সদগুরু থেকে রামদেব: ভেকধারী 'বাবা'দের যেভাবে কাজে লাগায় বিজেপি

Ramdev and BJP: হরিয়ানার একটি বনভূমির অবৈধভাবে দখল নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রামদেব বাবার সংস্থা 'পতঞ্জলি'-র বিরুদ্ধে। তথ্য বলছে, হরিয়ানার ফরিদাবাদের আরাবল্লি অঞ্চলে ৪০০ একরের জমিতে বেনামী মালিকানা রয়েছে 'পতঞ্জলি'র।

দিন কয়েক আগেই রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলিকে বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন ছড়ানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে চোখ বন্ধ করে রাখার অভিযোগও এনেছে সর্বোচ্চ আদালত। শুধু তো রামদেব নন, সদগুরু থেকে শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর— বিজেপি ঘনিষ্ঠ নব্যসাধুদের এই তালিকা দীর্ঘ। তাঁদের বিরুদ্ধে কম অভিযোগ নেই। আর সেই অভিযোগের স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণও হাতের কাছেই মজুত। কিন্তু অভিযোগের পাহাড় জমলেও কেন কোনও পদক্ষেপ করে না কেন্দ্র? কেন বাড়তি সুবিধা পান এই বাবারা? কাদের ছত্রছায়ায় চলে এই যথেচ্ছাচার?

গত নভেম্বরেই রামদেবের সংস্থা‘পতঞ্জলি প্রাইভেট লিমিটেড’-কে ওষুধ সম্পর্কিত ‘বিভ্রান্তিকর’ বিজ্ঞাপনগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। অন্যথায় কড়া জরিমানার কথাও বলা হয়। তবে আদালতের নির্দেশ কানেও তোলেনি পতঞ্জলি। সেই সব বিভ্রান্তিকর এদিকে সরকারের তরফেও এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে আদালত। বিচারপতি হিমা কোহলি এবং বিচারপতি আহসানুদ্দিন আমানুল্লার বেঞ্চ প্রশ্ন করেছিলেন- সংস্থার কোন পদে রয়েছেন রামদেব? তার উত্তরে পতঞ্জলির তরফের আইনজীবী বিপিন সংঘি জানান, কোনও পদেই নেই রামদেব, তিনি শুধুমাত্র একজন ‘যোগগুরু’। অনেকেই মনে করেছে, সুপ্রিম কোর্টের নোটিস জারির পরেই রামদেব হয়ে যান শুধুমাত্র ‘যোগগুরু’। অথচ গত নভেম্বরে আদালতের নির্দেশের পরে পতঞ্জলির তরফে রামদেব খোদ জানিয়েছিলেন, তারা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের প্রচার করছে না।

আরও পড়ুন: আসল নাম রামকিষাণ যাদব! কীভাবে কোটি কোটি টাকার পতঞ্জলির ব্যবসা গড়লেন রামদেব?

২০২০ সালে ‘করোনিল কিট’ এনেছিল পতঞ্জলি। কোভিড প্রতিরোধে এই কিট সক্ষম বলে দাবি করা হয়েছিল সংস্থার তরফে। স্বাভাবিক ভাবেই সেই দাবি পূরণে অক্ষম হয় পতঞ্জলি। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ) অভিযোগ করে, এই করনিল কিট বিক্রি করেই প্রায় ২৫০ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করেছে সংস্থা। আইএমএ কোভিড ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ভুয়ো তথ্য প্রচার বন্ধ করার জন্য মোদিকে চিঠি দিলেও সে ব্যাপারে কোন কড়া পদক্ষেপ নেয়নি কেন্দ্র সরকার। উত্তরাখণ্ডের তেলিওয়ালা গ্রামে দলিতদের জমি ছিনিয়ে নিয়ে - পতঞ্জলির গোয়াল ও ভেষজ খামার গড়ে তোলারও অভিযোগ রয়েছে। ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, ২০১৫ সালে বাজারজাত পতঞ্জলি নুডলসের লাইসেন্স নেই। দেখা গিয়েছে, পতঞ্জলির অন্তত ২১টি পণ্যের বিজ্ঞাপনই ভুয়ো। পতঞ্জলির ওষুধ নাকি ক্যান্সারও নিরাময় করেছে এমন একের পর এক অলীক দাবি করে গিয়েছে সংস্থাটি। বিজ্ঞাপন, ওষুধ, অবৈধ জমি-সহ নানাবিধ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কিন্তু স্বমহিমায় টিকে রয়েছে পতঞ্জলি সংস্থা।

India's influential Saints and Babas like Ramdev, Sadguru & Sri Sri Ravishankar and their relation with BJP Govt and PM Modi

হরিয়ানার একটি বনভূমির অবৈধভাবে দখল নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রামদেব বাবার সংস্থা 'পতঞ্জলি'-র বিরুদ্ধে। 'বিজনেস স্ট্যান্ডডার্সের' একটি প্রতিবেদনে সামনে এসেছে এই তথ্য। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, হরিয়ানার ফরিদাবাদের আরাবল্লি অঞ্চলে ৪০০ একরের জমিতে বেনামী মালিকানা রয়েছে 'পতঞ্জলি'র। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, আরাবল্লির পার্বত্য অঞ্চলের অধীনে এই জমিতে কৃষিকাজ বা আর্থিক আয়ের কোনও যোগসূত্র স্থাপন করা যাবে না। শীর্ষ আদালত জানায়, এই জমি সাধারণের। ফলে তার উপরে ব্যক্তিগত মালিকানা চলবে না। তার কয়েক বছর পরেই গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন, এই সরকারি জমিগুলি ফের বেআইনিভাবে কেনাবেচা করা হচ্ছে। মামলা আদালতে উঠলে, এই ঘটনার নেপথ্যে চার ব্যবসায়িক সংস্থার নাম সামনে আসে। আদালতে তারা জানায়, এই জমির মালিকানা রয়েছে তাদের কাছেই। এই চার ব্যবসায়ীদের কাগজ-পত্র ঘেঁটে দেখা যায় - এই সংস্থাগুলির মালিকেরা আসলে পতঞ্জলি গোষ্ঠীর জন্য কাজ করে। বিভিন্ন কৌশলে গ্রামবাসীদের থেকে জমি কিনছিলেন তারাই, এবং গোটাটাই করা হয়েছে পতঞ্জলি গ্রুপের হয়ে ।

২০১৪-র লোকসভা ভোটে সরাসরি বিজেপির হয়ে প্রচার করে ছিলেন রামদেব। ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামের একটি অনুষ্ঠানে রামদেব বলেছিলেন, বিদেশে থেকে লুকিয়ে রাখা কালো টাকা ফিরিয়ে আনার শর্তেই মোদিকে সমর্থন জানাচ্ছেন তিনি। গুজরাতে ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’ মূর্তি স্থাপনের প্রচারপর্বেও মোদিকে সাহায্য করেছিলেন রামদেব। আবার ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এক অনুষ্ঠানে রামদেব তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন দুর্নীতি বিরোধী প্রচারে ব্যস্ত থাকায় তিনি নাকি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হরিদ্বারের 'পতঞ্জলি'-তে যেতেই পারেননি। আয়োজকদের মতে, এই অনুষ্ঠান ৬০০টিরও বেশি স্থানে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। রামদেবের ‘ভারত স্বাভিমান সংস্থায়’ দেশের ৬,৩৮,৭৬৫টিরও বেশি গ্রামে যোগ শিক্ষকদের ভক্তেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাহলে কি রামদেবের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার যে অব্যর্থ দাওয়াই, তাকে ধরে রাখতেই সব অন্যায় দেখেও চোখ বুজে থাকে সরকার?

সদগুরু (জাগ্গি বাসুদেব)

নিউজলন্ড্রির একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইক্কারাই বোলুভামপট্টি নামে তামিলনাড়ুর একটি আদিবাসী অঞ্চলে অবৈধ ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বাসুদেবের ইশা যোগা ক্যাম্পাসটি। ২০২১ সালে দেখা যায়, কোয়েম্বত্তূরের জঙ্গল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে মানুষ এবং পশুর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও গত ১৫-২০ বছরের নিরিখে অনেকটাই বেড়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তার প্রাথমিক কারণ, হাতি বসবাসের এবং চলাফেরার জায়গাজুড়ে অবৈধ নির্মাণ। আর এই ঘটনায় প্রথমেই আসবে ঈশা ফাউন্ডেশনের নাম। সংস্থাটি ১৫০ একরের এই ক্যাম্পাসে, ১১২ ফুটের আদিযোগী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। মূর্তিটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার কয়েক সপ্তাহ আগেই কিন্তু নগর ও রাষ্ট্র পরিকল্পনা (টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানি ) বিভাগের তৎকালীন ডেপুটি ডিরেক্টর আর সেলভারাজ জানান, মূর্তিটি বিভাগীয় অনুমোদন ছাড়াই স্থাপন করা হয়েছিল। প্রশ্ন ওঠে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচানো, জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কি কোনও ভূমিকা নেই?

ইশা ফাউন্ডেশানের থেকে এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল নিউজলন্ড্রি। তার উত্তরে নাকি ইশা সংস্থার কাছ থেকে মিলেছিল ইমেলে সতর্কবার্তা। কেন এই সতর্কবার্তা? শুধুমাত্র প্রশ্ন করার জন্য় কোনও একটি সংবাদমাধ্যমকে সতর্ক করার মতো ক্ষমতা একটি বেসরকারি সংস্থা পেল কীভাবে?

একবার মুসলিম এক ছাত্রকে 'তালিবানি' বলার অভিযোগ উঠেছিল সদগুরুর বিরুদ্ধে। সেই সদগুরু, যিনি কিনা সাম্প্রতিক অতীতে সিএএ আইন সমর্থন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর থেকে প্রশংসা অর্জন করেছেন তিনি। এই বাবা এতটাই নরম স্বভাব ও শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ যে, গলা ফাটিয়ে প্রশ্ন করা 'গোদি' মিডিয়ার পরিচালকরাও তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় নরম গলায় কথা বলেন। তবে একটি পক্ষের দাবি, তাঁর এই মানবতাবাদী রূপের নেপথ্যে আসলে গভীর ভাবে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি কাজ করে। যা আদতে সাম্প্রদায়িকতার জিগির তোলে। তিনি যা বলেন, তার অনেকটাই 'ওশো'র কথার অন্ধ অনুকরণ।

নাভিকা কুমারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সদগুরুকে বলতে শোনা গিয়েছে, যেভাবে ধারাবাহিক ভাবে জঙ্গি হামলার সম্মুখীন হয়েছে এবং হয়ে চলেছে কাশ্মীর এবং হয়ে চলেছে, তার সঙ্গে লড়ার জন্য প্রথমেই 'অভ্যন্তরীণ শত্রু'দের একশো শতাংশ প্রতিহত করতে হবে। জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে তাঁর আধ্যাত্মিক সমাধান, পাথর ছোঁড়া কাশ্মীরি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, উমর খালিদ এবং কানহাইয়া কুমারদের বিরুদ্ধে নাকি 'গণতান্ত্রিক বিচারের বাইরে' কোনও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন । এরা সকলেই কিন্তু ভারতবর্ষের নাগরিক, তবুও প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে - 'হিংসাত্মক' , 'গণতান্ত্রিক বিচারের বাইরে' তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার কথা।

India's influential Saints and Babas like Ramdev, Sadguru & Sri Sri Ravishankar and their relation with BJP Govt and PM Modi

এনএলএসআর ইউনিভার্সিটিতে ইশা ফাউন্ডেশান 'ইয়ুথ অ্যান্ড ট্রথ ' শিরোনামে একটি সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে দেখা যায় সদগুরু মহিলাদের মন্দিরে ঢুকতে না দেওয়ার সংস্কারকে সমর্থন করেন। তাঁর যুক্তি ছিল দুর্বল স্ত্রীলিঙ্গকে 'কালো-জাদু' প্রভাবিত করতে পারে।আত্মরক্ষার স্বার্থেই মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশাধিকারে বিধিনিষেধ থাকা প্রয়োজন ছিল। এই অনুষ্ঠানের ইউটিউব ভিডিওতে যাঁরা সদগুরুর নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল 'আরবান নকশাল', ‘দেশদ্রোহী’ -র তকমায়। তবে এ ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে নতুন কোনও ব্যাপার নয়। শাসকের নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদ্বজন, যে কারওর প্রশ্নের ফলাফলই যে ঠিক তেমনটাই, এ কথা তো অজানিত নয় কারওরই। দেখা গিয়েছে, গত দশ বছর ধরে সদগুরুর প্রায় সিংহভাগ বক্তব্যই বর্তমান সরকারের নীতি সমর্থিত। শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুখ খোলা ব্যক্তিদের নিয়েও সমালোচনা করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দেখা যায় তাঁকে।

একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে, বিজেপি আইটি সেল আর সদগুরুর কাজের ধরন আসলে এক। পার্থক্য এটুকুই যে সদগুরু একটু ধীর-স্থির গম্ভীর মেজাজে কথা বলেন আর বাকিরা সেই শুধুই বলেন। আসলে শান্তি ও ভালোবাসারা ছদ্মবেশে হিন্দুত্ববাদ প্রচার চলে দু-তরফেই।


শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর

২০১৭ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গুরু মন্তব্য করে বসলেন, 'সমকামিতা একটি প্রবণতা'। রামমন্দির বিতর্কের সময়ে বলেন, মুসলিমরা অযোধ্যার দাবি ছেড়ে দিলেই রামমন্দির বিতর্কের সহজভাবে মীমাংসা হবে। অযোধ্যা নাকি মুসলিমদের জন্য বিশ্বাসের স্থান নয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রকে 'বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার' বলেও একবার দাবি করেছিলেন তিনি। রবিশঙ্কর আরও বলেন, রামমন্দির বিতর্কে আদালতের সিদ্ধান্ত যদি ‘হিন্দুদের পক্ষে না হয়’ , তাহলে ভারতে নাকি 'সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি' তৈরি হবে। তাঁর এই মন্তব্যের পর তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরই দেখা যায়, শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর ‘দ্য ওয়্যার’- এর একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি শুধু বলেছি যে সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি ভারতে কখনওই হওয়া উচিত নয়। এটা তো শুধু প্রার্থনা, এতে দোষের কী আছে?’— কেনই বা একজন ধর্মগুরুর মনে হবে, হিন্দুদের পক্ষে সিদ্ধান্ত না হলে ভারতে সিরিয়ার মত পরিস্থিতি হবে? তা স্পষ্ট হওয়ার আগেই অবশ্য এই গুরুর ভক্তেরা সাক্ষাৎকারটি বন্ধ করে দেওয়ার নিদান দিয়েছিল৷

দক্ষিণ ভারতের বৃহত্তম মন্দির – ‘বৃহদিশ্বর মন্দির’। ২০১৮ সালে এই মন্দির চত্ত্বরে রবিশঙ্কর তার ‘আর্ট অফ লিভিং’ ফাউন্ডেশনের তরফে একটি ধ্যান শিবিরের আয়োজন করেছিলেন। এমন এক সময়ে এই ধ্যান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল যখন সেই জেলাটি (তাঞ্জাভুর) ঘূর্ণিঝড় 'গাজা'য় ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এই ঝড়ে হাওয়ার দাপট ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটারের বেশি, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা সব তছনছ হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। এক সপ্তাহে, ঘূর্ণিঝড়রের তাণ্ডবে অন্তত ৬৩ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং ৪ লক্ষেরও বেশি মানুষকে মাথার উপর ছাদ খুঁজে নিতে হয়েছিল ত্রাণশিবিরে।

তাঞ্জাভুর কৃষিপ্রধান অঞ্চল। ২০১৭ সালে সেই অঞ্চলের কৃষকেরা বিদ্রোহ করে বসেন। আত্মঘাতী কৃষকদের মাথার খুলি গলায় পরে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। একমাসেরও বেশি সময় ধরে দিল্লির যন্তরমন্তরে অবস্থানবিক্ষোভ চলে। তারপরই ২০১৮ - র ১৬ নভেম্বর, ‘গাজা’ ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে আরও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন তাঁরা। এমন এক অসহায় সময়ে মন্দির চত্ত্বরে এই উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছিল। গুরু রবিশঙ্কর কিন্তু ফিরেও তাকাননি এসব গরিব কৃষকদের দিকে।

অথচ চোল আমলে নির্মিত ওই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটি একসময়ে পরিচিত ছিল ‘জনগণের মন্দির’ হিসেবে। দুর্যোগের দিনগুলিতে শস্য সংরক্ষণ এবং মানুষের আশ্রয়ের জন্য মন্দিরটি খুলে দেওয়া হত। স্থানীয়দের মতে, অতীতের ঐতিহ্য মেনেই সেসময় মন্দিরটিকে ‘গাজা’ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য ত্রানকেন্দ্র এবং শিবিরে পরিণত করা উচিত ছিল। কিন্তু, তেমনটা হয়নি। বরং সেই সময় আয়োজক বা সরকার, কেউই ঘূর্ণিঝড়-বিধ্বস্ত সাধারণ জনগণের প্রতি সহানুভূতি দেখাননি।

India's influential Saints and Babas like Ramdev, Sadguru & Sri Sri Ravishankar and their relation with BJP Govt and PM Modi

২০১৬ সালে, আর্ট অফ লিভিং ফাউন্ডেশন দিল্লির যমুনা নদীর তীরে একটি ' ওয়ার্ল্ড কালচারাল ফেস্টিভাল' আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের পর বাস্তুতন্ত্রের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে অভিযোগ। পরিবেশ দূষণের জন্য ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ৫ কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করেছিল। সংস্থাটি যদি পরিবেশ, প্রকৃতি, মানবতার প্রতি সহানুভূতিশীল হত , তাহলে এই টাকাটা ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদেরই কাজে লাগতে পারত।

শ্রীনগরে, শের-ই-কাশ্মীর ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে (এসকেআইসিসি) রবি শঙ্করের একটি অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ অভিযোগ করেন , তারা জানতেন না অনুষ্ঠানে রবিশঙ্কর বক্তৃতা দেবেন। তাঁদের নাকি বিভিন্ন ভ্রান্ত কারণ দেখিয়ে সেখানে উপস্থিত করানো হয়। সেদিন দর্শকদের মধ্যে থেকে ‘আজাদি’ স্লোগানও উঠেছিল। তবে, রবিশঙ্কর তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে ভাগ করে নেওয়া ভিডিওতে দাবি করেন— অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে স্থানীয়রাই। কয়েকজন দর্শক সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছিলেন, তাদেরকে খুব ভোরে সেখানে ডেকে আনা হয়। বলা হয়, তাঁদের চাকরি দেওয়া হবে। এমনকী কয়েকটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিও এখানে প্রশিক্ষণ দিতে আসবে বলে জানানো হয়েছিল তাঁদের।

স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যম কর্মী ন্যাশনাল হেরাল্ড-কে জানিয়েছিলেন, অনেকেই মনে করেছেন, কাশ্মীরের জনগণকে প্রতারিত করতেই দিল্লির নতুন কোনও ষড়যন্ত্র ছিল এই অনুষ্ঠান। রবিশঙ্কর প্রধানমন্ত্রী মোদির ঘনিষ্ঠ, যিনি কাশ্মীরিদের সুনজরে দেখেন না। আর সেটাও স্থানীয়দের ক্ষোভের একটা বড় কারণ ছিল।

আরও পড়ুন: ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেন রামদেব! বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করল সুপ্রিম কোর্ট

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর, সাংবাদিকদের মধ্যে একজন রবিশঙ্করের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন- তিনি দিল্লি এবং কাশ্মীর সম্পর্কের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবেন কিনা? রবিশঙ্করও ধর্মগুরু সুলভ শান্তভাব নিয়ে বলেছিলেন, ‘সুখ ও শান্তি আনতে যেখানেই আমার প্রয়োজন, আমি সর্বদা সেখানে আছি’। বিশেষজ্ঞদের মতে, রবিশঙ্করের এই কথায় গেরুয়া শিবিরের সাথে তাঁর জোট সম্পর্কের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।

এই সমস্ত গুরুদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। হাত মিলিয়ে চলতে গিয়েই কি, সরকার পক্ষ এইসব 'বাবা'দের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে কোনও কড়া পদক্ষেপ করে না। ভণ্ড বাবাদের বৈধতা দিয়ে আরো বৃহৎত্তর দর্শকের কাছে পৌঁছে যাওয়াই কি কৌশল গেরুয়া শিবিরের! ক্ষমতা, সুযোগ - সুবিধা, প্রতিপত্তি আদায়ের লালসায়, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকেই কি প্রশ্নের মুখে ফেলছে না এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠী? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

More Articles