বিয়ের আগে যৌনতায় 'না'! কঠিন শাস্তির খাঁড়া! বিশ্বকে কী বার্তা দিতে চাইছে ইন্দোনেশিয়া

Pre-Marriage Sex law, Indonesia : বিয়ের আগে যৌনতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যে বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার নয়া আইন

যৌনতা বিষয়টা এমনিই তা নিয়ে যতোই আইন কানুন থাকুক, তার পাতায় চোখ বলে না কেউই। বরং একটা চিরাচরিত লুকোচুরি চলে এই বিষয়টা নিয়ে। বিয়ে নামক সামাজিক ট্যাবুটিই যেন সর্বেসর্বা। তার আগে কিছু করা মানেই আইন বিরুদ্ধ, আর সমাজ বিরুদ্ধ তো বটেই!

সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার একটি আইন এই বিষয়টিই পুনরায় উস্কে দিচ্ছে। দেশের রাষ্ট্রপতি, সরকারি প্রতিষ্ঠান, এবং যে কোনও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ ইত্যাদির পাশাপাশি এই আইনে আরও একটি সংযোজন হল বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা। এ সব কিছুই ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে আইনে। আইন ভাঙলেই হাতে পড়বে হাতকড়া।বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ককে ঘিরে এমনিতেই বেশ কিছু সংস্কার কাজ করে। উপরন্তু এই নয়া আইন ঘটনার উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

খসড়া প্রস্তাব ইতিমধ্যে প্রস্তুত। জানা গিয়েছে, সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১৫ ডিসেম্বর পাস হতে চলেছে নতুন এই অপরাধ আইন। শুধু তাই নয়, ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের পাশাপাশি এই আইনের আওতায় আনা হবে বিদেশি দেরও। অর্থাৎ বাইরে থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ক্ষেত্রেও একই আইন বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকার।

প্রাক বিবাহ পর্বে সহবাসে নিয়ে এই যে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পথে এগিয়েছে সরকার তার একটা বড় প্রভাব পড়তে চলেছে দেশের পর্যটন শিল্পে। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির একটা বড় অংশ আসে এই পর্যটনের উপরই ভিত্তি করে। অন্যরকম জীবনের আনন্দ নিতে সেলিব্রিটি থেকে টিনেজদের অনেকেই যেতেন ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে। এ ক্ষেত্রে এতদিন কেনো পাসপোর্ট আর ভিসা হলেই চলত। কিন্তু এখন লাগবে বৈবাহিক স্বীকৃতিও। ফলে সহবাস বা বিয়ের আগে যৌনতায় ‘দাঁড়ি’ পড়লে তার প্রভাব যে পর্যটন ব্যবসায় পড়বে, তা বলা বাহুল্য।

আরও পড়ুন : বর্ধমানের রানি বসন্তকুমারীর পরকীয়া ও প্রথম বিধবাবিবাহ ।। ফিরে দেখা নাটকীয় আখ্যান

ইন্দোনেশিয়া সরকার বিগত এক দশক ধরেই আইনবিধি নিয়ে ক্রমাগত বদল আমার পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে ২০১৯ সালেও একবার এই আইনের একটি খসড়া প্রস্তাব পাশ হওয়ার কথা ছিল। যদিও দেশব্যাপী লাগাতার প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মুখে পড়ে সাময়িকভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। দেশের কয়েকটি ইসলামিক গোষ্ঠী বাদে একটা বিরাট অংশের সাধারণ মানুষ পথে নেমেছিল এই আইনের প্রতিবাদে। কিন্তু আইন থেকে একেবারে সরে যায়নি তারা। তাই খানিক অদলবদল করে ফের সেই আইনটিই আনতে চলেছে সরকার।

বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা বাদেও আরও বেশ কিছু আইন আসতে চলেছে এর সঙ্গে। বলা হয়েছে ধর্ষণ ছাড়া অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে গর্ভপাতকে ‘অপরাধ’ হিসেবেই দেখা হবে নতুন আইনে। ‘কালো জাদু’ চর্চা নিয়েও জারি হয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির অবমাননা করলে সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে বলেও জানানো হয় নয়া আইনে।

কিন্তু এইসব কিছুর মধ্যেও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাক-বিবাহ পর্বের যৌনতা কেন্দ্রিক আইনটি। প্রতিবাদ উঠেছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকেই। মানবাধিকার কর্মীরা একে গণতন্ত্রের অবমাননা হিসেবেই দেখছেন। সমাজে নারী, এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠী, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক অজস্র আইন এবং বিধি নিষেধ ইত্যাদি থাকা সত্বেও এই আইনটি আনয়ন করা হলে তা হস্তক্ষেপ করবে সামগ্রিক স্বাধীনতায়, এমনটাই মনে করছেন প্রতিবাদীরা। যদিও এই বিষয়ের বিরোধিতা করে আইনমন্ত্রী এডওয়ার্ড ওমর শরীফ হায়ারিয়েজ জানিয়েছেন, এই আইনে কোনওরকম গণতন্ত্রের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে না উপরন্তু এই আইনটিকে ইন্দোনেশিয়ার মর্যাদা এবং মূল্যবোধের প্রতিভূ বলেই জানিয়েছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে উঠে আসছে বছর চারেক আগের একটি ঘটনা। ২০১৮ সাল। বড়সর একটা পরিবর্তন এলো ভারতীয় আইন বিধিতে। প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো একটি আইন, যা কিনা জগদ্দল পাথরের মতো গেঁড়ে বসেছিল সমাজে তাকে এক ধাক্কায় নাড়িয়ে দিল ভারতের সুপ্রিমকোর্ট। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারার অ্যাডালট্রি ল বা পরকীয়া আইন। খারিজ করল সুপ্রিমকোর্ট।

১৮৬০ সালে তৈরি হওয়া ওই আইনে বলা ছিল, কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে যদি তার স্বামীর অমতে অন্য কেউ শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, আর সেই সম্পর্ক যদি ধর্ষণ না হয়ে থাকে, তবে তা ফৌজদারি অপরাধ। এবং এই অপরাধের বিরুদ্ধে মুখ খোলার অধিকার কেবল ছিল পুরুষের। অর্থাৎ স্বামী অন্য কোনও সম্পর্কে লিপ্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রতিবাদ করতে পারতেন না স্ত্রীরা।

কী ভীষণ পুরুষতান্ত্রিক একটা নিয়ম। আর তাই কিনা জাঁকিয়ে বসেছিল টানা ১৫৮ টা বছর। ২০১৮ সালে এই আইনটিই খারিজ করার জন্য আবেদন জানান ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিদেশে বসবাসকারী জনৈক জোসেফ শাইন। তিনি দাবি করেন, অভিযোগ দায়ের বা মামলা করার সুযোগও থাকবে ওই নারীর স্বামীর হাতে থাকলে একই সুযোগের অধিকারী হতে পারেন অভিযুক্ত পুরুষটির স্ত্রীও। কিন্তু এ ঘটনা বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত নথি হতে পারে, কখনওই তা একপেশে অপরাধের ধারা হতে পারে না।

আরও পড়ুন : পরকীয়া, অবাধ যৌনতা! মেসিদের হারের নেপথ্যনায়ক হার্ভে রেনার্ডের জীবন নিয়ে তোলপাড়

প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ গঠিত হয়। সেই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি এ. এম খানবিলকর, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, আর. এফ. নারিমান ও ইন্দু মালহোত্রা। সর্বসম্মতিক্রমে বাতিলের রায় ঘোষণা করা হয় আইনটির।

বিশ্বব্যাপী যে ব্যক্তিস্বাধীনতা আন্দোলনের হাওয়া তার প্রতি সমর্থন দেখানো হয় এই আইনে। নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বিধি সম্মত নয় বলেই মনে করা হয়। আজ থেকে চার বছর আগে এই পথটি দেখেছিল ভারত, কিন্তু চিন, জাপান, ব্রাজিল, নিউ জিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, প্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, আয়ার্ল্যান্ড প্রজাতন্ত্র, বার্বাডোজ, বার্মুডা, জামাইকার মতো দেশগুলিতে অনেক আগে থেকেই পরকীয়া সংক্রান্ত আইন বহাল ছিল।

পরকীয়া আর প্রাক বিবাহ পর্বে যৌন মিলন এক নয়। কিন্তু প্রচ্ছন্ন হলেও যোগ রয়েছে এই দুয়ের। প্রাক বিবাহ পর্বের যেমন কোনও আইনি নথি থাকে না ঠিক তেমনই পরকীয়ার সম্পর্ক লিপ্ত দুজনেরও কোনো নথি থাকে না। সুতরাং একটা সমান্তরাল টানাপোড়েন রয়েছেই। ইন্দোনেশিয়ার আজকের এই আইন যে সামগ্রিক গণতন্ত্রের, ব্যক্তিগত স্বতন্ত্রের পথে কাঁটা হয়ে বিঁধল তা বলাই বাহুল্য! আর এই কাঁটার দায় বর্তাবে দেশীয় অর্থনীতিতে সবচাইতে বেশি। আইন যারা আনছেন, তারা কি ভেবে দেখেছেন এর বিকল্প কী হতে পারে?

More Articles