সিসিটিভি মোড়া আইআইটি, এনআইটিতে তবে কেন এত ছাত্রের আত্মহনন?
Jadavpur University Ragging: আমাদের ভিতরে যে সামন্ততন্ত্রের অবশেষ আছে, তা কখনও কখনও 'একটু আধটু র্যাগিং করা'কেই প্রশ্রয় দেয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বহু ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকদের স্বপ্ন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে, সমাজে নাম হবে, এই মূলগত ভাবনা থেকেই বহু মানুষ তাঁদের সন্তানদের পাঠান এই প্রতিষ্ঠানে। যতজন এই আশা করে, ঠিক প্রায় সমপরিমাণ মানুষই আশঙ্কাও করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তান পড়তে এলেই ছাত্র রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়াশোনা জলাঞ্জলি দেবে। এই চিরকালীন আশা আকাঙ্খার মাঝেই এমন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথম বর্ষের ছাত্রের হস্টেলে অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে রাজ্য তোলপাড়। বাসে, ট্রামে, রাস্তাঘাটে, অফিসে, চায়ের দোকানে, সর্বত্র একটাই আলোচনা, এইভাবে বাবা মায়ের স্বপ্নকে কেন খুন করা হলো? প্রশ্ন উঠছে, যারা মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার চালিয়ে ছাত্রটিকে মেরে ফেলল, তারা শাস্তি পাবে তো? নাকি হাজারও অন্য ইস্যুর মতো রাজনৈতিক চাপানউতোর আর মিডিয়ার ট্রায়ালেই ইতি ঘটবে যাদবপুরের এই র্যাগিং কাণ্ডের? যে প্রশ্নটা এসবের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে তা হলো, র্যাগিংয়ের মতো একটি 'স্যাডিস্টিক প্লেজার' কারা পায়, কেন পায়?
এই র্যাগিং আসলে তো এক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এই ব্যাধি, যাকে মনস্তত্ত্বের ভাষায় ‘স্যাডিজম’ বলা হয়, তার জন্ম ও প্রসার সমাজের মধ্যে থেকেই হয়। ছোটবেলা থেকে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আচরণ থেকে অনেকের মনে এই প্রত্যয় তৈরি হয় যে ক্ষমতাবান ক্ষমতাহীনের উপর অত্যাচার করবে, এবং এটাই বুঝি সমাজের রীতি। ফলে এর দ্বিমুখী প্রভাব পড়ে। একজন রিকশাচালকের উপর, বা একজন সাধারণ সবজি বিক্রেতার উপর যখন হম্বিতম্বি করা হয় বা গায়ে হাত তোলার ঘটনা ঘটে, তখন সেখান থেকেই শেখে একজন শিশু। সে ভাবতে শেখে এটাই বোধহয় দস্তুর। ঘরের মধ্যে মহিলাদের যখন অত্যাচার করা হয়, তখন একজন কিশোর ভাবে এটাই বোধহয় নিয়ম। সেই শিশুরা, কিশোররা বড় হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে হয়, সে হয় ক্ষমতার হয়ে গলা ফাটায়, অথবা নিপীড়ন সহ্য করে। র্যাগিং বন্ধ করার নানাবিধ পদ্ধতির মধ্যে একটি অবশ্যই মনস্তাত্বিক কাউন্সেলিং, যা অবশ্যই অবিলম্বে শুরু করতে হবে অথচ এই গোড়ার বিষয়টিই আলোচনা থেকে হারিয়ে গিয়েছে যাদবপুরের ডামাডোলে।
আরও পড়ুন- সিসিটিভি বসালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুবিধাটা কোথায়?
এখন প্রশ্ন হলো, অনেক শিক্ষিত মানুষও কেন তথাকথিত ‘একটু আধটু র্যাগিং’-কে প্রশ্রয় দেন? তার একটা বড় কারণ, বিশেষত আমাদের মতো সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন সমাজে ‘পরম্পরা’ বা ট্র্যাডিশনের উপর বেশিরভাগ মানুষই আস্থা রাখতে পছন্দ করেন। তারা মনে করেন, যুগ যুগ ধরে যেহেতু এই প্রথা চলে আসছে, সেহেতু এর কার্যকারিতা আছে। সেই জন্যই ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির দৃশ্যে যখন দেখা যায়, নবাগত ছাত্ররা তাদের প্যান্ট খুলে, অন্তর্বাস দেখিয়ে বলছেন, ‘তুসি গ্রেট হো’ যে আমরা, মানসিক এবং শারীরিক র্যাগিংয়ের বিরোধিতা করি, তারাও কি তখন হেসে উঠি না? যদিও এটা পরিষ্কার যে এই ধরনের মনোভাব অনাধুনিক, সামন্ততান্ত্রিক ও অবৈজ্ঞানিক, তাও আমাদের ভিতরে যে সামন্ততন্ত্রের অবশেষ আছে, তা কখনও কখনও 'একটু আধটু র্যাগিং করা'কেই প্রশ্রয় দেয়।
সব মানুষই কমবেশি নৈতিকতায় চলেন। কারণ মানুষ বৃহত্তর অর্থে নৈতিক বা এথিক্যাল জীব। সেই জন্যই রাজনৈতিক নেতাদের প্রকাশ্যে ঘুষ নিতে দেখলে তাদের মধ্যে নীতিবোধ জাগ্রত হয়। র্যাগিংয়ের বিষয়েও সেই মানুষদের নীতিবোধ জাগ্রত করে তোলা একটা বড় কাজ। এমন অনৈতিক কাজে সে নিজে যেমন কখনও যুক্ত হবে না, তেমনই তার প্রতিবাদও প্রয়োজনে বা সুযোগ পেলেই সে করবে, এই ভাবনাটা ঢোকাতেই হবে। অন্তত একটা বছরের ছাত্রদের যদি সঠিকভাবে কাউন্সেলিং করা যায়, তাহলে পরবর্তীকালে তারাই যখন সিনিয়র হবে তখন র্যাগিং বিষয়টি নির্মূল করার লক্ষ্যে এক শতাংশ হলেও এগনো যাবে। কিছুদিন আগে, কলকাতার একটি বেসরকারি স্কুলের মেয়েদের শৌচালয়ে একটি শ্লীলতাহানিকে কেন্দ্র করে সেখানেও নজরদারি ক্যামেরা লাগানোর দাবি উঠেছিল সেখানকার অভিভাবকদের পক্ষ থেকেই। আসলে মানুষ বুঝতেই পারে না, কখন নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে নিজের গোপনীয়তা সে নিজেই রাষ্ট্রকে তুলে দেয় অজান্তে। শুধুমাত্র নজরদারি ক্যামেরা দিয়ে সারা বিশ্ববিদ্যালয় মুড়ে দিলেও সেই সমস্যার সমাধান হবে না যদি অপরাধ প্রবণতাকে চিহ্নিত করা না যায়। অপরাধী চিহ্নিত করা অবশ্যই দরকার, কিন্তু অপরাধকে নির্মূল করা বেশি জরুরি নয় কি?
আরও পড়ুন- কে তুমি?
এই ঘটনাকে সামনে রেখে বেশ কিছু সমষ্টিগত দাবি ওঠা শুরু হয়েছে। কেন যাদবপুরের মতো একটি উৎকৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সুরক্ষার স্বার্থে নজরদারি ক্যামেরা বসবে না? দাবি উঠছে, কেন পাশ করে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা বছরের পর বছর হস্টেলে থেকে যাবেন, কেনই বা বহিরাগতরা কোনওরকম বিধি নিষেধ না মেনে, যখন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবেন? যাদবপুর তো কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, কেন তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের সুরক্ষা নেই? কথা উঠছে, এই বন্দোবস্ত থাকলে কি এই প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা এড়ানো যেত? কিংবা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি লিংডো কমিশনের সুপারিশের কথা শুনে, অরাজনৈতিক ইউনিয়ন থাকতো, তাহলে কি এই হত্যা ঘটত না? এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, যদি র্যাগিং কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক অত্যাচার, অরাজনৈতিক ইউনিয়ন বা ক্যামেরা লাগিয়ে বন্ধ করাই যেত, তাহলে সিসিটিভিতে মোড়া আইআইটি বা এনআইটিতে এত ছাত্র আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন কেন? সবচেয়ে বড় যে দাবি উঠছে তা ভয়ঙ্কর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়টাই তুলে দেওয়া হোক। মূল চক্রান্ত এটিই, যা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। যে সময়ে দিল্লির শাহিনবাগ বা কলকাতার পার্কসার্কাস ময়দানে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে, মাসের পর মাস অবস্থান বিক্ষোভ হয়েছে, সেই বিক্ষোভে কারা মূলত অংশ নিয়েছিল, সেদিকে নজর দিলেই বিষয়টা অত্যন্ত পরিষ্কার হবে। দিল্লিতে ছিলেন জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়ার ছাত্রছাত্রীরা, আর কলকাতায় ছিলেন মূলত যাদবপুর, আলিয়া এবং প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীরা। যেদিন আসানসোলের হিংসার নেপথ্যে মদজোগানোয় অভিযুক্ত, তদানীন্তন বিজেপির সাংসদ এখন তৃণমূলের মন্ত্রী, যাদবপুরে অবরোধের মুখে পড়েন, সেদিনই কেন্দ্রীয় সরকার বুঝে গিয়েছিল, ফ্যাসিবাদীদের রুখতে পারে, যাদবপুরের গণতান্ত্রিক ছাত্রছাত্রীরা। কোভিডের সময় দীর্ঘদিন যাদবপুর অঞ্চলের বহু মানুষের মুখে খাবার জুগিয়েছে এই ছাত্রছাত্রীরাই। তাই, শাসক পোষিত মিডিয়ার কাছে যাদবপুর এক আতঙ্কের নাম।
মুখ্যমন্ত্রীও যখন সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করেন, তা খুব জেনেবুঝেই করেন। ২০২১ সালের ‘নো ভোট টু বিজেপি’র প্রচারের সব সুবিধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছেন, তাও কেন তিনি বিজেপির সুরে সুর মেলান তা নিয়ে ভাবার অবকাশ থেকেই যায়। আসলে ক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা শাসকশ্রেণিরই অংশ। হয়তো ঘটনাচক্রে একে অন্যের বিরোধী, কিন্তু শাসক তো শাসকই। যেভাবে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়াকে নিশানায় রাখা হয়েছে, সেই একই কায়দায় এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করে, মানুষের কাছে ছোট প্রমাণ করতে পারলেই কাজ হাসিল হবে। দায়িত্ব নিয়ে কোনও কোনও গণমাধ্যম সেই কাজটিতে মদতও দিচ্ছে। এসবের মাঝে র্যাগিংয়ের মতো ঘৃণ্য আচরণ ও একটি ছাত্রের মৃত্যু ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে, মফসসলের স্বপ্নের মতোই।

Whatsapp
