ব্রিটিশদের গুঁড়িয়ে দিয়ে বিশ্বজয়, 'আমরাই পারি' প্রমাণ করে দেখাল ভারতের শেফালি, তিতাসরা
India Women U-19 T20 World Champion : ১৯৮৩, ২০০৭, ২০১১-র পাশে বরাবরের মতো জায়গা করে নিল ২০২৩-এর ২৯ জানুয়ারি। ইতিহাসের একটা অধ্যায়...
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ – বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এই উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিতি তো অনেকদিনের। তবে ২৯ জানুয়ারি সেই নামটিই একটু বদলে গেল। ‘তিতাস একটি ঝড়ের নাম, আগুনের নাম’। আর সেই আগুনের ওপর ভর করেই ফের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল দেশ। ১৯৮৩, ২০০৭, ২০১১ – এই তিন বছরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারতের ক্রিকেট দল। ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৯ দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও হয়েছে বেশ কয়েকবার। তবে এবার তেরঙ্গা ওড়ানোর ভার নিলেন ভারতের নারী ব্রিগেড। ভারতের মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলটি কার্যত ঝড় তুলল। সেই সুবাদেই প্রথমবার অনূর্ধ্ব-১৯ টি-২০ বিশ্বকাপ জিতল ভারতের মেয়েরা।
অবশ্য তার আগে বারবার শেষ পর্যায় এসে হতাশ হয়েছে ভারতের মহিলা ব্রিগেড। মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী, হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মান্ধানাদের দল এর আগে বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়েছিল। কিন্তু ফাইনালে গিয়ে ইংল্যান্ডের কাছে হারতে হয়। ২০১৭ মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ভারতের মাটিতে একটা বিপ্লব তৈরি করেছিল ঠিকই। মিতালি-ঝুলনদের সেরা পারফর্মেন্সের পর এই দেশে মহিলা ক্রিকেটের ছবিটা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। আজ এত ক্যামেরা, স্মৃতি মান্ধানার ইনিংস দেখে সবাই চমকে ওঠেন বারবার, মিতালি-ঝুলনের মতো কিংবদন্তিদের স্যালুট জানায় গোটা বিশ্ব।
আরও পড়ুন : ১৮ বছরেই বিশ্বজয়! বাংলার তিতাস সাধুই তবে আগামীর ঝুলন গোস্বামী?
ভারতের মহিলা ক্রিকেটে অচলায়তন ভাঙার হাওয়া বইতে শুরু করেছে ঠিকই। কিন্তু দুঃখ ছিল একটাই। দেশের মহিলা ক্রিকেট দল কখনও বিশ্বকাপ জিততে পারল না। শেষ পর্যায় গিয়েও পারেনি। বারবার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে ইংল্যান্ড। আর আজ? ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩। সেই ইংল্যান্ডকে কার্যত দুরমুশ করে দিল ভারতের ছোটরা। অনূর্ধ্ব-১৯ মেয়েদের পারফর্মেন্স দেখে একরাশ স্বপ্ন বোধহয় ঝকঝক করে উঠছে মিতালি রাজদের চোখে। হয়তো ভাবছেন, “আমরা যা পারিনি, এই ছোটরা সেটা করে দেখাল”। অধিনায়ক শেফালি ভার্মা, রিচা ঘোষরা যে ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সেই কথাই প্রমাণ হল। তাঁদের হাত ধরেই যে প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হল ভারতের দামাল মহিলারা!
ভারতের মহিলা ক্রিকেটারদের প্রথমবার বিশ্বজয়
শেফালি, রিচা – এই দুজন ইতিমধ্যেই ক্রিকেট মহলে বিখ্যাত। ভারতের মহিলাদের সিনিয়র টিমেও নিয়মিত খেলেছেন। কিন্তু বাকিরা? সেভাবে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ক’জনের? মেয়েরা খেলবে, সেটাই অনেকে ভাবতে পারেন না। তিতাস সাধু, সোনম যাদব, গোঙ্গাদি তৃষা, শ্বেতা শেরাওয়াতদের সেভাবে চিনত কেউ? এখন অবশ্য এঁদের নামই সবার মুখে মুখে ফিরছে। বিশেষ করে তিতাস সাধুর নাম। বাংলার মেয়ে, উচ্চতা ভালো, পেস বোলিং করেন। তিনি একাই ফাইনালের আলো ছিনিয়ে নিলেন। ৪ ওভারে মাত্র ৬ রান দিয়ে ২ টি উইকেট – স্বপ্নের এই স্পেলই ছিনিয়ে এনেছে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের শিরোপা। ভারতের বোলিংই এদিনের আসল রাজা। ১৭.১ ওভারে ইংল্যান্ডকে মাত্র ৬৮ রানে আটকে দেয় ভারতের বোলাররা। বাকিটা তো কেবল সময়ের অপেক্ষা।
আরও পড়ুন : বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতের জয়ের নেপথ্যে বাংলা, যে তিন কন্যার হাতেই রয়েছে আগামীর ব্যাটন
তিতাসের খেলা মনে করাচ্ছে আরও একজনের কথা। ২০২২-এই তিনি অবসর নিয়েছেন। তিনিও বাংলার ঘরের একেবারে সাধারণ মেয়ে, তিনি ‘চাকদা এক্সপ্রেস’। ঝুলন গোস্বামীরা যে ভিত তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, তাকেই আরও শক্তপোক্ত, মজবুত বানাচ্ছেন শেফালি, তিতাস, রিচারা। মাত্র কয়েকদিন আগেই টেনিসের গ্র্যান্ড স্ল্যামের মঞ্চ থেকে অবসর নিলেন সানিয়া মির্জা। এঁরাই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন বারবার। অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে নিজের পরিশ্রম, খেলা আর দক্ষতাকে। শেফালি ভার্মা, রিচা ঘোষরা সেই স্পর্ধারই যোগ্য উত্তরাধিকার। সমস্ত শেকল ভেঙে দেখিয়ে দিয়েছেন, পারলে আসলে তাঁরাই পারবেন। ১৯৮৩, ২০০৭, ২০১১-র পাশে বরাবরের মতো জায়গা করে নিল ২০২৩-এর ২৯ জানুয়ারি। ইতিহাসের একটা অধ্যায় হয়ে রইল। কিংবা বলা যায়, আগামী আরও বহু বছরের রুটম্যাপ তৈরি হয়ে গেল।
বিসিসিআই ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলাদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলকে ৫ কোটি টাকা পুরস্কারের ঘোষণা করেছে। ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী টি-২০ লিগগুলোতেও এঁরা জায়গা পাবেন। মহিলাদের আইপিএলেও জায়গা পাবেন তিতাসরা। কয়েক মাস আগেই ভারতীয় ক্রিকেটে পুরুষ ও মহিলাদের বেতন বৈষম্যের ব্যাপারটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন আর ‘ব্যাটসম্যান’ বলা হয় না, মেয়েদের দাপটে সেই কথাটি বদলে গিয়ে হয়েছে ‘ব্যাটার’। এভাবেই বিপ্লব আসে। এভাবেই সূর্য ওঠে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর শেফালিদের কান্না, আনন্দে ফেটে পড়ার দৃশ্য, উইকেট হাতে চিৎকার করা – সেই স্পর্ধাকেই সামনে আনে। “আমি ভয় করব না ভয় করব না” – এই বাণীই এখন ভারতের মহিলা ব্রিগেডের মন্ত্র। হ্যাঁ, আমরাও পারি। আমরাই ইতিহাস তৈরি করতে পারি।