দুর্নীতি আর হিন্দুত্ববাদের মাঝে ভারত জোড়ার যাত্রা, ২০২২ যে শিক্ষা দিল ভারতকে...

2022 Important Political Events: রাজনীতিক থেকে মোদি যে গত আট বছরে দেবতুল্য হয়ে উঠেছেন, সদ্য সমাপ্ত গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেই মিলেছে তার প্রমাণ।

সমঝোতা থেকে সংঘাত, বছরভর চলল ওঠাপড়া, ঘটনার ঘনঘটা দেখল রাজনীতি। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে রাজনীতির সুবর্ণ দিন অতীতের গর্ভে বিলান বলে শোনা যায় শোক-সন্তাপ। বর্তমান দিনে রাজনীতি আসলে আখের গোছানোর মাধ্যম বলে দীর্ঘশ্বাসও ফেলেন কেউ কেউ। পক্ষ এবং বিপক্ষ মতের অভাব নেই যদিও, কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছরের রাজনীতিতে এমন সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি যে আগে কখনও হতে হয়নি ভারতকে, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধুমাত্র সময় নয়, রাজনীতিও এখন সতত পরিবর্তনশীল। নিত্যদিনের আকচাআকচি, গাল-গল্প নিয়েই লেখা যেতে পারে এক একটি আখ্যান। ‘অমৃতকালে’র সূচনাপর্বে, ২০২২ সালে এমনই কিছু মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাক্ষী রইল ভারত।

রাজনীতির একত্রীকরণ

কয়েক বছর আগে পর্যন্ত অন্যতম বিতর্কিত রাজনীতিক হিসেবে উঠে আসত তাঁর নাম। কিন্তু ২০২২ সালে শুধুমাত্র ভারতীয় জনতা পার্টি বা দলের অভিভাবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ নয়, দেশের রাজনীতিতে একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদি। বিপুল জনপ্রিয়তার সামনে গুজরাত পর্ব আজ ছায়াবৃত। ‘গুজরাত মডেলে’র মায়াস্বপ্ন আজ তাঁর সবচেয়ে বড় ইউএসপি। তাই বহির্শত্রুর আগ্রাসনের সামনে দাঁড়িয়েও, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে মৌনতা পালনের জন্যও জবাবদিহি করতে হয় না মোদিকে। রাজনীতিক থেকে তিনি যে গত আট বছরে দেবতুল্য হয়ে উঠেছেন, সদ্য সমাপ্ত গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেই মিলেছে তার প্রমাণ। শুধুমাত্র ভারতীয় জনতা পার্টিই নয়, বকলমে মোদি এখন দলের অভিভাবক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘকেও চালনা করছেন বলে উঠে আসছে তথ্য। প্রথা ভেঙে জাতীয় পতাকা উত্তোলন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির উদযাপন এবং সর্বোপরি প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনী কাজে অংশগ্রহণ, মোদির হাতেই সঙ্ঘের এমন উত্তরণ বলে মানছেন খোদ গেরুয়া শিবিরের লোকজনই। শুধু তাই নয়, বিজেপির অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী, বয়স ৭৫ হলে কোনও নেতার মন্ত্রিত্ব বা প্রাতিষ্ঠানিক পদে থাকা নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু মোদির জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে সেই নিয়মেও ইতি পড়তে চলেছে বলে খবর।

রক্তক্ষরণ

বাংলার পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিকে কার্যত গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। লড়াকু নেতা-নেত্রীদের তালিকায় আজও উপরের দিকেই রয়েছে নাম। রাজনৈতিক কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতে আঁচ লাগেনি কখনও। কিন্তু ২০২২ সালে আগাগোড়া কঠিন পরীক্ষার মধ্যেই কাটল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। শুধুমাত্র বিশ্বস্ত নন, বরাবরের ছায়াসঙ্গী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, গরু পাচার মামলায় অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারি, ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ, একটানা সরকার বিরোধী আন্দোলন, সেই সঙ্গে একদা ছায়াসঙ্গী থেকে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা শুভেন্দু অধিকারীর লাগাতার হুঁশিয়ারি, বছরভর শুধুমাত্র নাজেহাল হতে হয়নি, সরাসরি আঙুল উঠেছে মমতার দিকে। এক বছর আগে যেখানে সরাসরি মোদিক টেক্কা দেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছিল তাঁকে, এ বছর দলের হয়ে, সরকারের হয়ে সাফাই দিতেই কার্যত কেটে গিয়েছে। জমি আন্দোলনের নেত্রী খোদ পায়ের নিচের মাটি ধরে রাখতে ঘন ঘন দিল্লি ছুটছেন, এমন কটাক্ষও শুনতে হয়েছে। জননেত্রী, ‘স্ট্রিট ফাইটার’ মমতার সঙ্গে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে মেলাতে গিয়ে হিসেব গুলিয়ে গিয়েছে অনেকেরই।

আরও পড়ুন- আপই কি নয়া ‘কংগ্রেস’? গুজরাত নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে ধরছে বারবার

দেশ জুড়তে চাওয়া

রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর মাশুল গুনতে হচ্ছে বলে সমবেদনা জানিয়েছেন অনেকে। অনেকে আবার রাজনীতিক হিসেবে তাঁর যোগ্যতা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ২০২২ সালে অন্য রাহুল গান্ধীকে দেখল দেশ। পরিবারতন্ত্রের ফসল বলে তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বকে যত বেশি অস্বীকার করেছে বিজেপি, তত বেশি নিজেকে মাটির কাছাকাছি আনতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ২০২৪-এর প্রস্তুতি বা কংগ্রেসকে ধরে রাখা, অথবা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ, উদ্দেশ্য যাই হোক, রাহুলের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ স্বাধীনতা-উত্তর সর্ববৃহৎ জনসংযোগ কর্মসূচি। উদ্দেশ্য রাজনৈতিক হলেও, ভারতীয় সমাজনীতিকে ঢাল করেই এগিয়েছেন রাহুল। তাঁর মধ্যে ভারতকে চেনার, জানার, আরও বেশি করে ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্টা লক্ষ্য করেছেন অনেকে। তাই সমাজের একেবারে শীর্ষ এবং একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে সাড়াও মিলেছে ব্যাপক। তাতে কংগ্রেস কতটা আখের গোছাতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, রাহুলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের রাস্তা যে প্রশস্ত হয়েছে, তা মানছেন সকলেই।

স্বতন্ত্র পরিচয়

পালে হাওয়া লেগে তরতর করে এগিয়ে চলেছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। জন্মসূত্রে তার ভার বহন করে যাচ্ছিলেন নিজেও। কিন্তু সরকারিভাবে বার্ধক্যে পৌঁছে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করলেন বালাসাহেব ঠাকরের ছেলে, জন্মসূত্রে শিবসেনার নেতৃত্ব পাওয়া উদ্ধব ঠাকরে। বরাবরের শরিক, দলের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের শরিক বিজেপির হাত ছেড়ে গোড়াতেই সাড়া ফেলেছিলেন। অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়েও মাথা নত করলেন না উদ্ধব। তার জন্য যদিও কম কটাক্ষ শুনতে হয়নি তাঁকে। বালাসাহেবের ছেলে হওয়ার যোগ্য কিনা, কটাক্ষমিশ্রিত এমন প্রশ্নও উড়ে এসেছে তাঁর দিকে। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে নাম জুড়লেও, নিজস্ব মতামত, ব্যক্তিগত মতামতকেই প্রাধান্য দিতে দেখা গেল তাঁকে। শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিই ছাড়েননি, ক্ষমতা ধরে রাখতে নিজের দলের সৈনিকের সঙ্গেও আপসে যাননি। অটল থেকেছেন ব্যক্তিগত আদর্শেই। বয়স ৬০ পেরনোর পরও বাবার ছায়া কাটিয়ে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তোলার তাঁর এই প্রচেষ্টা সাধুবাদ পেয়েছে।

চাণক্য নীতি

নির্বাচনী কৌশল, কূটনীতিতে প্রতিপক্ষকে মাত দিতে পারলেই ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে তুলনা চলে আসে। কিন্তু সঠিক অর্থেই নিজেকে চাণক্য প্রমাণ করতে পেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গণ আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে পা রাখা কেজরিওয়ালের ধারালো বুদ্ধি নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছে বরাবরই। কিন্তু ২০২২ সালে আইআইটি ফেরত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী থেকে জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছেন তিনি। একের পর এক রাজ্যে আম আদমি পার্টির ডালপালা মেলার নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। তার জন্য প্রতি মুহূর্তে নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন। শিক্ষা-স্বাস্থ্য এবং জনমোহিনী প্রকল্পে ভরসা করেননি শুধু। বরং সুবিধা মতো হিন্দুত্বের তাসে চাল দিতেও পিছপা হননি। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কখনও মহাত্মা গান্ধীর ছবির পাশে নোটে লক্ষ্মী-গণেশের ছবি ছাপার কথা বলেছেন, কখনও আবার স্কুলের পাঠ্যক্রমে দেশভক্তি সেখানোর সুপারিশ করেছেন। এমনকী হনুমান চালিশায় গেয়ে শোনাতেও কসুর করেননি। তার জন্য কেজরিওয়াল আসলে বিজেপির ‘বি’ টিম, বিজেপির বিকল্প হতে চাইছেন, এমন নানা দাবি উঠে এসেছে। কিন্তু আলোচনা, বিতর্কে আসলে লাভবান হয়েছেন তিনিই। শুধু জাতীয় নেতাই নয়, ২০২৪-এ মোদির প্রতিপক্ষ হিসেবে বিরোধী শিবিরের কাছে সুকৌশলে নিজের দরও বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন।

আরও পড়ুন- দেশের সবচেয়ে গরিব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! জেনে নিন তাঁর ‘সামান্য’ সম্পত্তির পরিমাণ

গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি

দীর্ঘ সময় পর খাতয় কলমে নেহরু-গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বমুক্ত দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। ২০১৪-র পর থেকে যত সময় এগিয়েছে, ততই বেশি করে ধরাশায়ী হতে হয়েছে তাদের। তার জন্য এ যাবৎ গান্ধী পরিবারের দিকেই আঙুল উঠেছে। পরিবারতন্ত্র টিকিয়ে রাখার অভিযোগ উঠেছে বার বার। এ বার তাই সভাপতি নির্বাচনে অংশই নেননি গান্ধী পরিবারের কোনও সদস্য। বরং অভিজ্ঞ দলিত নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সভাপতিত্ব। গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ খড়্গ আদৌ স্বাধীন ভাবে দলকে পরিচালনা করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে যদিও প্রশ্ন রয়েছে। তবে ২০২৪-এর আগে দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে থাকা সভাপতি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ায় দল বাড়তি অক্সিজেন পাবে বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।

হাতের পুতুল

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতে পুলিশ থেকে গোয়েন্দাদের পুতুল হয়ে ওঠা নিয়ে টিপ্পনি করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত দেশের রাজনীতি সরগরম থাকল সেই চর্চাতেই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, আয়কর দফতরকে বিরোধী শিবিরকে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠল কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। দিল্লি, বাংলা, মহারাষ্ট্র, কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলিতে বেছে বেছে বিরোধী শিবিরের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করার অভিযোগ। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া, দীর্ঘদিন হেফাজতে রেখে বিরোধী শিবিরের নেতাদের হেনস্থা করাই উদ্দেশ্য বলে দাবি অবিজেপি দলগুলির। তাতে সংস্থাগুলির নিরপেক্ষতাও প্রশ্নের মুখে।

 

More Articles