অনলাইন কেলেঙ্কারির ফাঁদ পেতে ভয়াবহ মানুষ পাচারচক্র! বাংলাদেশে বিছিয়ে রয়েছে যে জাল
Human Trafficking from Bangladesh: অনলাইন স্ক্যামের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকরা কম্বোডিয়ায় পাচার হয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এমনকী, কেউ কেউ মৃত্যুর সম্মুখীনও হয়েছেন।
মানুষ পাচারের শিকার যাঁরা হন, তাঁরা কার্যত ক্রীতদাসের জীবন কাটান। এই গ্রীষ্মেই টেলিগ্রাম মেসেজিং পরিষেবায় হোয়াইট শার্ক চ্যানেলের বিজ্ঞাপনগুলি ক্রেগসলিস্ট পোস্টিংয়ে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এই চিনা ভাষার ফোরাম, যার প্রায় ৫,৭০০ ব্যবহারকারী ছিল, তা তাদের প্রতিশ্রুত পরিষেবা বিক্রি করছিল না। বিক্রি করছিল মানুষ!
অনলাইন স্ক্যামের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকরা কম্বোডিয়ায় পাচার হয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এমনকী, কেউ কেউ মৃত্যুর সম্মুখীনও হয়েছেন। আসলে গত কয়েক বছর ধরে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়া মানুষ পাচারের একটি উৎস থেকে প্রধান গন্তব্যে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে। অনেক অনলাইন স্ক্যামও এই মানুষ পাচার চক্রর পিছনে।
কম্বোডিয়ার ক্যাসিনো এবং অন্যান্য ব্যাবসায় অপরাধী সিন্ডিকেটের জন্য কাজ করা বিদেশিদের সাম্প্রতিক পলায়ন এবং উদ্ধারের ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। গত মাসের ১২ তারিখে কম্বোডিয়ান পুলিশ সিহানুকভিলের একটি কম্পাউন্ড থেকে সাইবার জালিয়াতি এবং অবৈধভাবে কাজ করার জন্য ১৫ জন থাই নাগরিককে গ্রেফতার করেছে।
আরও পড়ুন: মাতৃগর্ভেই মৃত্যুফাঁদ! ভ্রূণেও নিরাপদ নয় শিশু, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা
গত কয়েক বছরে এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক কম্বোডিয়ায় যায়। কাজের খোঁজে যাওয়া মানুষজন তাদের এজেন্টের মাধ্যমে জানতে পারে যে, তারা কম্বোডিয়ায় ডেটা এন্ট্রি অফিসার হিসেবে কাজ করে প্রতি মাসে ১০০০ ডলার উপার্জন করতে পারবে। ঢাকার মহাখালিতে ‘বি ব্রাদার’ নামে এক অফিসে বসে একজন এজেন্ট নাসিরুদ্দিন, মাসুম নামের একজন ভিকটিমকে বুঝিয়ে বলে যে, কাজের ভিসা না থাকায় তারা মাসুমকে বিজনেস ভিসায় কম্বোডিয়ায় পাঠাবে আর সেখানে তিনি কাজ শুরু করার পর তাঁকে ওয়ার্ক ভিসা প্রদান করবে। আর এই সবকিছুই নির্ভর করছে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে উত্তীর্ণ হওয়ার ওপর, যা সাজ্জাদ আর ফয়জল নামে দু'জন ব্যক্তি নেবেন। এঁরা দু'জনেই কম্বোডিয়ায় থাকেন এবং তাঁরা জনৈক নাসিরের সহযোগী বলেও মাসুমকে ব্রিফ করা হয়।
“ফয়জল হোয়াটসঅ্যাপে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নেয়। যেহেতু আমি আগে কাজ করতাম, তাই আমার অভিজ্ঞতা ছিল। তাই তিনি আমাকে সিলেক্ট করে নেন”, এমনটাই বলেন মাসুম। তারপর তাদের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত করা হয় ৪,০০,০০০ টাকায় এবং ২৩ মে, ২০২২ মাসুম কম্বোডিয়া পৌঁছন।
মাসুমের কম্বোডিয়ায় পৌঁছনোর কয়েকদিন পর ফয়জল তাঁকে নিয়ে যায় কম্বোডিয়ার উপকূলীয় শহর সিহানুকভিলে। ফয়জল মাসুমকে বলেন যে, সিহানুকভিলে অনেক ক্যাসিনো আছে এবং তাঁর কাজ হবে সাধারণ অফিসের কাজ। সেখানে মাসুমের একটি ছোট ইন্টারভিউ হবে।
সাক্ষাৎকারের সকালে একজন চিনদেশীয় ব্যক্তি রুমে প্রবেশ করে এবং মাসুমকে তাঁর টাইপিংয়ের গতি এবং আরও কিছু মৌলিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আর সহজেই সিলেক্ট হয়ে যান মাসুম। এরপর তিনি কিছুদিন অফিস রুমে কাজ করেন, যেখানে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ছিলেন, যাঁরা একই প্রক্রিয়ায় মাসুমের মতো ‘সিলেক্ট’ হন, কিন্তু কম্বোডিয়ায় এসেছিলেন আলাদা আলাদা এজেন্টের মাধ্যমে।
কিছুদিন পর একজন কর্মকর্তা তাঁদের কাজ বুঝিয়ে দেন। “কাজটি ছিল ভুয়া মহিলা ফেসবুক প্রোফাইল তৈরি করে বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে ফ্লার্ট করা এবং তাঁদের কাছে একটি ধারণা তৈরি করা যে আমরা ধনী মেয়ে। তারপর তাঁদের আবাবা নামক একটি প্ল্যাটফর্মে ১০০ ডলার বিনিয়োগ করতে বলা। চুক্তি করা যে, যদি তারা ১০০ ডলার বিনিয়োগ করেন তাহলে তাঁরা ২০০ ডলার পাবেন”, বললেন মাসুম।
তিনি আরও জানান, “আমাদের কাজ ছিল তাঁদের ফাঁদে ফেলা এই বলে যে, বিনিয়োগ এক মাসে দ্বিগুণ হবে।” এই কোম্পানি যে সাইবার কেলেঙ্কারি চালাচ্ছে তা বুঝতে মাসুম ও তাঁর সহযোগী বাংলাদেশিদের বেশি সময় লাগেনি। বেশ কিছুদিন চলে যায়, কিন্তু তাঁরা ভয়ের কারণে কোনও গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হন।
কিন্তু নির্দেশ স্পষ্ট ছিল, কোনও গ্রাহক না জোগাড় করতে পারলে বেতনও পাবে না তাঁরা। মাসুম এইসব দেখে সেখানে আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ক্যাসিনোর লোকদের বলেন যে, তিনি এই কাজ ছেড়ে দেবেন। কিন্তু মাসুমের কথায় তারা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং তারা মাসুমের এজেন্টকে কল করে তাদের ৩৬০০ ডলার দিয়ে মাসুমকে ফেরত নিয়ে যেতে বলে।
মাসুমের কথায়, “আমি তখন জানতে পারি যে ফয়জল আমাকে এখানে বিক্রি করে দিয়েছে।” এরপর মাসুম ফয়জলকে কল করে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং অন্য কোনও চাকরি করিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু মাসুমের এই অনুরোধ ফয়জলকেও খুবই রাগান্বিত করে তোলে।
মাসুম বলেন, “আমি ফয়জলকে বলেছিলাম যে, আপনি আমাকে বলেননি কাজটা কী বা আপনি আমাকে এইখানে বিক্রি করে দিবেন।” উত্তরে ফয়জল তাঁকে বলে, “এখন তো আপনে জানেন, তাতে কী? যান আর কাজ শুরু করেন!”
অন্যান্য বাংলাদেশিরা, যাঁরা তাঁদের এজেন্টদের কল করে, তাঁরাও একইরকম প্রতিক্রিয়া পান। কয়েকজনকে বলা হয়, তাঁরা যদি কোম্পানির কথা না মেনে চলেন, তাহলে তাঁদের মারধর করা হবে। এমনকী, হত্যারও হুমকিও দেওয়া হয় তাঁদের।
“এজেন্টরা কোম্পানিতে আমাদের পাসপোর্ট জমা দেয় এবং আমাদের প্রত্যেকের জন্য ৩৬০০ ডলার নেয়। তাই তারা যদি এই ডলার ফেরত না দেয়, তাহলে কোম্পানি আমাদের ছাড়বে না। ফয়জল রীতিমতো আমার কল রিসিভ করা বন্ধ করে দেয়। আর যদি কল রিসিভ করতও, তাহলে আমাকে হুমকি দিত”, বললেন মাসুম।
এরপর মাসুম বাংলাদেশে তাঁর পরিবারকে ফোন করে ফয়জলকে ৩৬০০ ডলার পাঠাতে বললেন যাতে সে কোম্পানি থেকে ছাড়া পায়। ফয়জল টাকাটা পাওয়ার পর কোম্পানির সামনে হাজির হয় এবং মাসুমের মুক্তি নিশ্চিত করে। যেদিন মাসুম কোম্পানি থেকে ছাড়া পায়, তাঁর ফোন কোম্পানির কর্মকর্তারা ফরম্যাট করে দেয় এবং তাঁর পাসপোর্ট মুখের ওপর ছুড়ে মারে। তার সঙ্গে মাসুমের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলিও ডিলিট করে দেয়।
মাসুমের পাসপোর্ট পাওয়ার মুহূর্তেই ফয়জল সেটি নিজের কাছে রেখে দেয়। ২৭ জুন বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আগে ফয়জল মাসুমের কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি ভিডিও রেকর্ড করিয়ে নেয়, যাতে মাসুমকে হাসিমুখে বলতে বলা হয় যে, কম্বোডিয়া থেকে তিনি নিজের ইচ্ছায় ফিরে এসেছেন। সেই রেকর্ডিংয়ের পর ফয়জল মাসুমকে তাঁর পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে ফেরার পর মাসুমের মাথার ওপর ছিল প্রায় সাত লাখ টাকার ঋণের বোঝা। কম্বোডিয়াতে চিনা কোম্পানিগুলো এভাবে টাকা দিয়ে শ্রমিকদের কিনে কার্যত তাদের দাস বানিয়ে রাখছে এবং তাঁদের দিয়ে নানা অবৈধ কাজকর্ম করাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ওপরে যে মাসুমের কাহিনি বলা হলো, তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়– এরকম শত শত মাসুম ওই অঞ্চলে ক্রীতদাসের জীবন কাটাচ্ছে। মাসুম তবু সৌভাগ্যবান, যে, সে নিজের ভিটেয় ফিরতে পেরেছে। কিন্তু এমনও অনেক দৃষ্টান্ত আছে, কোম্পানির কথার অবাধ্য হলেই বিদেশি কর্মীদের পিটিয়ে মেরে ফেলা পর্যন্ত হয়েছে।