আজও নরবলি! কেরলের বীভৎসতায় এক অন্ধকার জগতের খোঁজ
Human Sacrifice: কেরলের নব়বলির ঘটনা চমকে দিয়েছে গোটা দেশকে। দেশজুড়ে কি একই পরিস্থিতি
আজ সভ্যতার অগ্রগতি কথা বলে। ইসরো প্রতিদিন নতুন নতুন ইতিহাস তৈরি করছে। মহাকাশে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পুণ্যলগ্নে জাতীয় পতাকা উড়েছে। এই অবস্থায় নরবলির ক্ষত আজ ইতিহাস নয়, বর্তমান। ইতিহাসের পাতা উল্টোলে নরবলির মতো জঘন্য কুসংস্কারের হাড়হিম করা প্রথার বর্ণনা পাওয়া যায়। কেরলের নরবলির নারকীয় ঘটনা সেই বীভৎস স্মৃতি ফিরিয়ে দিল আবার। সেই জঘন্য ঘটনায় আলো ফেলার আগে ফিরে যাওয়া যাক পিছনের দিকে। শুরু কোথায়, বলা কঠিন। তবে ইতিহাস ঘেঁটে এবং সাহিত্যিকদের কলম থেকে নরবলির যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা আজকের বাস্তবেও বিদ্যমান, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
সংবিধানে বিজ্ঞানমনস্কতাকে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলা থাকলেও রাষ্ট্র থেকে শুরু করে তাবড় সব প্রতিষ্ঠান কি অপবিজ্ঞান, কুসংস্কারকেই ইন্ধন জোগাচ্ছে না? প্রশ্ন উঠছে বিজ্ঞান আন্দোলনের ফল নিয়ে। নরবলি, শিশুহত্যা, বধূহত্যা, ডাইনি সন্দেহে হত্যার বিষবাষ্প আজও চোরাস্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে অগ্রদূত সমাজের শিরা-উপশিরা দিয়ে। মুখে আধুনিকতার কথা আওড়ালেও কুসংস্কার এখনও সমাজ থেকে নির্মূল হয়নি।
শোনা যায়, একসময়, মানুষ নরবলি প্রদান করে বলিপ্রদত্ত মানুষের রক্ত ছড়িয়ে দিত ফসলের ক্ষেতে। ভাবত, ফসলের দেবী তুষ্ট হবেন। ক্ষেতে ভরে উঠবে ফসল। তন্ত্রমতে, আমাদের দেহের মধ্যে স্নায়ুমণ্ডলি আছে জালিকার মতো বিন্যস্ত হয়ে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় সূর্য ও চন্দ্রের স্রোত। বিশেষ প্রকার সাধনার মাধ্যমে এই দুই স্রোত ধারাকে একত্র করতে পারলে লাভ করা যায় মহাচৈতন্য। যার সাহায্যে মানুষ বহু অসাধ্যসাধন করতে পারে। মানুষ লাভ করে অতিপ্রাকৃত শক্তি। তান্ত্রিকদের মধ্যে একদল ছিল, যাদের বলা হতো কাপালিক। কাপালিকরা নরবলি দিত। বলিপ্রদত্ত মানুষের বুকের ওপর বসে করত ধ্যান।
আরও পড়ুন: অপরাধ সিপিআইএম করা, তাই বাবা-মাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে: দীপঙ্কর দাস
তারা ভাবত, এভাবে লাভ করতে পারবে মহাশক্তি। এমনকী, অমরত্ব। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন— ‘তান্ত্রিকরা অনেক বীভৎস আচরণ করে, যেমন, মানুষের মৃতদেহের ওপর বসিয়া সুরা পান করে (খ্রি : ২৬৭, ১৩৮০ সংস্করণ)।' বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'কপালকুণ্ডলা'। 'কপালকুণ্ডলা'-তে আছে কাপালিকের বর্ণনা। এর থেকেও কাপালিকদের সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়। একসময় বাংলাদেশে অনেক কাপালিক ছিল। ছিল আরও বিভিন্ন প্রকারের তান্ত্রিক।
জঙ্গলে ডাকাতরা মা কালীর উদ্দেশ্যে নরবলি দিত, বাংলা সাহিত্যে এমন কথা অচেনা নয়। সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখেছেন 'ভাঙা ডানার পাখি', সেখানেও আছে কাপালিকদের নরহত্যার বর্ণনা। কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ লিখেছেন গোমতী নদীতে নরবলি দেওয়ার ইতিহাস। আরও অনেক কথা সাহিত্যের পাতায় পাতায় আছে। দীনেশচন্দ্র সেন, রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখায় নরবলির উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'শক্তিপূজা' প্রবন্ধে লিখেছেন,
একটি কথা মনে রাখতে হবে, দস্যুর উপাস্য দেবতা শক্তি, ঠগীর উপাস্য দেবতা শক্তি, কাপালিকের উপাস্য দেবতা শক্তি। আরো একটি ভাববার কথা আছে, পশুবলি বা নিজের রক্তপাত, এমন কি, নরবলি স্বীকার করে মানত দেবার প্রথা শক্তিপূজায় প্রচলিত। মিথ্যা মামলায় জয় থেকে শুরু করে জ্ঞাতিশত্রুর বিনাশ কামনা পর্যন্ত সকল প্রকার প্রার্থনাই শক্তিপূজায় স্থান পায়...।
কেরলের কলঙ্ক
কেরলের নব়বলির ঘটনা চমকে দিয়েছে গোটা দেশকে। পুলিশ জানিয়েছে, এক ওঝার প্রভাবে সম্পদ লাভের আশায়, পাথানামথিট্টা জেলার এলানথুর গ্রামে দুই মহিলাকে বলি দিয়েছে এবং তাঁদের মাংস ভক্ষণ করেছে এক চিকিৎসক দম্পতি। ওই ওঝা মহম্মদ শফি এবং চিকিৎসক দম্পতি ভগবাল সিং এবং তাঁর স্ত্রী লায়লাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, “কেরলের মতো রাজ্যে এই অপরাধ কল্পনাতীত।” বস্তুত, কেরলের মতো একটি শিক্ষিত রাজ্যে কীভাবে এমন অপরাধ ঘটল, তা সারা দেশেরই প্রশ্ন। তবে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বা এনসিআরবি-র প্রকাশিত তথ্য বলছে, এই একুশ শতকেও ভারতজুড়েই নব়বলি এবং কালোজাদু-সংক্রান্ত হত্যার ঘটনা প্রচলিত রয়েছে।
নরবলি কী
নরবলি হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশায় কিংবা দেবতাকে শান্ত করার লক্ষ্যে মানুষ হত্যা। এটি একটি প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কার, যা বিভিন্ন সভ্যতায় অঙ্গীভূত ছিল। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এর অবসান হয়েছে। পৃথিবীর প্রধান ধর্মসমূহে নরহত্যা তথা নরবলির বিধান নেই, বরং নরহত্যা নিষিদ্ধ। নরহত্যার সঙ্গে নরবলির পার্থক্য হলো, নরবলি সামাজিকভাবে অনুমোদিত মানুষ হত্যা, যার উদ্দেশ্য দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জন। পাঁচ হাজার বছর আগে ইউরোপের কৃষিভিত্তিক সমাজে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ছিল। অপরাধের কারণে বিচারাদেশ অনুযায়ী হত্যা বা দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মহত্যা নরবলি হিসেবে গণ্য নয়।
কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ব্যক্তিদের মতে, ভারতে নব়বলিদানের অনুশীলন মূলত তন্ত্রসাধনার সঙ্গে জড়িত। এই আধ্যাত্মিক আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছিল মধ্যযুগে। অষ্টম শতকে ভারতে তান্ত্রিক সম্প্রদায়টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বহু তান্ত্রিক আচারের সঙ্গেই রক্ত অর্ঘ দেওয়া, নব়বলি এবং নরমাংস ভক্ষণের মতো ভয়ানক বিষয় জড়িত ছিল। বর্তমান ভারতে নরবলি, কুসংস্কারের মতো একটি বৃহত্তর সমস্যার অংশ। স্বঘোষিত ধর্মগুরু বা ওঝারা ধনলাভ থেকে শুরু করে রোগ নিরাময় করা বা দেবতাদের অনুগ্রহ লাভের আশা দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে নব়বলিদানে রাজি করায়।
ভারতে নরবলি
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বা এনসিআরবি-র প্রকাশিত তথ্য বলছে,
২০২১ সালে ভারতে মোট পাঁচটি নব়বলির ঘটনা ঘটেছিল। আরও ৬৮টি মৃত্যুর পিছনে কারণ ছিল কালোজাদু। উল্লেখযোগ্য, ২০২১-এও কিন্তু ‘শিক্ষিত রাজ্য’ কেরলে দু'টি নরবলির ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়া, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ এবং তেলেঙ্গানা থেকে একটি করে নরবলির ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছিল। জাদুবিদ্যার সঙ্গে জড়িত খুনের ক্ষেত্রে সবথেকে এগিয়ে ছিল ছত্তিশগড়। সেখানে ২০টি এমন হত্যা হয়েছিল। এছাড়া মধ্যপ্রদেশে ১৮টি, তেলঙ্গানা ১১টি, অন্ধ্রপ্রদেশে ৬টি, বিহারে ৪টি, ঝাড়খণ্ডে ৩টি, গুজরাট এবং উড়িষ্যায় ২টি করে এবং রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে ১টি করে কালোজাদু-সংক্রান্ত হত্যা হয়েছিল।
এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালেও ১১টি নরবলি ঘটেছিল ভারতজুড়ে। ৮৮টি হত্যার ক্ষেত্রে কারণ ছিল জাদুবিদ্যা। তবে সম্প্রতি কয়েক বছরের মধ্যে, নরবলি-সংক্রান্ত হত্যার ঘটনার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১৪ সাল থেকে ধরলে, ভারতে ১০০টিরও বেশি নরবলির ঘটনা ঘটেছে।
চলতি মাসের শুরুতেও কিন্তু, দক্ষিণ দিল্লির লোধি কলোনিতে এক ছয় বছরের কিশোরকে বলি দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল দুই ব্যক্তিকে। পুলিশকে তারা জানিয়েছিল, গাঁজা সেবন করে তারা “ভগবান শিবের দর্শন পেয়েছিল।" ধনলাভের জন্য তিনি নাকি “এক বালকের বলি দিতে” বলেছিলেন। ২০২০ সালের মে মাসে উড়িষ্যার কটক জেলার একটি মন্দিরে ৫২ বছর বয়সি এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল এক পুরোহিত। তার দাবি ছিল, সে স্বপ্নাদশ পেয়েছিল, কোভিড-১৯ অতিমারীর সমাপ্তি ঘটাতে, তাকে নরবলি দিতে হবে। ২০১৭ সালে কর্নাটকের আরেকটি নব়বলির ঘটনা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। এক ১০ বছরের নাবালিকাকে বলি দেওয়া হয়েছিল তার কাকার প্যারালাইসিস রোগ নিরাময়ের জন্য। এরকম অশিক্ষা ও কুসংস্কারের ছায়ায় মোড়া ঘটনার শেষ কোথায়, কে জানে? অন্তত কেরল আবার সেই প্রশ্ন তুলে দিল।
বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাসে যেসব নারকীয় ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম এই নরবলি। মিশর এবং এবং ইনকা সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলেও এই প্রথার বর্ণনা পাওয়া যায়।
আইন কতটা সক্রিয়
কেরলের ঘটনার প্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, গোটা ঘটনাটি কুসংস্কারের ফল। এই ধরনের কুসংস্কার রুখতে কড়া আইন তৈরি করা দরকার। আর, সেই আইন কড়াভাবে প্রয়োগের প্রয়োজন। ভারতে ডাইনি প্রথা রোখার কোনও কেন্দ্রীয় আইন নেই। তবে, রাজ্যভিত্তিক আইন আছে। যেমন, মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটকে ব্ল্যাকম্যাজিক এবং কুসংস্কার রোখার আইন আছে। কিন্তু, সেই আইনেও ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বলা নেই। দেশের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও বিহারই প্রথম রাজ্য, যারা ডাইনি তকমা দিয়ে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালে আইন করেছে। বিহারের এই আইন অনুযায়ী, ‘ডাইনি বিদ্যাচর্চা এবং একজন মহিলাকে ডাইনি তকমা দিয়ে চিহ্নিত করা, তাঁর ওপর নিপীড়ন চালানো, উপজাতি অঞ্চলে এই কায়দায় নারী নির্যাতন, অপমান ও হত্যা প্রতিরোধ করবে এই আইন।’ কুসংস্কারমূলক কাজ এবং তন্ত্রমন্ত্রর অনুশীলন ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ১৫ এবং ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি লঙ্ঘন করে বলে জানা যায়। তবে, ভারতে তন্ত্রমন্ত্রর মতো ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কোনও আইন নেই। ২০১৪ সালে কেরলে এই ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিলের খসড়া তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যদিও পরে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
কেরল একটা দৃষ্টান্ত। নরবলি সমাজের ব্যাধি, যে ব্যাধি তিলতিল করে গ্রাস করছে অগ্রদূত সমাজকে।