বাইশ গজে শোয়েব আখতারও ভয় পেতেন তাঁকে, আজও ভারতীয় ক্রিকেটের ভরসার 'দেওয়াল' রাহুল দ্রাবিড়
Rahul Dravid 'The Wall' of Indian Cricket : ক্রিকেটের পিচে অজস্র হাফ সেঞ্চুরি করলেও, এবার জীবনের পিচেও ৫০ ছুঁলেন দ্রাবিড়। অবশ্য এসব ভাবার সময় আছে নাকি?
সালটা ২০০১। ইডেন গার্ডেনের দর্শকরা বোধহয় হাতের নখ কামড়ে শেষ করে ফেলেছেন। প্রেস বক্সেও উৎকণ্ঠা। কমেন্ত্রি বক্স বলছে, ভারতের বিদায় ডঙ্কা বেজে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট সিরিজ চলছে। তাও কোন অস্ট্রেলিয়া? গিলক্রিস্ট, হেডেন, পন্টিং, ল্যাঙ্গার, স্টিভ ওয়ার ব্যাট; সঙ্গে বোলিংয়ে ম্যাকগ্রা, গিলেসপির সঙ্গে শেন ওয়ার্ন। ওপর থেকে নিচ অবধি প্রত্যেকে শক্তিশালী, দুরন্ত ফর্মে। একবিংশ শতকের শুরুতেই নিজেদের কিংবদন্তি ও অপ্রতিরোধ্য দল হিসেবে প্রমাণ দিয়ে দিয়েছে এই অস্ট্রেলিয়া। প্রথম টেস্টেই দেখা গেল তাদের দাপট। ভারতকে কার্যত উড়িয়ে দিল ক্যাঙ্গারু ব্রিগেড।
এদিকে ভারতীয় ক্রিকেট তখন টালমাটাল একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে ঝড় উঠেছে গোটা পৃথিবীতে। ভারতের তারকা ক্রিকেটার মহম্মদ আজহারউদ্দিনও ফিক্সিং কাণ্ডে জড়িত হয়ে গেলেন। শচিন টেন্ডুলকরের নেতৃত্বে ভারত সেরকম কিছু করতে পারছে না। শেষমেশ নেতৃত্ব ছাড়লেন শচিন। সেই জায়গায় এলেন বাংলার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। নতুন এই ভারতীয় টিমের দায়িত্ব অনেক। মানুষের মধ্যে থেকে বাইশ গজের লড়াইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা উঠে যাচ্ছে। মাফিয়া কিং দাউদ ইব্রাহিম ও তার ডি-কোম্পানির ‘জুজু’ দেখছে সবাই। সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে একটি টেস্ট সিরিজ। যদি জিতে যায় ভারত, আবারও সেই উদ্যম ফিরে আসবে। কিন্তু, হচ্ছেটা কোথায়?
দ্বিতীয় টেস্ট কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়প্রমাণ ৪৪৫ তাড়া করতে নেমে মাত্র ১৭১-এ গুটিয়ে গেল ভারত। ফলো অনেও একে একে উইকেট পড়তে শুরু করল। প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন সৌরভ, শচিন। এরপর যে ঘটনাটা ঘটল, সেটাকে মহাকাব্য বললে কম বলা হয়। দক্ষিণ ভারতের দুই তরুণ ক্রিকেটার নামলেন ক্রিজে। বাকিটা ইতিহাস। তখন শচিন ব্যাকফুটে। ওরকম অস্ট্রেলিয়া দলও অসহায় হয়ে দেখল ওই দুই তরুণকে। ক্রিজে তখন রাজত্ব করছেন ভিভিএস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড়। পরিসংখ্যান এখন থাক – লেখা রইল কেবল দুটি সংখ্যা। ২৮১ ও ১৮০। আজও ইডেনে গেলে ঠিক বাইরে লক্ষ্মণ আর দ্রাবিড়ের সেই ম্যাচের ছবি। ক্রিকেটের পিচে অজস্র হাফ সেঞ্চুরি করলেও, এবার জীবনের পিচেও ৫০ ছুঁলেন দ্রাবিড়। অবশ্য তিনি এখন ভারতের কোচ। এসব ভাবার সময় আছে নাকি?
আজকের পাকা চুল, বয়সের ছাপ পড়া রাহুল দ্রাবিড়কে দেখলে বারবার সেই সোনালি সময়ের কথা মনে পড়ে। একটি ইন্টারভিউয়ে পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার, পেসার শোয়েব আখতারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন ক্রিকেটারকে বল করতে একেবারে ভালো লাগত না। উত্তরে একটাই নাম বলেছিলেন শোয়েব – রাহুল দ্রাবিড়। কেন? শোয়েব বলেছিলেন, অত দৌড়ে এসে, ঘণ্টায় প্রায় ১৫০ কিমি গতিবেগে বল করার পরও কি অনায়াসে সেটা থামিয়ে দিতেন দ্রাবিড়! যতই বল করো না কেন, সেট হয়ে যাওয়ার পর ওঁকে আউট করা মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।
কেবল শোয়েব আখতারই নন, এমন বয়ান খুঁজলে আরও অনেকেরই পাওয়া যাবে। দেওয়ালের সঙ্গে ভারতের জনজীবন, রাজনীতি আর স্কুল-কলেজের যোগসূত্র অনেক দীর্ঘ। দেওয়াললিখন, দেওয়াল পত্রিকা থেকে ঘুঁটে দেওয়া, কিংবা পরিবারের মাথার ওপর ছাদ – সেটাও তো দেওয়ালই বটে! সমস্ত বিপদ আপদ, ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে মানুষকে রক্ষা করে এটি। রাহুল দ্রাবিড় যেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের সেই অবিসংবাদী ‘দেওয়াল’। Dravid, ‘the Wall’। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বজয়ী অধিনায়ক স্টিভ ওয়া একবার দ্রাবিড় সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন। “ওঁকে বেশি সময় দেওয়া উচিত নয়। প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যে ওঁকে আউট করার চেষ্টা করতে হবে। যদি না হন, তাহলে কপালে দুঃখ আছে।” সত্যিই তো, ওইরকম প্রতিরোধ, টেকনিক, ধৈর্য – তার কণামাত্র কারও মধ্যে দেখা গেলে বলা হয়, ‘ওই দেখো, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো খেলে!’
শোয়েব আখতারের দুঃখটা অমূলক নয়। বারবার ছুটে এসে, হাজার রকম কায়দায়, সিমে-সুইংয়ে, বাউন্সের অস্ত্রভাণ্ডার বের করলেও রাহুল দ্রাবিড় নির্লিপ্ত। ডিফেন্সে একেবারে অটুট তিনি। আর এই টেকনিকটাই বিপক্ষের তাবড় বোলারদের বিরক্তি ধরিয়ে দিত। টেস্ট ক্রিকেটের এক নিখুঁত শিল্পী তিনি। আর ম্যাচ? ২০০২-র ইংল্যান্ড সফর, ২০০১-র ইডেন গার্ডেন থেকে ২০১১-র ইংল্যান্ড – যে কোনও জায়গায় যে কোনও পরিস্থিতিতে তিনিই ভরসা। টেস্ট ক্রিকেটে ১৬৪টি ম্যাচে ১৩ হাজারেরও বেশি রান, ৩১ হাজারের ওপর বল ফেস করা, ৩৬টি সেঞ্চুরির মধ্যে ডবল সেঞ্চুরিই পাঁচটি – অতিমানব ছিলেন কি?
২০১১ সালের ইংল্যান্ড সফরের কথাই ধরা যাক। সদ্য বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। স্বাভাবিকভাবেই ফেভারিট ধোনি, শচিনরা। কিন্তু ইংল্যান্ডের টেস্ট সিরিজ যেন ধস নামিয়ে দিল। ৪-০ হোয়াইটওয়াশ হয় টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু গোটা টুর্নামেন্টে একজন ছিলেন, যিনি হেরে যাওয়ার পরও বারবার রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সঙ্গী ছিল অতুলনীয় টেকনিক, ধৈর্য, অ্যান্ডারসন-ব্রডের বিষাক্ত সুইং খেলার ক্ষমতা… আর সেই কালান্তক ডিফেন্স। তিনটে সেঞ্চুরি, ৪৬১ রান – গোটা ইংল্যান্ড উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়ের জন্য।
২০০৪ সালে অধিনায়কত্ব নেওয়ার পর রাহুল দ্রাবিড়ের এক আলাদা অধ্যায়। গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে টিম ইন্ডিয়া ও সৌরভ গাঙ্গুলির সংঘাতের মধ্যে পড়ে যান দ্রাবিড়। ২০০৪-২০০৭ এই সময়টা হয়তো স্বপ্নে বারবার ফিরে আসত খেলোয়াড় দ্রাবিড়ের। কিন্তু তিনি যে ‘মিঃ ডিপেন্ডেবল’। তাঁর ওপর ভরসা রাখা যায়। আর সেই ভরসার ফসল হয়ে জন্ম নিয়েছেন শ্রেয়স আইয়ার, পৃথ্বী শ, শুভমান গিলের মতো অজস্র তরুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটার। এই মুহূর্তে তাঁরা ভারতীয় টিমের ভবিষ্যৎ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছেন। আর প্রত্যেকের মুখে একটাই নাম – ‘দ্রাবিড় স্যার’।
তিনি যেন কোটা ফ্যাক্টরির সেই জিতু ভাইয়া; যার কাছে পড়লে চূড়ান্ত সমস্যাও জলের মতো সহজ হয়ে যায়। নিয়মানুবর্তিতা বজায় রেখে, সিনিয়র হিসেবে মিশে প্রত্যেকের ভেতর থেকে সেরাটা বের করে আনার কাজ করছেন প্রাক্তনী রাহুল দ্রাবিড়। ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি বা এনসিএ-র হেড হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এখন ভারতের কোচ। জিতু ভাইয়া এখন আরও বড়ো দায়িত্বে। তাঁর ওপর তো বিশ্বাস করাই যায়, নাকি!