হারলেই 'নন্দঘোষ' ইভিএম? ভোটযন্ত্র-কারচুপির নেপথ্যে জড়িয়ে রাজনীতির যে খেল...

EVM Tampering: ইভিএম তখনই ঠিকঠাক কাজ করে, যখন নাগরিকেরা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন। গণতন্ত্রে এমনটাই কাম্য। তবে তা কি সবসময় আদৌ ঘটে! নাকি তার মধ্যেই থেকে যায় গড়মিল।

পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে তিনটিতেই নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে বিজেপি। প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট আসেনি কংগ্রেসের ঝুলিতে। শুধুমাত্র তেলঙ্গানাতেই ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়তে পেরেছে কংগ্রেস। রাজস্থান, মধ্য়প্রদেশ, মিজোরাম ও ছত্তীসগঢ়ে গো-হারান হেরেছে হাত-দল। মধ্যপ্রদেশে এক রকম জয় নিশ্চিত, এমনটাই মনে করেছিলেন দলের অনেকেই। রাজস্থান নিয়েও প্রত্যাশা ছিল। যদিও এই তিন রাজ্যে যে কংগ্রেসের ফাঁড়া রয়েছে তা নিয়ে আগেভাগেই সতর্ক করেছিলেন কংগ্রেসের ভোটকুশলী সুনীল কানুগোলু। তবে সে কথায় কান দেননি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। বরং ওই তিন রাজ্যে ভোটকুশলীর দায়িত্ব থেকে ছুটি দেওয়া হয় তাঁকে। তিন রাজ্যে এই হারের নেপথ্যে রয়েছে আদতে ইভিএম মেশিন। তেমনটাই সম্প্রতি দাবি করেছেন মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা কমল নাথ এবং দিগ্বিজয় সিং।

তবে এমন দাবি যে প্রথম কমলনাথরাই করলেন, তা কিন্তু নয়। বহু কিংবদন্তী নেতানেত্রীই এ যাবৎ এমন আশ্চর্য দাবি করে এসেছেন। সেই তালিকায় রয়েছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী থেকে মায়াবতী, অখিলেশ যাদব থেকে অরবিন্দ কেজরিবালের মতো অনেক বাঘা বাঘা নেতাই। তবে মজার ব্যাপার, ভোটে হারার পরেই সর্বদা ইভিএম মেশিনকে খলনায়ক মনে হয়েছে তাঁদের! যে রাজ্যে ব্যালটবাক্স যে দলের দখলে, সে রাজ্যে সেইসব দলনেতা বা নেত্রীদের এমন ইভিএম-বিভ্রাট চোখ পড়েনি কস্মিনকালেও। মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানের কোনও বিজেপি নেতার কাছে গিয়ে যদি আপনি ইভিএমের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন, তিনি রে রে করে উঠবেন। বলেও বসতে পারেন যে আপনি নরেন্দ্র মোদি-বিরোধী। মোদ্দা কথা, বিজয়ী রাজ্য ইভিএম মেশিন কোনও ভুল করে না, করতে পারে না।

আরও পড়ুন: শিবরাজকে ছেঁটে মোহনের হাতেই মধ্যপ্রদেশের ভার! নেপথ্যে বিজেপির ঠিক কোন অঙ্ক?

তবে কি ইভিএমের মস্তিষ্ক কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর! ইভিএম কখনও ভুল করতে পারে না? কিন্তু বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ইভিএমকে দিয়ে ভুল করানো কিন্তু সম্ভব। ইভিএম কারচুপি আজকের দিনে আর নতুন কোনও ব্যাপার নয়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে গোটা দেশ জুড়ে ভোটদানের কাজ সারা হয়েছে ইভিএম মেশিনে। সে সময়ে প্রায় ৩৭৩টি নির্বাচনী এলাকায় গৃহীত ভোট ও গণনার পরে ভোটের হিসেবে গড়মিল দেখা গিয়েছিল। অন্তত ১৮,৩৩১টি ভোটের হিসেবে গড়বড়। সেই প্রশ্নের উত্তরে নীরব ছিল ইলেকশন কমিশন অব ইন্ডিয়া। পরবর্তী কালে সেই ভোটের তথ্য নির্বাচনী কমিশনের ওয়েবসাইট থেকেও সরিয়ে নেওয়া হয়। গড়মিল যে একটা হয়েছে, তা সর্বসমক্ষে মানতে চায়নি কোনওপক্ষেই। আর তার কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ইলেকশন কমিশন অব ইন্ডিয়ার তরফে ভোট ও ইভিএম-প্রমাদ নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিল সিটিজেন কমিশন অব ইলেকশন (CCE)-কে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মদন লোকুরের নেতৃত্বে সেই রিপোর্টটি তৈরি করেছিলেন দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক শুভাশিস ব্যানার্জি। সত্যি কি ইভিএমের গোড়াতেই গলদ, নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবেই ভুল করানো হয় ইভিএমকে দিয়ে!

If EVM tampering did happen in the election, then how can democracy be saved?

ইভিএম তখনই ঠিকঠাক কাজ করছে, যখন সেটির মাধ্যমে নাগরিকেরা নিজেদের অধিকারটি প্রয়োগ করতে পারছেন। ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বেছে নিতে পারছেন নিজের পছন্দের গণপ্রতিনিধিকে। গণতন্ত্রে অন্তত এমনটাই কাম্য। তবে সেটা কি সবসময় আদৌ ঘটে! নাকি তার মধ্যেই থেকে যায় গড়মিল। এমন অনেক কাজই ইভিএমকে দিয়ে করানো হয়ে থাকে কখনও কখনও, যা গণতন্ত্রবিরোধী। আপনি যে বোতামে ভোট দিলেন, সেই বোতামে চিহ্নিত নেতার বাক্সেই ভোটটি গিয়ে জমবে, এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু কখনও কখনও এ-ও দেখা যায়, আপনি এক্স বটনটি প্রেস করে এক্স প্রার্থীকে ভোট দিলেন। কিন্তু সেই ভোটটি গিয়ে জমা পড়ল ওয়াই প্রার্থীর ভোটবাক্সে। আবার এমনটাও হতে পারে, আপনি এক্স বোতামটি টিপে এক্স প্রার্থীকেই ভোটটি দিলেন। সেটি এক্স প্রার্থীর ভোটবাক্সে জমাও পড়ল, তবে ভোটগণনার সময় সেটি গোনা হল ওয়াই প্রার্থীর খাতায়।

If EVM tampering did happen in the election, then how can democracy be saved?

ধরাবাঁধা এই তিনটি ছকেই যে কারচুপি হবে এমন কোনও কথা নেই। সাইবার ক্রাইম হোক বা ইভিএম কারচুপি, প্রতিদিন নতুন নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করা হচ্ছে কারচুপির। মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী রেবেকা মার্কুরি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে কোনও দিনই কোনও ইভিএম আক্ষরিক অর্থে হ্যাক-প্রুফ হতে পারে। তাঁর পরামর্শ ছিল, ইভিএমের সঙ্গে একটি ভিভিপ্যাটকে সংযুক্ত করার পর ইভিএম কাউন্ট ও ভিভিপ্যাট কাউন্টকে ক্রসচেক করা হোক, ঠিকঠাক ফলাফলে পৌঁছনোর জন্য। ইভিএম ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা, তার যাচাইও হয়ে যাবে এর ফলে।

২০২৯ সালেই প্রথমবার সারা ভারত জুড়ে ইভিএম-ভিভিপ্যাট মেশিনে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে ঝঞ্ঝাটবিহীন ভাবে নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ সম্ভব হবে। রাশ টানা যাবে রিগিংয়ের মতো সমস্যায়। তবে ইভিএম-ভিভিপ্যাট মেশিনের কন্ট্রোল ইউনিটের হার্ড ডিস্ক পাল্টে ফেললেই যে সেসব ঘটবে, তা কিন্তু নয়। সাইড-চ্যানেল হ্যাকিং-সহ আরও একাধিক পদ্ধতিতে যে ভোটে কারচুপি সম্ভব তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে একাধিক বার। এর জন্য ইলেকশন কমিশনও যে বেশ কিছুটা দায়ী, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। নির্বাচন কমিশন কোনওদিনই সার্বজনীনভাবে সোর্স কোড প্রকাশ করেনি। কী এই সোর্স কোড? সোর্স কোড হল, কম্পিউটারের ভাষায় লিখিত একগুচ্ছ নির্দেশাবলী, যা মেশিনের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশনের এই অনিহাকেই দায়ী করেছেন অনেকে এই বিপুল সংখ্যক ইভিএম কারচুপির জন্য।

If EVM tampering did happen in the election, then how can democracy be saved?

শুধুমাত্র এই সব গাফিলতির কারণেই সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিহীন হতে পারেনি এই ইভিএম। নাহলে ব্যালট-ভোটের থেকে ভোটগ্রহণের এই পদ্ধতি কিন্তু অনেক বেশি কার্যকরী ও দ্রুত বলেই মনে করেন অভিজ্ঞরা। অধ্যাপক শুভাশিস ব্যানার্জির মতে, এখনও উপায় আছে, যার মাধ্য়মে রিগিংহীন ভোট সম্ভব একই ইভিএম মেশিন থেকে। কীভাবে?

শুভাশিসবাবু জানাচ্ছেন, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি বুথে সমস্ত ভিভিপ্যাট স্লিপ গণনা করা গেলেই এই ধরনের সমস্যা থেকে রেহাই মিলবে। যদি ইভিএম গণনা দেখায়, এক্স ৫০০ ভোটে জিতেছেন, তাহলে ভিভিপ্যাট স্লিপগুলি ততক্ষণ গণনা করা হোক, যতক্ষণ না ৪৯৯টি বাকি থাকে। তার আগে কোনওভাবেই কাউকে জয়ী ঘোষণা করা যাবে না। এই পদ্ধতিকে বলা হয় রিস্ক-লিমিটিং অডিট। তবে তাতে সমস্যা অন্য জায়গায়। এ ক্ষেত্রে আপনি গণনার দিনেই ভোটের রেজাল্ট হাতে পাবেন না। তার জন্য আরও একটা দিন সময় লেগে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই অতি দ্রুততার পিছনের ছুটতে ছুটতে নির্ভুলতা থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে ছিটকে আসি আমরা। ভোটের ফলাফলও তার ব্যতিক্রম নয়।

আরও পড়ুন: মোদীকে অপয়া বলে ভোটে জেতা যায়?

পদ্ধতি তো জানা। প্রশ্নগুলোও। তবে তার পরেও কি কমবে এই ধরনের ইভিএম কারচুপি! আদতে তো এই ঘটনা গণতন্ত্রের অপমান। যে গণতান্ত্রিক অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিককে দিয়ে এসেছে সংবিধান। কিন্তু আজকের ভোট-বিশ্বে সত্যি কি কেউ জানতে চান, দেশের  সাধারণ মানুষ কী চান! তাঁরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাকে বেছে নিতে চান? নাকি সমস্ত নিয়ন্ত্রণটাই আসলে হাতে নিয়ে বসে রয়েছে অন্য কেউ। যার ইশারায় চলে নির্বাচন কমিশন থেকে সবকিছুই, এমনকী ইভিএম মেশিনও কথা বলে যাঁদের অঙ্গুলিহেলনে? আর সেখানেই কি ঘটতে শুরু করে না গণতন্ত্রের মৃত্যু?

More Articles