বাজার আছে! রেল যাত্রীদের বাজার নষ্ট করছে। হকারকে সরিয়ে যাত্রীকে বাধ্য করা হচ্ছে সিসিডি থেকে কফি আর কেএফসি থেকে বার্গার খেতে। ৫ টাকায় চা খাওয়ার বদলে বাধ্য করা হচ্ছে ৫০ টাকার চা খেতে! তাহলে সত্যিই কি রেল যাত্রীদের কথা ভাবছে নাকি কর্পোরেটদের?

রেল সম্পূর্ণভাবেই কর্পোরেট সংস্থাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। শপিং মলের মতো তৈরি হবে রেল! সাধারণ মানুষের স্থান নয়। যে যাত্রীদের রেল গ্রেফতার করেছে, তাঁদের বলা হয়েছে "তোকে তো হকারের মতো দেখতে!” নিম্ন রুটিরুজির মানুষদেরই মারা হয়েছে, পরিষ্কার পোশাকের মানুষকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে 'হকারের মতো দেখতে' নয় বলে! আসলে হকারের মতো নয়, দেশের গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ এমনই দেখতে হন। হিন্দিভাষী আরপিএফ বাঙালি হকারদের গালাগালি করছে। আইআরসিটিসির যে দোকানগুলো আছে, সেগুলি একটাও বাঙালিদের না। এই দোকানগুলি থেকে কিছু হকার জিনিস নিয়ে ট্রেনে বেচেন। এরা কিন্তু রেলের লাইসেন্স পাওয়া হকার নন। এরা ভিনরাজ্য থেকেই আসেন। এদের কিন্তু রেল কিছুই করছে না। টেন্ডার ডেকে দেওয়া রেলের স্টল থেকে বিক্রি করা হকারদের রেল ছাড় দিচ্ছে। এখানে হিন্দির সাম্রাজ্যবাদকে ভুলে গেলে চলবে না। জাতিবিদ্বেষকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই উস্কে দেওয়া হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক সংগ্রামে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে সুকৌশলে। যাত্রী মানে আসলে তো গ্রাহক। হকাররা যদি এই গ্রাহকদের দখল করে নেয়, কর্পোরেট ব্যবসা করবে কীভাবে?

এভাবে চলতে থাকলে ১০ লক্ষ মানুষকে আগামীতে আত্মহত্যা করতে হবেই। আমরা, আমাদের সংগঠন জাতীয় বাংলা সম্মেলন হকার লাইসেন্স, হকার পলিসির দাবি জানাই। স্ট্রিট ভেন্ডর অ্যাক্ট ২০১৪ সালে সংসদে পাশ হয়েছিল। তাতে অন্য সমস্ত হকাররা আওতাভুক্ত হলেও দেশ জুড়ে প্রায় ১ কোটি রেলের হকাররা বাদ পড়ে যান। এক রাষ্ট্র এক ধর্ম, এক দেশ এক নির্বাচন নিয়ে এত মাথাব্যথা! তাহলে এক আইনে সব হকার নেই কেন? কর্পোরেটের দোকান থেকে জিনিস কিনতে বাধ্য করে আমাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না কি? যে কৃষকের থেকে পেয়ারা নিয়ে এসে হকার বেচেন সেই চাষির অধিকার কাড়া হচ্ছে না কি? এটি স্রেফ হকারদের সমস্যা না, যাত্রীর সমস্যা, কৃষকের সমস্যা, কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত লাখো মানুষের সমস্যা। এই সব মানুষরা মারা যাবেন শুধুমাত্র কর্পোরেটের উদরপূর্তি করতে গিয়ে, রেলের লোভ মেটাতে গিয়ে, অচিরেই!

 

More Articles