সেলফি তুলতে গিয়ে সর্বাধিক মৃত্যু ভারতেই, আপনি ‘সেলফিটিস’-এ আক্রান্ত?

আলেকজান্ডার সেই কবে বলেছিলেন, সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ! সত্যই বটে, ভারত আজও বিচিত্র!

বিচিত্র হুজুগে বিপদ মাথায় নিয়ে সেলফি তোলার নিরিখে মৃত্যুর ঘটনায় ভারত পৃথিবীর চারটি দেশের মধ্যে শীর্ষে। বাকি তিনটি দেশের নাম রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান।

সেলফি তোলার হুজুগটা অসুখ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২০১৪ সালে। অসুখের নাম ‘সেলফিটিস’। অসুখটি চিহ্নিত করেছে আমেরিকান সাইক্রিয়াটিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। ‘সেলফিটিস’ এক ধরনের মানসিক ডিসঅর্ডার। সেলফিটিসে আক্রান্ত হলে ঘন ঘন সেলফি তুলতে ইচ্ছা করবে এবং এই রোগে আক্রান্ত মানুষ মোবাইলে দৈনিক তিনটি থেকে আটটি পর্যন্ত সেলফি তুলবেনই। হয়তো তিনি জানেনই না, আসলে কী রোগ দানা বাঁধছে! প্রসঙ্গত, ঘন ঘন সেলফি তোলার এই রোগের নিরাময় সম্ভব কগনিটিভ বিহেভোরিয়াল থেরাপির মাধ্যমে!

আরও পড়ুন: দৃষ্টি ফিরে পাবে অন্ধ! অসাধ্যসাধন থেকে একহাত দূরে দাড়িয়ে ওঁরা

ভারতীয় জনগণ সেলফি তুলতে গিয়ে জলে ডুবে, পাহাড় থেকে পড়ে, ট্রেনের ধাক্কায় গত এক দশকের বেশি সময় ধরে মারা গেছে। তথ্য বলছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের গোড়া পর্যন্ত সেলফিজনিত দুর্ঘটনায় কয়েকশো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেলফিজনিত দুর্ঘটনাগুলির ফলে ২০১৭ সালে ১০৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা এই সময়সীমাতে সর্বাধিক।

সেলফি তোলার ফলে মৃত্যুর ব্যাপারে নজির সৃষ্টি করেছে পশ্চিমবঙ্গ। গত বছরের নভেম্বরে আলিপুরদুয়ারের মেটেলি চা-বাগানে এক কিশোর ভাল্লুকের সঙ্গে হাসিমুখে সেলফি তুলতে গিয়ে সেই ভাল্লুকের আক্রমণে মারা গিয়েছে। পরে ভাল্লুকটিকেও পিটিয়ে মেরেছে জনতা।

স্মার্টফোনের বদনাম বিশ্বজুড়েই। সেলফিটিসের কারণ হাতের স্মার্টফোনই। এদিকে হু হু করে বিশ্বজুড়েই বাড়ছে স্মার্টফোনের ব্যবহারকারী। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৫ সালের ভেতর স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭.৩৩ বিলিয়ন। সেলফি তুলে সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড না করা পর্যন্ত শান্তি পান না অনেকেই। ২০৪০ সালের মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন ভারতীয় নাগরিক ফেসবুক ব্যবহার করবেন বলে গবেষকদের পূর্বাভাস। সেই ফেসবুকে সেলফি পোস্ট করার হিড়িকও যেন বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো!

মেয়েরা নাকি নিজেদের ঘুরেফিরে বারেবারে দেখতে ভালবাসে– এমন একটি প্রচলিত সামাজিক ধারণা রয়েছে। তবে এই ধারণা বোধহয় এবার ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে চলেছে। কেননা, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিপজ্জনকভাবে সেলফি তুলতে গিয়ে যাঁরা ডুবে, পাহাড় অথবা উঁচু বাড়ি থেকে পড়ে মারা যাচ্ছেন– তাঁদের অধিকাংশই পুরুষ। রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান– এই তিনটি দেশেও ভারতের পাশাপাশি বিপজ্জনকভাবে সেলফি তুলতে গিয়ে পুরুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে মেয়েদের তুলনায়  দ্বিগুণেরও বেশি সংখ্যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সেলফি তুলতে গিয়ে ৭২.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের মৃত্যু হচ্ছে। বাকি ২৭.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হলেও বিপজ্জনক এলাকাগুলিতে 'নো সেলফি বোর্ড' টাঙানোর ব্যবস্থা নেই। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে, গুজরাট সরকার ডাং জেলায় সেলফি তোলা পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পর্যটকরা সেলফি তুলতে গিয়ে ধরা পড়লে ফৌজদারি অপরাধের মামলা দায়ের করা হবে বলে সতর্ক করেছে পুলিশ।

সারা পৃথিবীতে সেলফিজনিত দুর্ঘটনায় যত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়, এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ভারতে। আর মৃতদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই যুব সম্প্রদায়ের। পৃথিবীর অন্য দেশগুলির মতো ভারতেও ১৬ থেকে ২০ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঘনঘন সেলফি তোলার প্রবণতা বেশি।

গবেষণায় এও দেখা গিয়েছে, যাঁরা দিনে বারংবার সেলফি তোলেন সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার লাইক এবং লাগাতার কমেন্ট পেতে– তাঁরা আদতে উপভোগ করেন সামাজিক স্বীকৃতির ভার্চুয়াল স্বাদ। এঁদের অনেকে বলেছেন, বারবার সেলফি তুললে তাঁদের মানসিক উদ্বেগজনিত চিন্তা বা স্ট্রেস কমে।

তিনটি পর্যায় আছে সেলফিটিসের– বর্ডার লাইন, অ্যাকিউট এবং ক্রনিক পর্যায়। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড অ্যাডিকশন’–এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা দেদার সেলফি তোলাটা জীবনযাপনের অঙ্গ করে তুলেছেন, আসলে তাঁদের ভেতর কোথাও আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। এ-ব্যাপারে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন এই পেপারের অন্যতম লেখক গবেষক জি বালাকৃষ্ণণ।

অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েরা ঘন ঘন সেলফি তুললে অভিভাবকদের বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ হওয়া উচিত। দরকার হলে কাউন্সেলিং করানো উচিত। তবে কাজটা সহজ নয়। কেননা যদি হঠাৎই কাউকে ঘন ঘন সেলফি তোলার অভ্যাস থেকে জোর করে নিবৃত্ত করা হয়, সেক্ষেত্রে সেই মানুষটির মনে অস্বাভাবিক ধরনের চাঞ্চল্য দেখা দিতে পারে। এছাড়া তার আত্মবিশ্বাসও তলানিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। আর নিঃসঙ্গতার জেরে বাড়ে যন্ত্রণা। এই কারণেই দরকার সাইকোলজিস্ট কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এগোনো।

কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক যে মহিলারা অনবরতই সেলফি তুলছেন– এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই আবার নিজেদের শরীরের গঠন নিয়ে বেজায় মানসিক অসন্তুষ্টিতে ভুগছেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সেলফিটিসে আক্রান্ত হওয়ায় নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে এদের ভেতর নানা অবাস্তব ধারণা তৈরি হয়। বিশেষত, ওজন নিয়ে সবসময়ে খুঁতখুঁত করেন এঁরা।

লাগাতার সেলফি না তুলে কবিগুরুর বাণী স্মরণ করুন বরং– ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা...’

 

More Articles