১% ধনীর হাতেই কুক্ষিগত ভারতের সমস্ত সম্পদ! যে ভয়াবহ অসাম্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ
Economy of India: সম্প্রতি সামনে এসেছে ওয়ার্ল্ড ইনইকুইটি ল্যাবের তেমনই একটি রিপোর্ট। জানা গিয়েছে, গত ছ'দশকে এ দেশে ধনীদের আয় বেড়েছে বিপুল। অথচ তাঁদের সংখ্যা এ দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশের আশপাশে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভারত। যেখানে আজও গ্লোবাল সামিট বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিদেশ থেকে অতিথিরা এলে রাতারাতি পাঁচিল তুলে ঢেকে ফেলতে হয় আশপাশের সমস্ত গরিবির চিহ্ন। আজও বিদেশ থেকে বহু চিত্রগ্রাহকই ভারতে আসেন এ দেশের দারিদ্রের ছবি তুলতে। ভোটের আগেই দেশের প্রধানমন্ত্রী রেশন প্রকল্প ঘোষণা করে বিপুল বাহবা পান। আবার সেই প্রধানমন্ত্রীই সংবাদমাধ্যমের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে দাবি করে বসেন, যে তাঁর জমানায় ২৫ কোটি দেশবাসী বেরিয়ে এসেছেন দারিদ্রসীমা থেকে। ক্রমাগত যেন এমনই এক স্ববিরোধী জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে দেশ। গত ছ'দশকে এ দেশে ধনীদের আয় বেড়েছে বিপুল। অথচ তাঁদের সংখ্যা এ দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশের আশপাশে।
সম্প্রতি সামনে এসেছে ওয়ার্ল্ড ইনইকুইটি ল্যাবের তেমনই একটি রিপোর্ট। যা কার্যত চমকে দেওয়ার মতোই। কিছুদিন আগেই বিজেপি জমানার ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পকে বেআইনি ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। যে বন্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঢুকেছে রাজনৈতিক দলগুলির কোষাগারে। সেই নিয়ে তোলপাড় গোটা দেশ। ইতিমধ্যেই সেই সংক্রান্ত নথি ও তথ্য সামনে এনেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এই এত এত কোটি টাকার উৎস সম্পর্কে। এরই মধ্যে সামনে এল ওয়ার্ল্ড ইনইকুইটি ল্যাবের সেই রিপোর্ট। জানা গিয়েছে, গোটা দেশের সমস্ত সম্পত্তির অধিকাংশটাই ভারতের জনসংখ্যার এক শতাংশ ধনীব্যক্তিদের কুক্ষিগত। গত ৬ দশকের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। যাদের আয়বৃদ্ধির পরিমাণ আমেরিকা, ব্রাজিলের ধনীতমদের থেকেও বেশ বেশি বলে জানাচ্ছে ওই রিপোর্ট।
আরও পড়ুন: নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করেও রেহাই! ১০০০ কোটির বন্ড কিনেছে কোন কোন ওষুধ কোম্পানি?
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হয় দেশ। তবে তখনও বাজার ঠিক এতটা উন্মুক্ত ছিল না। ১৯৯২ থেকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে যায় ভারতীয় বাজার। ক্রমে দেশে বাড়তে থাকে লাখপতি, কোটিপতিদের সংখ্যা। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বর্তমান সময়ের এই যে অসাম্য, তা আদতে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের থেকেও ভয়ঙ্কর। ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী, দেশের মোট সম্পদের অন্তত ৪০.১ শতাংশই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে ধনী নাগরিকদের হাতে। আর এই অঙ্কটা কার্যত ১৯৬১ সালের পর থেকে এ সময়টায় সবচেয়ে বেশি। তাঁদের আয় হিসেব করলে দেখা যাবে, দেশের সমগ্র আয়ের ২২ শতাংশই সেই ধনী শ্রেণির কুক্ষিগত। ১৯২২ থেকে যা সর্বোচ্চ বলে জানাচ্ছে ওই রিপোর্ট।
সামনেই লোকসভা ভোট। ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ রাজ্যেই প্রার্থীতালিকাও ঘোষণা করে ফেলেছে রাজনৈতিক দলগুলিকে। ভোটে একপ্রকার বিজেপির জয় নিশ্চিত। এমনই একটা ইঙ্গিত দিয়ে এসেছে মোদি সরকার। এদিকে নিন্দুকরা বলছেন, মোদির আগের দু-দু'টি জমানায় দেশের ধনী ও গ্রামীণ দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে বেশ অনেকটাই। কারণ এই সময়টায় ভারতের অর্থনীতি বেড়েছে অন্তত ৮.৪ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসেই এই বৃদ্ধি সবচেয়ে দ্রুত।
শাসক দলের সঙ্গে দেশের ধনকুবেরদের সম্পর্ক যথেষ্টই মধুর। আর এই ঘনিষ্ঠতা দিনে দিনে বেড়েছে বই কম নয়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে বিরোধী দল কংগ্রেস। এদিকে দেশে ক্রমশ কমছে সাধারণ মানুষের চাকরি পাওয়ার হার। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, অশিক্ষা ও আরও বেশ কিছু কারণে দেশে স্বল্প বেতনের ফাঁদেই আটকে পড়েছেন অধিকাংশ দেশবাসী। যার জেরে ভারতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোর একেবারে নীচের ৫০ শতাংশ ও মধ্যিখানের ৪০ শতাংশ নাগরিক নাকি সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন।
ফোর্বসের কোটিপতি তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ১ বিলিয়নের বেশি সম্পত্তির মালিক এমন ভারতীয় ধনীর সংখ্যা ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়েছে। ১৯৯১ সালে যে সংখ্যটা ছিল এক, তা ২০২২ সালে পৌঁছেছে ১৬২-তে। আজকের নিরিখে এশিয়ার অন্যতম দুই ধনী রিল্যায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির মালিক মুকেশ অম্বানি ও আদানি গ্রুপের মালিক গৌতম আদানি। দিন কয়েক আগেই সারা দেশ কাঁপিয়ে সারা হয়েছে মুকেশ অম্বানির ছোট ছেলের প্রাক-বিবাহের অনুষ্ঠানে। যাতে ব্যায় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অন্যদিকে, আদানি-বিতর্ককে কেন্দ্র করে তোলপাড় জাতীয় রাজনীতি। আর এই দুই শিল্পপতি তথা ধনকুবেরই কিন্তু বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি সরকারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ।
আরও পড়ুন:ইলেক্টোরাল বন্ডে সবচেয়ে বেশি টাকা অনুদান! কে এই লক্ষ্মী মিত্তল?
ভারতের জনসংখ্যা ইতিমধ্যেই ছাপিয়ে গিয়েছে চিনকে। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে অর্থনৈতিক সাম্য কার্যত একটা হাস্যকর ব্যাপার। ইউটোপিয়া বললেও বোধহয় খুব একটা ভুল হয় না। যেখানে এক শ্রেণির হাতে প্রয়োজনের চেয়ে রয়েছে অনেক বেশি বেশি টাকা। আর তাদেরই ছত্রছায়ায় শাখায়-প্রশাখায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে রাজনৈতিক দলগুলি। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার দেওয়া নথি অনুযায়ী, ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প থেকে অন্তত ৪৮ শতাংশ অর্থই নিজেদের কোষাগারে পুরেছে বিজেপি। যা কয়েকশো কোটি টাকার কম নয় মোটেই। হবে না-ই বা কেন! রিপোর্ট বলছে, দেশের ৯২ মিলিয়ন নাগরিকের মধ্যে মাত্র দশ হাজার জন ধনী। আর তাঁরা গড়ে প্রায় ২২.৬ বিলিয়ন সম্পদের মালিক। যা নাকি দেশের গড় সম্পদের প্রায় ১৬,৭৬৩ গুণ। দেশের ৫৪ শতাংশ সম্পদের মালিকানাই রয়েছে ভারতের ওই এক শতাংশ ধনকুবেরদের হাতে। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আসলে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান দেওয়ার তালিকায় রয়েছেন এঁরাই। এদিকে দেশের নাগরিকদের পকেটে আদত ধূ ধূ মাঠ। সে জন্যই ভোটের আগে আগে রেশন প্রকল্প ঘোষণা করে ব্যালটবাক্স নিশ্চিত করতে হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। কারণ ব্যালটবাক্সে সেই সংখ্যাগুরু জনসংখ্যারই প্রাধান্য। যারা আসলে সেই ৯৯ শতাংশ নাগরিক, যাদের হাতে সম্পদ বা বা আয়ের অঙ্ক আদতে প্রায় না-থাকারই মতো।