বড়, ছোট, অপুষ্ট! স্তনের বাছবিচারে যে বিড়ম্বনায় ভোগেন ভারতের মেয়েরা
Indu Lalitha Harikumar Illustrations: সম্প্রতি ব্রিটেনে এক জনসমীক্ষা করা হয়েছিল ৩৮৪ জন মহিলার উপর। যার মধ্যে ৪৪ শতাংশ নারীই মনে করেন, তাঁদের স্তন যদি আরও বড় হতো, কী ভালোই না হতো!
নারী স্তনের এক আস্ত গল্পগাথা! ঠিকই শুনেছেন। এই টিন্ডার টেলসের ক্রেজে আস্ত পৃথিবী টানটান তোলপাড়। সে এক ভারতীয় বাহারি স্তনের অভিনব উজ্জ্বল উপকথা। কিন্তু, "এ কথা কি জানে ইন্দু, জোছনাকে বুকে ধরে ভালোবাসে তাকে সিন্ধু, সে কথা কি জানে ইন্দু?" কী যে বলেন! ইন্দু, মানে সেই ইন্দু ললিতা হরিকুমার এটা জানবেন না তা কি হয়? তাঁর সার্থক তুলি কলমের যুগলবন্দিতেই তো দেহজ রূপে পরিপূর্ণ হয়েছে এমন অদ্বিতীয় ভারতীয় টিন্ডার টেলস।
নারী শরীরের যুগল উর্ধ্বকেন্দ্রিক স্তনের আকার বৈচিত্র্যেই আমাদের দেশিয় সমাজে আজও প্রবলভাবে রয়েছে গেছে বিচিত্র মানসিক রগরগে চেতনাবোধ। অনেকে মুখে স্বীকার না করলেও এমন সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত গূঢ় মনন ব্যাধির কথা আমরা বুক ঠুকে অস্বীকারও তো করতে পারি না। এই নারী স্তনের হরেক কিসসাই ইন্দু ললিতা হরিকুমারের শৈল্পিক প্রতিফলনে সারা বিশ্বের কাছে অভিনন্দিত হয়েছে এক অভাবনীয় ভারতীয় সাকার ভাবধারায়।
ঘরে রাখা আয়নার সামনে নিজেকে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে সত্যের মুখোমুখি হলে, প্রথমেই প্রাথমিকভাবে মনে হবে, তাজ্জব ব্যাপার তো! অপুষ্ট ছোট আকৃতির স্তন। যা অনেকাংশ মেয়েদের হীনমন্যতার পরিসরে ভরপুর। কিছু পুরুষের কাছে তাচ্ছিল্যের বিদ্রুপ উপমায় তাঁরা প্রকৃতই জেরবার। আবার সুডৌল স্তন বহু মহিলার গর্বের স্বর্গ বিচরণ। পুরুষদের গলা চিরে উঠে আসে, "তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত।" আসলে নারীরাও ভালোভাবে জানেন, এই স্তনই পুরুষের কাছে এক অঘোম আকর্ষণের ঠমকি চমকি উত্তেজক যুগল কেন্দ্রবিন্দু, যা প্রাকৃতিক প্রভাবের দিক থেকেও একেবারেই উপেক্ষার নয়। খাতায় কলমে একদিকে 'চোলি কে পিছে কা হ্যায়' মার্কা এক শ্রেণির ডেয়ার ডেভিল 'ডিজিটাল' ভারত গড়ে উঠেছে ঠিকই, তবে দেশিয় রক্ষণশীল তথাকথিত নেটিজেন সমাজের এখনও লাজবতী নূপুরের রিনিঝিনির পুরোপুরি আরষ্ঠতা গেল-গেল করেও গেল না। খানিক 'পেটে খিদে মুখে লাজ' শরমে মরমে মরি মরি অবস্থা। কিন্তু এখানেই দক্ষিণ এশিয় মহাদেশের এই তৃতীয় বিশ্ব ভারতের এক মধ্যবয়স্কা মহিলা ইন্দু ললিতা হরিকুমার এক্কেবারে ব্যতিক্রমী নির্বাচন। এসব 'শাক দিয়ে মাছ ঢাকা' অকারণ ন্যাকা আবরণের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম একদম নিজস্ব ঘরানায় সমস্যার মূল লক্ষ্যবিন্দুতে ভারতীয় ট্রিগার টিপে ধরেছেন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ পরিভাষায়।
আরও পড়ুন- দুই স্তন কেটে কলাপাতায় মুড়ে তুলে দিয়েছিলেন হাতে! দলিত নাঙ্গেলি কেন প্রতিবাদেরই ছদ্মনাম?
আদতে তিনি ছোট স্তনের অধিকারিণী বরাবরই। অকপটে একথা নিজেই স্বীকার করে তিনি বলেছেন, টিন-এজার বয়সে এক সময়ে তাঁর মনে হতো, তাঁর অপুষ্ট স্তনের কারণে তিনি হয়তো কোনও পুরুষের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নন। ভালোবাসা প্রাপ্তির লোভে বেপরোয়া ভুল সম্পর্কেও জড়িয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। এমনই স্তন সমস্যায় একদা এই অখ্যাত নারী দিশেহারা হয়ে যান। আজ তিনি অবশ্য এক অতি জনপ্রিয় বিখ্যাত ঝকঝকে তন্বী পরিপূর্ণ নারী। ফিগারও দারুণ 'লুক্রেটিভ'। এই উপেক্ষিত 'ছোট স্তন' উপমা থেকে 'তন্দুরুস্ত' অ্যাখায় আসতে তাঁকে অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। নিজের জীবনের পদে পদে উপলব্ধি করেছেন স্তনের অপরিসীম অযাচিত মান্যতার সুতীব্র অনুভুতিগুলি। আর তাই মহিলাদের এই চিরন্তনী সমস্যাই তাঁকে পথ দেখায় সমাজের উল্টো স্রোতে এক অভিনব স্রোতধারায় সাঁতার কাটতে।
বছর খানেক আগের কথা। ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে এই চিত্রশিল্পী তথা গল্প লেখিকা ইন্দু ললিতা হরিকুমার আচমকা এক মহিলার সঙ্গে পরিচিত হন। সেই পরিচয় ক্রমেই বন্ধুত্বের রসায়নে অচিরেই বদলে যায়। এমনই একদিন দু'জনের কথাবার্তাকালীন, ওই মহিলা তাঁকে জানান, তাঁর বড় আকৃতির স্তনের জন্য হামেশাই বিড়ম্বনায় পড়েন তিনি। পুরুষদের চোখ থেকে তিনি যেন কিছুতেই নিজেকে এড়াতে পারেন না। কারও ঘরে যাবেন, রাস্তায় হাঁটবেন — পুরুষরা তাঁর উদ্ধত বিশালাকার স্তনের দিকেই অর্জুনের পাখির চোখের মতো তাক করে বসেন। দুইজনের তখনকার কথাতেই যেন ভিন্ন অভিজ্ঞতার বিভিন্ন সুর এক নিবিড়তম আত্মিকতার জন্ম দিয়েছিল। তখনই তাঁরা ঠিক করে ফেলেন মেয়েদের এই নানাবিধ আকৃতির স্তন নিয়ে মেয়েদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য চাই একটা প্ল্যাটফর্ম। দুই সখী মিলে তৈরি করেছিলেন এক অভিনব মঞ্চ, 'আইডেন্টিটি'। এই অদ্ভুত 'আইডেন্টিটি' প্রকল্পের শেষ দু'টি বর্ণ কিন্তু দুটি 'টি'। যা কিনা ভীষণ রকমের স্তনগত ইঙ্গিতবাহী। এ যেন একটি ব্যাসের দুই দিকে দু'টি কামনা প্রান্তর। মাঝখানে বিস্তৃত টানা দীঘল চিহ্ন। ক্লিভেজের দ্রাঘিমায়, সার্বিক পর্যায়ে টি-এর আদলে। দু'টি টি-এর অস্তিত্ব এখানে শৈল্পিক পটভূমিতে দু'টি টি-আকারের নারী চরিত্র। তাই এই আইডেন্টিটি নামেই তাঁদের উভয়ের সহমত আজও প্রশ্নাতীত। সেই শেষ দু'টি টি তাঁদের সহযাত্রার পথ দেখিয়েছে অনিঃশেষের আগামীতে। ইন্দু ললিতা হরিকুমার নিজেই বলেছেন, "আমাদের এক বন্ধুর মাথায় প্রথম আসে দুই টি বিশিষ্ট আইডেন্টিটি নামটা।
আরও পড়ুন- পুরুষদের যৌনাঙ্গের বিরল থেকে বিরলতম রোগ! কী এই ডিফালিয়া, ট্রিফালিয়া?
এসবই প্রায় বছর সাতেক আগের ঘটনা। মুম্বই নিবাসী প্রখ্যাত তৈলচিত্রকর ইন্দু ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট করেন। এমনিতেও তিনি তখন ইনস্টাগ্রামে কর্মরত ছিলেন। সেই পোস্টের মূল বিষয় ছিল 'স্তন।' ওই পোস্টে সরাসরি ব্যক্ত করলেন, মানুষের এই সমাজে সবচেয়ে আকর্ষিত, সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে দর্শনীয়, সবচেয়ে প্রত্যাশিত অঙ্গ হল নারী দেহের জোড়া স্তন। এর কৌতূহলে আদিকাল থেকে আজও পুরুষজাতি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আর নারীরা কখনও গর্বিত বা সঙ্কুচিত, উৎকণ্ঠিত আবার কখনও বা আতঙ্কিত অথবা যন্ত্রণাক্লিষ্ট হন। একমাত্র ভারতীয় নারীরাই যেন এইসব নিজস্ব অনুভূতি নিয়ে তাঁদের যুগল স্তন সংক্রান্ত একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঘটনাবলী লিখিত আকারে তাঁকে পাঠান। সঙ্গে যেমন খুশি ছবিও পাঠাতে আবেদন জানানো হয় পোস্টে। একইসঙ্গে তিনি পোস্টে উল্লেখ করেন, ব্যক্তি পরিচয় তিনি গোপন রাখবেন। তাজ্জব বিষয় হলো, পোস্টটি ট্রোলড হতেই বহু মহিলা এই আবেদনে সাড়া দিতে আগ্রহী হন। শিল্পী ইন্দু বলেন, "আমরা স্তন নিয়ে মহিলাদের লেখার বিষয়ে অভাবনীয় সাড়া পাই।"
শিল্পীর মতে, পৃথিবীর সমস্ত নারীর তাঁর নিজস্ব স্তন সম্পর্কে আকার, অভিজ্ঞতা, অনুভূতির একটা পৃথক মনস্তর আছে, যা বিভিন্নজনের লেখাতেই চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট। সম্প্রতি ব্রিটেনে এক জনসমীক্ষা করা হয়েছিল ৩৮৪ জন মহিলার উপর। যার মধ্যে ৪৪ শতাংশ নারীই মনে করেন, তাঁদের স্তন যদি আরও বড় হতো, কী ভালোই না হতো! আর ৩১ শতাংশ নারী মনে করেছিলেন তাঁদের স্তন ছোট হলে মন্দ হতো না। বাকি ২৫ শতাংশ নারী মাঝপথের মাঝামাঝি সাইজের সরণিতে হেঁটেছেন। ইন্দু ললিতা হরিকুমার তাঁর কাছে আসা প্রান্তিক ভারতীয়দের লেখাগুলি সবিস্তারে পড়ে বলেছেন, "সামাজিক নানা কারণে লেখিকাদের পরিচয় আমরা প্রকাশ করিনি। তাছাড়া আমরা তা গোপনীয়তা রক্ষায় আজও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বুঝতেও দিইনি তাঁদের ঠিকানা কোথায় বা নাম কী কী। কিন্তু এটা ঠিক যে, লেখাগুলির ছত্রে ছত্রে রয়ে গিয়েছে, ছোট স্তনের বিড়ম্বনা ও কষ্টের বারোমাস্যা। তেমনই বড় স্তনের অহংকার থেকে কত নিষ্ঠুর আঘাতের স্বীকারোক্তির কাহিনিও আমরা পেয়েছি। ইনস্টাগ্রামের আইডেন্টিটি প্রকল্পের পোস্টে কারও কারও লেখাগুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে কত কত অদ্ভুত অজানা তথ্য। যেমন, কোনও মহিলার ব্লাউজ থেকে অন্তর্বাসের স্ট্র্যাপ অজান্তে একটু বেরিয়ে গেলেই কত না লাঞ্ছিত হতে হয়েছে এই পুরুষ শাসিত সমাজে। আবার কেউ বলেছেন, তাঁর দুরন্ত স্তনের ছবি যদি নিজস্ব বেডরুমে রাখা যেত তবে তিনি অবশ্যই গর্বিত হতেন। আবার একটু সাহস দেখিয়ে কেউ কেউদুই বক্ষের মাঝখানের দীর্ঘায়ত ক্লিভেজের ছবিও পাঠিয়েছেন।"
আরও পড়ুন- কেন ভারতীয় পুরুষরা আক্রান্ত হচ্ছেন স্তনের ক্যান্সারে? কীভাবে বাঁচাবেন নিজেকে?
শিল্পী ও লেখিকা ইন্দু বলছেন, মাত্র তিন মাসেই তিনি শতাধিক মনোগ্রাহী স্তন সম্পর্কিত গল্প পেয়েছেন। যা শুধুই হয়ে উঠেছে ভারতীয় নারী স্তনের শত উপকথা। যে গল্পগুলির সমন্বয়ে তিনি ইতিমধ্যেই একশোটি সংশ্লিষ্ট আবহের ছবিও এঁকে ফেলেছেন। যেগুলি শিল্পীমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বলা যায়, শৈল্পিক উৎকর্ষের মাপকাঠিতে সেগুলি একেবারে 'হটকেক'। ১৮ থেকে ৫০ বছরের দেশিয় মহিলারাই বেশি সাড়া দিয়েছেন। ভারতের ছোট বড় বিভিন্ন শহর থেকেই তিনি অজস্র ইমেলও পেয়েছেন। এমনকী প্রান্তিক গ্রামীণ মহিলারাও সংকোচ ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন এই রূপকথার রূপকন্যা হয়ে। একটাই ভরসায়। গোপনীয়তা রক্ষায় ইন্দু বরাবরই একলব্য। এসবের অভিনব সার্থক সমন্বয়ই ইন্দু ললিতা হরিকুমারের পরিকল্পিত ভারতীয় একশো টিন্ডার টেলসের টাটকা উপকরণ। এই টিন্ডার টেলসের নামটিও অত্যন্ত সাহসী। অন্তত ভারতীয় সমাজমনস্কতার প্রেক্ষাপটে। ইন্দু এর নাম রাখলেন 'লাভসেক্সঅ্যান্ডটেক।'
ইন্দু মুম্বইয়ের বাসিন্দা। তাঁর তুলির আঁচড়ে সৃষ্ট নানাবিধ ছবিগুলি বিভিন্ন প্রদর্শনীতে প্রশংসিত হয়েছে শিল্প বোদ্ধাদের কাছে। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা গল্পের বইও বেশ জনপ্রিয়। তবে নারীর শরীরের উত্তেজক বক্ষ বিভঙ্গের আঙ্গিকের উপর তাঁর আঁকা ছবি তাঁকে আলোচনা ও সমালোচনার দুই ভিন্ন মেরুর গভীর প্রান্তদেশের অতলে পৌঁছে দিয়েছে অনায়াস দক্ষতার নিরিখে। এর মধ্যে তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত 'লাভসেক্সঅ্যান্ডটেক' টেন্ডার টেলস তাঁকে বিশ্বের দুয়ারে এক লহমায় জায়গা করে দিয়েছে একক অভিনবত্বের পথ প্রদর্শক হিসেবে। পৃথিবীখ্যাত সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাই এবিষয়ে নির্দ্বিধায় সম্প্রচার করেছে তাঁর সাহসী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, "ভারতীয় নারী বক্ষের টগবগে টর্নেডো ঝোড়ো সুবাসে ইন্দুর স্তনের গল্প, স্তনের ছবি যেন মানস সরোবরে প্রস্ফুটিত এক বিস্মিত নীলপদ্ম। যা প্রকৃতই অনবদ্য ও অভিনব।"