লোপাট কোটি কোটি টাকা, ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির শিকড় কতটা গভীরে?

আকার-আকৃতিতে এটিই এখনও পর্যন্ত ভারতে ঘটা সমস্ত ব্যাঙ্ক জালিয়াতির মধ্যে সবথেকে বড়। দেশের ১৭টি ব্যাঙ্ক থেকে উধাও ৩৪,৬১৪ কোটি টাকা।

নীরব মোদির করা ব্যাঙ্ক জালিয়াতির রেশ কাটতে না কাটতেই, আবারও নতুন একটি ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ছায়া পড়ল ভারতীয় অর্থনীতিতে। আকার-আকৃতিতে এটিই এখনও পর্যন্ত ভারতে ঘটা সমস্ত ব্যাঙ্ক জালিয়াতির মধ্যে সবথেকে বড়। দেশের ১৭টি ব্যাঙ্ক থেকে উধাও ৩৪,৬১৪ কোটি টাকা। আর এই অভিযোগেই এবার নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিওয়ান হাউজিং ফিন্যান্স কর্পোরেশন লিমিটেড-এর (ডিএইচএফএল) প্রোমোটার তথা প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কপিল ওয়াধওয়ান এবং প্রাক্তন ডিরেক্টর ধীরাজ ওয়াধওয়ানের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করল সিবিআই।

ধারে-ভারে নীরব মোদির প্রায় ৩ গুণের সমান এই ব্যাঙ্ক জালিয়াতির টাকার অঙ্কটা। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র নেতৃত্বাধীন ১৭টি ব্যাঙ্ক থেকে ঘটানো হয়েছিল এই বিশাল ঋণ জালিয়াতি। এমনিতেই ভারতীয় অর্থনীতি বেশ কিছু খারাপ ঋণের কারণে জর্জরিত। তার মধ্যেই আবার এই নতুন জালিয়াতির মামলা রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় অর্থনীতিকে। গত বছর রিপোর্ট করা ABG শিপইয়ার্ডের ২০,০০০ কোটি টাকার জালিয়াতির থেকেও বড় এই DHFL জালিয়াতি। ইতিমধ্যেই এই মামলার তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। এই মামলার তদন্তের জন্য ৫০ জনের বেশি অফিসারের একটি টিম গঠন করেছে সিবিআই। এই মামলার বেশ কিছু দিকের তদন্তের জন্য ১২টি জায়গায় ইতিমধ্যেই তল্লাশি চালিয়েছে সিবিআই।

তবে জালিয়াতি মামলায় এর আগেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে ওয়াধওয়ান পরিবারের বিরুদ্ধে। এর আগে ইয়েস ব্যাঙ্ক জালিয়াতি মামলায় রানা কাপুরের সহায়তা করার জন্যও অভিযুক্ত রয়েছেন কপিল এবং ধীরাজ। সেই মামলায় একাধিক অবৈধ লেনদেন এবং অর্থ তছরুপের অভিযোগ উঠেছিল কপিল এবং ধীরাজের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধেও উঠেছিল ইয়েস ব্যাঙ্ক মামলার অভিযোগ। কিন্তু, সেই সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে এই মুহূর্তে ভারতের সবথেকে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতি মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হয়ে উঠেছেন কপিল এবং ধীরাজ। কীভাবে এই ৩৪,০০০ কোটি টাকার জালিয়াতি সংঘটিত করলেন তাঁরা? কীভাবে ১৭টি ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ৩৪,০০০ কোটি টাকা তুললেন ওয়াধওয়ান ব্রাদার্স?

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ তার নীরব মোদি ও বিজয় মাল্য-দের নিয়ে কী করছে?

কী আসলে এই DHFL জালিয়াতি?
এই পুরো খেলাটা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। DHFL মূলত ছিল একটি নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যারা বড় ব্যাংকের থেকে লোন নিয়ে তাদের গ্রাহকদের ছোট ছোট আর্থিক ঋণ প্রদান করত। অনেক ছোট ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ এই সংস্থার থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় ২০১৯ সালে, যখন DHFL-এর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে এবং এই কোম্পানিটি দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে চলে আসে। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অভিযোগ জানিয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৮ এর সময়কালের মধ্যে ভারতের প্রায় ১৭টি ব্যাংক থেকে ৪২,৮৭১ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেছেন DHFL কর্তারা।

এতদুর পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু, ২০১৯ থেকেই ঋণখেলাপি শুরু করে DHFL। ২০১৯ সালেই এই DHFL সংস্থার বিরুদ্ধে তহবিল তছরূপের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে শুরু করে একাধিক অভিযোগ। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অভিযোগ জানায় ১৭টি ব্যাঙ্ক থেকে ৪২,৮৭১ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে DHFL সংস্থার কর্ণধাররা এই টাকা পাচার করেছেন এবং দীর্ঘ আট বছর ধরে এসব ব্যাঙ্কের সঙ্গে করেছেন ঋণখেলাপি। ১৭টি ব্যাঙ্কের সেই সময় সর্বমোট পাওনা টাকার পরিমাণ ছিল ৩৪,৬১৫ কোটি টাকা।

ক্ষতির পরিমাণ
অপরাধের ষড়যন্ত্র অভিযুক্ত কপিল ওয়াধওয়ান এবং অন্যান্যরা কনসর্টিয়াম ব্যাঙ্কের থেকে ৪২,৮৭১ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করার অনুরোধ রেখেছিল, এবং DHFL-এর খাতার মিথ্যা ব্যবহার করে তহবিলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও ব্যবহার করে এই সংস্থা। অসাধুভাবে ঋণখেলাপি এবং কনসর্টিয়াম ব্যাংকের বৈধ বকেয়া এবং তাদের ৩৪,৬১৫ কোটি টাকা অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে DHFL, এমনই অভিযোগ।

তবে শুধুমাত্র DHFL-ই যে রয়েছে অভিযোগের তালিকায়, সেরকম কিন্তু না। স্কাইলার্ক বিল্ডকন প্রাইভেট লিমিটেড, দর্শন ডেভলপারস প্রাইভেট লিমিটেড, সিগটিয়া কনস্ট্রাকশন বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেড, টাউনশিপ ডেভেলপার প্রাইভেট লিমিটেড, শিশির রিয়েলটি প্রাইভেট লিমিটেড এবং সানব্লিঙ্ক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডেরও নাম রয়েছে সিবিআইয়ের অভিযোগের তালিকায়।

কীভাবে খুলল এই জালিয়াতির জট?
২০১৯ সালে গোয়েন্দা প্ল‍্যাটফর্ম কোবরাপোস্ট তাদের একটি রিপোর্টে দাবি করে, নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক সংস্থা DHFL-এর কর্মকর্তারা জনগণের টাকাকে বিভিন্ন জায়গায় পাচার করার জন্য ভারতের ১৭টি ব্যাঙ্কের সঙ্গে একটি সিস্টেমেটিক জালিয়াতি করেছে। কোবরাপোস্ট দাবি করেছিল, এই সম্পূর্ণ জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছিল DHFL-এর শেয়ারহোল্ডারদের কাছে অদ্ভুত কিছু ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে। তাদের প্রক্সি এবং তাদের সহকারীদের কাছে কিছু সন্দেহজনক ঋণ দিয়ে এই পুরো টাকা পাচার করার পরিকল্পনা নিয়েছিল DHFL।

এই অভিযোগের ভিত্তিতে DHFL সংস্থার তরফ থেকে জারি করা হয় এটি বিবৃতি।

এই বিবৃতিতে DHFL দাবি করে, 'কোবরাপোস্টের এই সম্পূর্ণ তদন্ত এবং এই রিপোর্ট কোনও একটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে। DHFL কোম্পানির নাম খারাপ করার জন্য এবং তাদের ক্ষতি করার জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল রিপোর্ট তৈরি করেছে কোবরাপোস্ট। এই একটি রিপোর্টের কারণে DHFL সংস্থার শেয়ারহোল্ডার ভ্যালু অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে একদিনের মধ্যে। আজ সকালে ৮:৪৪ নাগাদ কোবরাপোস্টের করা ৬৪টি প্রশ্ন সম্বলিত একটি ইমেল আমাদের কাছে এসেছে। এই সমস্ত প্রশ্নগুলিকে দেখেই মনে হচ্ছে, কোনও একটি রাজনৈতিক কারণবশত কোবরাপোস্ট আমাদের সুনাম নষ্ট করার প্রচেষ্টায় তাদের এই রিপোর্ট তৈরি করেছিল।'

কিন্তু DHFL-এর এই বিবৃতিতে চিঁড়ে একেবারেই ভেজেনি। কোবরাপোস্টে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরেই ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যৌথভাবে একটি বৈঠকের আয়োজন করে সমস্ত ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলি। বৈঠকে এই ব্যাঙ্কগুলি ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের সময়কালে DHFL-এর সমস্ত হিসেব-নিকেশ খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষ একটি অডিটের সিদ্ধান্ত নেয়। অডিটের জন্য বহুজাতিক অ্যাকাউন্টিং সংস্থা কেপিএমজি-কে নিযুক্ত করে এই ব্যাংকের কনসর্টিয়াম। কেপিএমজি-র এই অডিট থেকেই খুলতে শুরু করে এই জালিয়াতির সমস্ত জট।

কী উঠে এসেছিল এই অডিট রিপোর্টে?
DHFL সমস্যা ছাড়াও কপিল এবং ধীরাজের উপরে কড়া নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করে এই সমস্ত ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলি। যাতে এই দুই ভাই দেশ ছেড়ে না পালাতে পারে তার জন্য ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর একটি বিশেষ নোটিশ জারি করা হয় তাদের বিরুদ্ধে। এরপর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসতে শুরু করে কেপিএমজি অডিট রিপোর্ট থেকে। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অভিযোগ করে, অডিটে DHFL এবং ওই সংস্থার তৎকালীন কর্তাদের লেনদেনের হিসেবে একাধিক অসংগতি লক্ষ করা গিয়েছে। অডিটে এই সংস্থার লেনদেন-সংক্রান্ত বিষয়ে লাল সর্তকতা জারি করে কেপিএমজি।

তারা দাবি করে, DHFL-এর বৈধ লেনদেনের আড়ালে এবং সংস্থার নাম করে একাধিক অবৈধ লেনদেন করা হয়েছে। এর বেশিরভাগ লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কপিল এবং ধীরাজের নাম। তাদের বিরুদ্ধেও সর্তকতা জারি করে কেপিএমজি। পাশাপাশি তারা এও লক্ষ করে, প্রায় ৬৬টি ভুয়ো সংস্থাকে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে DHFL। এই সংস্থাগুলির প্রোমোটার বা তাদের পরিচিতদের সঙ্গে DHFL কর্ণধারদের ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে বলে উঠে আসে তদন্তে। এদের মধ্যে বহু সংস্থার ডিরেক্টর এবং অডিটরের নাম, এমনকী ইমেল আইডি পর্যন্ত সবকিছু এক। অথচ ঋণ দেওয়া হয়েছে এই সমস্ত কিছু খতিয়ে না দেখেই।

এই কেপিএমজি অডিট রিপোর্ট থেকেই আরও কিছু বিষয় উঠে আসতে শুরু করে। অভিযোগ ওঠে, ঋণের টাকা পরে দেশের বাইরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রোমোটারদের বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রকল্পের মাধ্যমে। কেনা হয়েছে বিপুল সম্পত্তি। সেই সম্পত্তির হদিশ তেমনভাবে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। এছাড়াও শ্রীলঙ্কার একটি ক্রিকেট টিমও কেনা হয়েছে এই টাকায়। অন্য একটি মিডিয়া রিপোর্ট থেকে উঠে আসে, DHFL-কে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছিল ৩২টি ব্যাঙ্ক। এই জালিয়াতির উৎসস্থল যে কতটা গভীরে রয়েছে, এই ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তারপরেই একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে নড়েচড়ে বসে ভারতের শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।

কীভাবে সরানো হয়েছিল এই টাকা?
DHFL কোম্পানির অ্যাকাউন্ট বুক থেকে উঠে আসে, একই নাম এবং ইমেল আইডি-যুক্ত ৬৬টি কোম্পানিকে ২৯,১০০ কোটি টাকার ঋণ প্রদান করেছিল এই সংস্থাটি। অন্যদিকে, আরও ৬৫টি কোম্পানিকে ২৪,৫৯৫ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছিল বলেও একটি মিডিয়া রিপোর্টে অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও প্রোজেক্ট ফিন্যান্স এবং অন্য কিছু ঋণ বাবদ ১৪,০০০ কোটি টাকা খরচ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে, কিন্তু তাদের খাতায় এই ঋণ নোট করা হয়েছিল রিটেল লোন হিসাবেই।

কীভাবে জড়িত রানা কাপুর?
ইয়েস ব্যাঙ্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রানা কাপুরের সঙ্গে এই ঋণ প্রদান মর্মে যোগসাজশের পরিকল্পনা নিয়েছিল ওয়াধওয়ান ভাইয়েরা। একাধিক অবৈধ লেনদেন এবং অর্থ-তছরূপের অভিযোগে ধীরাজ এবং কপিলকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সিবিআই এবং ইডি। এই একই মামলায় গ্রেপ্তার হন রানা কাপুর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেবার জন্য রানা কাপুর অবৈধভাবে কপিল এবং ধীরাজকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে রানা কাপুর মুম্বইয়ের তালোজা জেলে বন্দি রয়েছেন।

বান্দ্রা বুকস এবং OLPL
সিবিআই এই মামলার তদন্তভার গ্রহণ করার পরে এই সম্পূর্ণ জালিয়াতি মামলায় আরও একটি ডেটাবেস সামনে আসে। এই বিশেষ ডেটাবেসের নাম দেওয়া হয়েছিল বান্দ্রা বুকস। পরবর্তীতে, অন্যান্য বড় প্রজেক্টর ঋণ (OLPL - Other Large Project Loans) এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় বান্দ্রা বুকসকে।

ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অভিযোগ জানিয়েছিল, "OLPL ক্যাটেগরিকে পুরনো ১৪,০৯৫ কোটি টাকার একটি রিটেল লোন পোর্টফোলিওর মাধ্যমে অনেকটাই স্ফীত করে দিয়েছিলেন DHFL সংস্থার কর্মকর্তারা। এর মধ্যে প্রায় ১১,০০০ কোটি টাকা টান্সফার করে দেওয়া হয়েছিল OLPL ঋণের খাতায় এবং বাকির মধ্যে ৩,০১৮ কোটি টাকা রিটেল পোর্টফোলিওর একটি অসুরক্ষিত রিটেল লোন হিসেবে দেখানো হয়।"

দাবি করা হয়, DHFL কোম্পানির কর্ণধার এবং আধিকারিকদের ওপর হাউসিং লোন, প্রোজেক্ট লোন, কোম্পানিতে প্রোমোটারদের অংশীদারিত্ব এবং বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ নিয়ে কোম্পানির ওপরে অতিরিক্ত চাপ প্রদান করা হচ্ছে। এই অভিযোগের পাল্টা ব্যাঙ্ক অভিযোগ জানায়, কপিল ওয়াধওয়ান জানিয়েছেন, DHFL কোম্পানির কাছে মাত্র ছয় মাসের জন্য ক্যাশ লিকুইডিটি রয়েছে এবং প্রত্যেকটির রি-পেমেন্ট দায়িত্বের ওপরে বিচার করার পরেই কিন্তু ক্যাশ সারপ্লাস থাকবে। তার সঙ্গেই DHFL কোম্পানিটি ২০১৯ সালের মে মাসে লোন কন্ডিশনের ওপর ইন্টারেস্ট পেমেন্ট করতে দেরি করেছিল এবং তারপরেই ব্যাংকের তরফ থেকে এই অ্যাকাউন্টকে NPA অ্যাকাউন্ট হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

আরও দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছে নাম
গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও কিন্তু কপিল এবং ধীরাজের বিরুদ্ধে তদন্ত থামানো হয়নি। তদন্ত চলাকালীন সময়ে একের পর এক কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে আসছে কেউটে সাপ। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায় কোটি কোটি টাকা দুর্নীতিতে নাম জড়িয়েছে দুই DHFL প্রোমোটার কপিল এবং ধীরাজের। ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে হাজার হাজার কোটি টাকার গৃহঋণ দেখিয়ে ভরতুকি-বাবদ কেন্দ্রের কাছ থেকে তাঁরা প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা দুর্নীতিতে তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করেছে সিবিআই।

অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং নিম্ন ও মাঝারি আয়ের মানুষের জন্য পাকা বাড়ি করে দেওয়ার জন্য ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্পে প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল দুর্নীতি। সিবিআই তদন্ত প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার এই সমস্ত দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করতে থাকে একের পর এক। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ফ্ল্যাট এবং বাড়ি কেনার জন্য ঋণ প্রদান করার ব্যবসা রয়েছে DHFL সংস্থার। ব্যবসার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই কোটি কোটি টাকা সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে হাতিয়েছিল এই সংস্থা। সরকারি খাতায় দেখা গিয়েছিল, সরকারি প্রকল্পের আওতায় বহু মানুষ তাদের কাছ থেকে মোট ১৪ হাজার কোটি টাকার গৃহঋণ নিয়েছেন, সেই বাবদ প্রায় ১,৮৮০ কোটি টাকা ভরতুকি তাদের প্রাপ্য। এই মামলায় ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়েছেন ধীরাজ এবং কপিল। তাঁরা দু'জনে এই মুহূর্তে জেলে রয়েছেন। তবে তাঁদের দুর্নীতির জট এখনও খুলছে।

ছাপিয়ে গেছে আগের সমস্ত রেকর্ড
DHFL কোম্পানির এই মামলাটি এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ের নথিভুক্ত সবথেকে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতি। গত বছরের ABG শিপ ইয়ার্ডে জালিয়াতিতে ২২,৮৪২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল। সেই মামলার তদন্ত ইতিমধ্যেই শুরু করেছে সিবিআই। আধিকারিকরা জানিয়েছেন, সিবিআই এই মামলার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে।

এছাড়াও এর আগে বিজয় মালিয়া, মেহুল চোকসি, নীরব মোদি এবং ললিত মোদির মতো বিলিওনিয়াররা ভারতের একাধিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে কোটি কোটি টাকার জালিয়াতি করেছেন। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক এবং আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের সঙ্গে ২২,৮০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছিল ABG শিপইয়ার্ড মামলায়। অন্যদিকে, হিরে ব্যবসায়ী নীরব মোদি এবং তার কাকা মেহুল চোকসি-র জালিয়াতি মামলায় ক্ষতি হয়েছিল ১৪,০০০ কোটি টাকা। লিকার ব্যারন বিজয় মালিয়ার ঋণখেলাপি মামলাতেও ৯,৯০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু এই সমস্ত মামলাকেই ছাপিয়ে গিয়েছে DHFL-এর মামলাটি।

More Articles