জিএসটি ২.০: দীপাবলির উপহার নাকি স্রেফ ঢক্কানিনাদ?
GST 2.0: এই জিএসটি সংস্কারের মূল কথা হল, এতদিন পর্যন্ত গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্সের চারটে স্ল্যাব ছিল- ৫%, ১২%, ১৮% এবং ২৮%। এর মধ্যে ১২% ও ২৮% স্ল্যাবদুটো উঠে গিয়ে যথাক্রমে ৫% ও ১৮% এর সঙ্গে যুক্ত হবে।
আমাদের পাড়ার হাদুবাবু গত কয়েকদিন খুব উত্তেজিত। রোজ বাজারে গিয়ে দোকানির সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে 'ঐতিহাসিক' ভাষণের পর তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে জিনিসপত্রের দাম এতটাই কমে যাবে যে জীবনটা এক 'বাচত উৎসবে' (savings festival) পরিণত হবে। সমস্যাটা শুধু হাদুবাবুর নয়, আমাদের সবার। জিএসটি কমে যাওয়ার সুবিধা আম-আদমি সেভাবে বুঝতে পারছে না। মোদি সরকারের পূর্ববর্তী রেকর্ডের কথা মাথায় রেখে অনেকে ভাবতে বসেছেন যে প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা বা নোটবন্দির মতো এটাও কোন জুমলা নয় তো! এই প্রেক্ষাপটে আম-আদমির জীবনে তথা ভারতীয় অর্থনীতিতে এই জিএসটি সংস্কার কী ধরণের প্রভাব ফেলবে, আলোচনা জরুরি।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে এই করহ্রাস কোন দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনাজনিত সিদ্ধান্ত নয়। মোদিজির একদা পরমমিত্র মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ঝটকায় ভারতীয় পণ্যের উপর যে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ও পেনাল্টি চাপিয়েছেন তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রফতানির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক করে দিতে চলেছে। এর ফলে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে, বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় কমবে এবং নিশ্চিত ভাবে ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন হবে। এই অবস্থায় মোদি সরকারের নীতি প্রণেতারা মনে করছেন জিএসটির হার কমালে জিনিসপত্রের দাম কমবে,চাহিদা বাড়বে। একই সঙ্গে সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত 'আত্মনির্ভর ভারত' শ্লোগানে কিছুটা ঘৃতাহুতি হবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও দাবি করছেন এই সংস্কারের ফলে কর কাঠামো সরল হবে এবং পরিবারগুলোর উপর চাপ কমবে। এই দাবিগুলোকে যুক্তি -তর্কের আলোকে বিচার করা দরকার।
আরও পড়ুন- জিএসটি সংস্কার! সুরাহা পাবে সাধারণ মানুষ?
এই জিএসটি সংস্কারের মূল কথা হল, এতদিন পর্যন্ত গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্সের চারটে স্ল্যাব ছিল- ৫%, ১২%, ১৮% এবং ২৮%। এর মধ্যে ১২% ও ২৮% স্ল্যাবদুটো উঠে গিয়ে যথাক্রমে ৫% ও ১৮% এর সঙ্গে যুক্ত হবে। এছাড়া ৪০% এর একটা বিশেষ স্ল্যাব থাকবে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে যা নিত্য ব্যবহার্য বা নিত্য প্রয়োজনীয় নয়। এখন এই শুল্ক হ্রাস কর কাঠামোতে কী ধরণের প্রভাব ফেলবে তা বোঝার জন্য আমাদের সামান্য পাটিগণিতের আশ্রয় নিতে হবে। আগে যে ২৮% স্ল্যাবটা ছিল তাতে ২০২৪-২৫ আর্থিক বর্ষের হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট জিএসটির ১১% আদায় হত। এই স্ল্যাবটা ১০% কমলে জিএসটি কমবে মোট আদায়ের ১.১%। আর ১২% স্ল্যাব থেকে আদায় হত মোট জিএসটির ৫%। সেটা ৭% কমে গেলে জিএসটির আদায় কমবে ০.৩৫%। এই দুটো স্ল্যাবের কারণে মোট জিএসটি আদায় কমবে ১.৪৫%। টাকার অঙ্কে পরিমাণটা ৩২,০১৬ কোটি টাকা (কেউ কেউ এটাকে গড়পড়তা ৩৫,০০০ কোটি টাকা ধরছেন), যেখানে মোট জিএসটি বাবদ আয় ছিল ২২.০৮ লক্ষ কোটি টাকা। একথা এবার বলা যায় যে জিএসটি বাজারে দাম কমে যাওয়ার যে স্বপ্নফেরি করছে তা ভুল। স্বাভাবিক ভাবে সাশ্রয় খুব একটা হওয়ার কথা নয়।
এই সাশ্রয়ের হিসাবটা হাদুবাবু-সহ বাকিদের সমস্যায় ফেলছে। মনে করা হচ্ছে এই কর ছাড়ের কারণে এক বছরে মাথা পিছু সাশ্রয় হবে ৩৩১ টা মাত্র। বাস্তবত বাজারে এর কোনো প্রভাবই পড়বে না। পরিবারপিছু গণিতটা হিসাবটা আরো এলোমেলো করে দেবে। চারজন সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের মাসিক আয় যদি ৯০,০০০ টাকা হয় তবে সাশ্রয় হবে ২৮০০ টাকা। কিন্তু ভারতের ৭৫% পরিবারের (চারজন সদস্য ধরে) মাসিক আয় চল্লিশ হাজারেরও কম। সেখানে এক হাজার টাকাও সাশ্রয় হওয়া মুশকিল। আর দেশে গত ১০ বছরে পারিবারিক সঞ্চয়ের যে ধ্বংসাত্মক হ্রাস সেখানে এই সামান্য টাকা শুধু দেনা শুধতেই বেড়িয়ে যাবে। আরেকটা চিন্তার বিষয় হল মোদি সরকারে আয়কর নীতি বলুন বা জিএসটি হ্রাস, মূল লক্ষ্য হল উচ্চ মধ্যবিত্ত। সেখানে এই জিএসটি হ্রাসের কিছু ধনাত্মক প্রভাব পড়লেও আম আদমির কোনো লাভ হবে না। অর্থনীতিতে যেগুলোকে আমরা বিগ টিকিট পারচেস বলি যেমন গাড়ি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেসিন, দামি মোবাইল, মাইক্রোওভেন, এগুলোর উৎসবকালীন বিক্রি এমনিই বাড়ে, এবার জিএসটি কমার কারণে আরও একটু বাড়বে। এক্ষেত্রে পিৎজা, প্যাকেট পরোটার মত খাবারে জিএসটি হ্রাস হয়েছে কিন্তু এগুলো যারা খায় তারা সংখ্যার হিসেবে অতি নগন্য। আমআদমি রোজ পাশের ধাবা বা রাস্তার দোকান থেকে যে রুটি কেনে তার গড় দাম ৬-৮ টাকা। এখানে এক পয়সা দাম কমবে না কারণ এই অর্থনীতি জিএসটির বাইরে। এমনকি সংখ্যাতত্ত্বের মারপ্যাঁচের কারণে জিনিসের দাম জিএসটি কমা সত্ত্বেও একই থাকতে বা বেড়ে যেতে পারে। একটা উদাহরণ ধরে আলোচনা করা যেতে পারে। খাতার উপকরণ যেমন কাগজ, বোর্ড -- এগুলোর উপর ১২% জিএসটি ধার্য ছিল। একজন খাতা উৎপাদক ১০০ টাকার কাগজ কিনতে খরচ করতেন ১১২ টাকা। এবার প্রস্তুত খাতার উপর ১২ % জিএসটি ছিল। অর্থাৎ খাতার চূড়ান্ত দাম হওয়ার কথা ১১২+১২%= ১২৫.৪৪ টাকা। কিন্তু যেহেতু খাতা উৎপাদক আগেই কাগজ কেনার সময় ১২ টাকা দিয়ে দিয়েছেন, তাই একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি ওই ১২ টাকা ফেরত পেয়ে যেতেন,তাই খাতা তিনি বিক্রি করতেন ১২৫.৪৪-১২= ১১৩.৩৪ টাকা।কিন্তু এবার হিসেবটা পাল্টে যাবে। এবার খাতার উপকরণ কাগজ গেছে ১৮% স্ল্যাবে। এতে একজন খাতা বিক্রেতা ১০০ টাকার কাগজ কিনতে খরচ করবে ১১৮ টাকা। কিন্তু খাতার উপর কোন জিএসটি নেই। তাই সরকারের ঘর থেকে সে কিছু ফেরত পাবে না। ফলে খাতাতে জিএসটি থাকার সময় যে খাতার দাম ছিল ১১৩.৩৪ টাকা, জিএসটি উঠে যাবার পর দাম হল ১১৮ টাকা। দাম কমার বদলে বেড়ে গেল। এছাড়া আরেকটা অভিজ্ঞতা লব্ধ আশঙ্কা হল বড় কোম্পানিগুলো তাদের লাভের হার বাড়ানোর জন্য এই যে সামান্য কনসেশন,সেটাও খেয়ে দেয়,ফলত জিনিসের দাম একই থেকে যায়।
আরও পড়ুন- কেন স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চ আরএসএস প্রশস্তির জন্য বেছে নিলেন মোদি?
এমনকী সরকারের ঘরে যে পরিমাণ জিএসটি বাবদ আয় কমবে, তার পূরণের ক্ষেত্রে কি ধরণের নীতি গ্রহণ করা হবে, তা নিয়েও আশঙ্কা থাকছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির নিয়ম মেনে এদেশেও চালু হয়েছে 'Fiscal Responsibility and Budget Management' (FRBM)। এতে বলা হয়েছে যে কোনো মূল্যে আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। এখন সরকার যে ছাড় জিএসটি জনগণকে দেবে তার সমপরিমাণ টাকা সরকারি খরচে হ্রাস করা হতে পারে। এখন এই ব্যয়হ্রাস যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে করা হয় তাহলে শেষ বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই আমআদমি। আমরা জানি জিএসটি হল অপ্রত্যক্ষ কর, এতে ভোগ্য পণ্য ও তার উৎপাদনের মধ্যবর্তী পর্যায়গুলির উপর কর চাপানো হয়। এটা আয়কর বা সম্পদকর নয়। শেষ ধাপে এই কর মেটান শ্রমজীবী মানুষ,যারা এই করকাঠামোতে সবচেয়ে অসংগঠিত ও দুর্বল অবস্থায় থাকেন। এই সামান্য পরিমাণ ছাড় তাই জিডিপি বৃদ্ধি হোক বা জনকল্যাণ কর্মসূচিতে ব্যয়বৃদ্ধি, কোনো আশাই পূরণ করবে না।
স্পষ্টভাবে বলার সময় এসেছে, মোদি সরকার ভারতীয় অর্থনীতির মূল সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করছে না। এখানে মূল সমস্যা হল বৈষম্য। সরকারি সমীক্ষার ফল অনুযায়ী দেশের এক শতাংশ মানুষের কাছে দেশের মোট সম্পদের ৪০% কুক্ষিগত। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্থিত এক ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট সংস্থা বার্নস্টাইন বলেছে, ভারতে ১% মানুষের কাছে দেশের ৬০% সম্পদ রয়েছে। দেশের আর্থিক হাল ফেরাতে হলে সরকারের উচিত এই অংশটার উপর সম্পদ কর ও উত্তরাধিকার কর চালু করা। এতে সরকারের আয় বাড়বে। প্রয়োজন কর্মসংস্থানের যা বাজারের চাহিদা বাড়বে। ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধে আহত ভারতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে। সেটা না করতে পারলে আত্মনির্ভর ভারত নেহাৎ শ্লোগান হয়ে থেকে যাবে। জিএসটির এই নামমাত্র ছাড় নাটুকে রাজনীতি হতে পারে কিন্তু তাতে সংকট সমাধানের দিশা পাওয়া যাবে না।

Whatsapp
