পানের প্রেমে পড়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধিও! আজও কলকাতার গর্ব ১০০ ছুঁইছুঁই এই দোকান

Kolpotoru Paan Shop : আইটির নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে এসেছিলেন পানের ব্যবসায়, কীভাবে কলকাতার বুকে অজেয় হয়ে উঠল ‘কল্পতরু’

এক খিলি পানের দাম কড়কড়ে হাজার টাকা! শুনেই রীতিমতো চোখ কপালে আম-আদমির! তবে শুনতে অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি, তাও আবার কলকাতার এক্কেবারে ব্যস্ত পথের ধারেই। বই পাড়ার হরদম ব্যস্ততা, নতুন কলেজ জীবনের উষ্ণতা, কফি হাউসের আড্ডা, অজস্র নতুন বইয়ের গন্ধ, কিংবা পুরনো বইয়ের ইতিহাস, এই সবকিছু যেন ঘিরে রেখেছে কলকাতার এই কলেজস্ট্রিট চত্বরকে। এখানে দক্ষিণ কলকাতার পস হাবভাব থেকে শুরু করে উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানার ঠিক পাশেই বাস এক্কেবারে গ্রাম মফস্বল থেকে আসা মধ্যবিত্ত ছেলে অথবা মেয়েটার। আর তাই ইতিহাস এখানে চিরস্থায়ী, সাবেকিয়ানাও অটুট। শতাব্দী প্রাচীন বহু ঐতিহ্য আজও বহাল এই রাস্তার দুই ধারে। আর সেই ফুটপাথেই বাস বিখ্যাত এক চিলতে একটা পানের দোকানের।

দোকানের বাইরের চেহারা দেখে অবশ্য ঠাহর করা জো নেই যে এখানকার পানের দাম হাজার টাকা! যদিও আজকাল পান খাওয়ার রেওয়াজে অনেক বদল এসেছে, তবে নিমন্ত্রণ বাড়ির শেষ পাতে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করার শখ বাঙালির আজও একই রকম আছে। এই তালিকায় এসেছে আধুনিক বিভিন্ন পানের সঙ্গে অভিনব ফায়ার পানও। তবে তার কোনওটারই দাম অবশ্য এত টাকা নয়। তাহলে কী এমন আছে এই পুরনো ধোপদুরস্ত দোকানের পানে? কেনোই বা হাজার টাকা খরচ করে একটা পান কেনে বাঙালি?

চুন খসানো অবয়ব, বাইরের দিকে দেওয়ালের পলেস্তারা উঠে গিয়েছে সেই কবেই, সারানোর কথাও কেউই ভাবে না। তার ওপরের সবুজ রঙের একটা পুরনো সাইনবোর্ডে লেখা দোকানের নাম। ‘কল্পতরু ভাণ্ডার’। বাইরে থেকে দেখলে অবশ্য এ দোকানের সঠিক পরিচয় সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায় না। হালফিলের বাহারি রং, খুশবু অথবা ঝিকিমিকি আলোর কোনও ছোঁয়াই নেই এখানে। বরং যেটা আছে তা ভীষণ রকম স্যাঁতস্যাঁতে। তবে বাইরের এই আপাত অন্ধকার পরতটা সরালেই মিলবে আলোর হদিশ, মিলবে অনেক ইতিহাসের খোঁজ। দোকানের ভিতরে দেওয়ালের দিকে তাকালেই চোখ আটকে যাবে। অজানা একটা আবেগ এসে পা চেপে ধরবে, আর অচিরেই শুরু হয়ে যাবে টাইম ট্রাভেল। সামনের দেওয়ালে টাঙানো একের পর এক বিখ্যাত সব ছবি। শুধু ছবি নয়, এ যেন আস্ত একটা সময়ের দলিল। কোনও ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়কে, কোনওটাতে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, কোনওটায় আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। কলকাতার এই এক টুকরো পানের দোকানের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন এই বিখ্যাত মানুষেরা? কী এর আসল রহস্য?

আরও পড়ুন - কালীর পায়ে ছুঁইয়ে মহড়া শুরু হতো গিরিশ ঘোষের নাটকের, কোথায় রয়েছে ‘উত্তর কলকাতার গিন্নী’?

স্বাধীনতারও দশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে জন্ম এই দোকানটির। কথিত আছে, সেই সময়ে এই দোকানের বাদশাহী পান মুখে দিয়ে কেউ পাড়ায় ঢুকলে পুরো পাড়া তার গন্ধ টের পেয়ে যেত। এদের পান খেয়ে গুনগান করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসক থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সহ অনেক নামকরা ব্যক্তিত্বরাও। এ ছাড়াও দোকানে টাঙানো থাকতো বিশিষ্ট কিছু মানুষের দেওয়া কল্পতরুর পানের সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট প্রদানকারীদের তালিকায় প্রাক্তন রাজ‍্যপাল পদ্মজা নাইডু থেকে শুরু করে পিসি সরকার (সিনিয়র) ,ইন্দিরা গান্ধী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, উত্তম কুমার, মান্না দে কে না ছিলেন!

এখানেই শেষ নয়, পানের দোকানে বিজ্ঞাপনেও ছিল অভিনবত্ব। দোকানের গায়ে এমন একটা ছবি সাঁটা থাকত, যাতে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখেই কল্পতরুর পান মুখে পুরছেন! ‘পদর্পণ করে বদন প্রসন্ন করুন’ লেখা ছাড়াও বোর্ডে টাঙানো থাকত পানের খিলির দাম সহ বিচিত্র সব নাম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বাদশাহী’, ‘মন মাতোয়ারা’, ‘মুখ বিলাস’ ইত্যাদি। এরকমই অসাধারণ কিছু বিজ্ঞাপনও ছিল দোকানটির। এক সময় কলেজ স্কোয়ারের দুর্গা ঠাকুর দেখে বেরিয়ে, ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট হলের সামনে কল্পতরুর ভান্ডার থেকে পান খাওয়া বাঙালির ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছিল। কল্পতরু ভাণ্ডারের পান থেকে শুধু কলকাতা নয়, ভিন রাজ্য থেকেও বিভিন্ন রসিক মানুষজন ছুটে আসতেন।

আজ প্রায় ৮৪ বছর ধরে একই রকম ঐতিহ্য বহাল এ দোকানে। বই পাড়ার চেনা গন্ধের সঙ্গে যেন কবেই মিলেমিশে গিয়েছে পানের মিঠা স্বাদ আর আতরের খুশবু। আর এইসবের মধ্যে দিয়েই জমে উঠেছে কল্পতরুর ব্যবসা। শুরুর সময় থেকেই কলেজ স্ট্রিটের ওই এক চিলতে দোকানেই বাস কল্পতরুর। ওখানেই বেড়ে ওঠা। ব্যবসার বর্তমান কান্ডারীর নাম শ্যামল দত্ত। বাবার রেখে যাওয়া পানের ব্যবসাকে সম্বল করেই আজীবন বেঁচেছেন তিনি। বয়ে নিয়ে এসেছেন ঐতিহ্যকে। আধুনিকতার মোড়কে যাকে বেঁধে ফেলতে চাননি কোনওদিনই। কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং পুরনো পানের দোকান এটিই।

অনেকেই শুনলে অবাক হবেন এই মানুষটি আসলে পেশায় ছিলেন একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তবে আইটির নিশ্চিন্ত চাকরিতে ছিল তাঁর চিরকালের অনীহা। আর হবে নাই বা কেন, ব্যবসা করার অকৃত্রিম স্বপ্ন আর ইতিহাস বয়ে নিয়ে যাওয়ার যে জেদ তাঁর মধ্যে লালিত হয়েছিল তার কাছে আইটির মোটা অঙ্কের মাইনের জোর যে বড়োই কম। তাই ব্যবসা করার জেদটাই জিতে গেল শেষমেশ। আসলে মধ্যবিত্ত বাঙালির এই লড়াই করার জেদটাই তো পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা! আর বাঙালি মানেই তো আবেগ প্রবণ, তাই সেই আবেগের ইতিহাস যদি ব্যবসায় মেশে তবে তার বিস্তার অবশ্যম্ভাবী।

হলও ঠিক তাই। শ্যমলবাবুর হাত ধরে ব্যবসা চলতে লাগল রমরমিয়ে। কলকাতার বুকে নিজের পরিচয় গড়ে তুললো কল্পতরু। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে পান তৈরির মশলা। সুপারি আসে মূলত উত্তর-পূর্ব রাজ্য এবং চেন্নাই থেকে। কানপুর থেকে আসে বিভিন্ন ধরনের মৌরি। এছাড়া পানের অন্যান্য মশলা আসে আসানসোল থেকে। যেন এক খিলি পান মির মিশে যায় আস্ত একটা ভারতবর্ষ।

আরও পড়ুন - পাইস হোটেলের সংস্কৃতিকে অমর করেছিলেন বিভূতিভূষণ, আজও কি রয়েছে সেই হোটেল?

সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাছাই করা মশলা আনা হয় এই দোকানে ফলে তার দামও যে সমতুল্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। এই দোকানের একটি পানের দাম ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০০১ টাকা পর্যন্ত। একটি পানের দাম ১০০১ টাকা শুনলে মনে হতেই পারে ব্যয়বহুল, কিন্তু এই দামের পিছনে আসল কারণটি হল পানের জন্য ব্যবহৃত ব্যয়বহুল মশলা। এই মশলাগুলি বিশেষ পাত্রে সংরক্ষণ করতে হয়। পানে ব্যবহৃত সিলভার ফয়েলটির ব্যয়ও কিছু কম নয়। যদিও এই দামের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য এখনও কিছু শৌখিন মানুষ রয়েছেন কলকাতায়, যারা দামি পানের জন্য টাকা খরচ করতে আপত্তি করেন না। ইতিহাসের কেনা এবং চেখে দেখার জন্য ১০০০ তাকাক্টাদের কাছে মামুলি ব্যাপার!

সে সময়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায়ই অভিনয়ের শো পড়ত এদিকে। দোকানে তখন বসতেন শ্যামলবাবুর বাবা। এ দোকানের এক খিলি পান ছাড়া চলতেই না রসিক ভানুর। কেবল একাই যে পান খেতেন এমন নয়, মাঝে মাঝেই নিজের স্ত্রীকেও ঠোঁট রাঙাতে নিয়ে আসতেন এই দোকানে। আসলে শ্যামল দত্তের বাবা এবং ভানু বন্দোপাধ্যায় দুজনেই ছিলেন বাংলাদেশের বাসিন্দা, ফলে তাঁদের মধ্যে সম্পর্কও ছিল খুবই ভালো। দোকানে বসে পান খেতে খেতে জমিয়ে ভিটেমাটির গল্প করতেন দুজনেই। কলকাতায় তখন নামজাদা পানের দোকান বলতে এই কল্পতরু, তাছাড়া এর মশলার স্বাদও ছিল অসাধারণ। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই পানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। একবার ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরে এসে নিজে গিয়ে চেখে দেখলেন কল্পতরুর পান। স্বাদ যশে বশ মানলেই মুহূর্তেই।

যদিও আজ এই ইতিহাসটুকুই সম্বল, বাস্তবের মাটিতে সাবেকি পানের স্বাদ খানিকটা হলেও ফিকে হয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম আর আসতে চায় না এই ব্যবসায়। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে ছুটতে ছুটতে ‘কল্পতরু’ও তাই বেশ ক্লান্ত। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ শ্যামল বাবু। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন জারি থাকবে এ লড়াই। খরিদ্দার সংখ্যা কমলেও দোকান খুলবে প্রতিদিন। আর কলকাতার বুকে প্রকৃত ‘কল্পতরু’ হওয়ার যে স্বপ্ন এতো দিন বোনা হচ্ছে অচিরেই তার বয়স শতাব্দী পেরোবে নিশ্চিত।

More Articles