ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দলকে লড়তে শিখিয়েছেন সচিন, কেন সেরার সেরা মাস্টারব্লাস্টার
Inscript Debate: কোহলি নিজে একাধিকবার বলেছেন তিনি ব্যাটসম্যান হিসেবে সচিনের সঙ্গে তুলনার যোগ্যই নন, সচিন গুরু হলে তিনি শুধুই এক সুযোগ্য শিষ্য।
সচিন যে এগিয়ে একথা প্রমাণ করতে এত এত তথ্য ও যুক্তি সার দিয়ে সামনে আসে যে এই সীমিত পরিসরে তা আলোচনা করাই একপ্রকার দুঃসাধ্য! তবু, এই বিতর্কের মঞ্চে যখন এক অসম তুলনা টানা হয়েইছে, তখন তথ্য দিয়ে, বিশ্লেষণ দিয়েই খণ্ডন করা যাক বিরাটকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের যাবতীয় প্রচেষ্টাকে। প্রথমত, টেস্ট ম্যাচের হিসেবে সচিন অনেকের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। বিরাটের থেকে তো অবশ্যই এগিয়ে। মোট রান, দেশে বিদেশে গড়, পারফরম্যান্স, সেঞ্চুরির সংখ্যা সবেতেই এগিয়ে আছেন মাস্টারব্লাস্টার।
দ্বিতীয়ত, খেলার জ্যামিতিতে যদি আসা যায়, নির্দ্বিধায় বলা যায়, সচিন টেকনিক্যালি অনেক নিপুণ ব্যাটসম্যান। পেস-স্পিন দুইয়ের বিরুদ্ধে সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। বিশ্বে অন্যতম উচ্চমানের ফাস্ট বোলার আম্ব্রোজ, ওয়ালশ, আক্রম, ওয়াকার, শোয়েব, ব্রেট লি, ম্যাকগ্রা, পোলক, ডোনাল্ড, কালিস, অ্যান্ডারসন ব্রড সবার বলে খেলেছেন সচিন। আবার একইসঙ্গে বিশ্বের সর্বকালের সেরা দুই স্পিনার ওয়ার্ন আর মুরলির বলে খেলেও চমৎকার রান করেছেন। ওয়ার্নকে খেলার দক্ষতা সচিনের সর্বজনবিদিত ছিল। সেখানে কোহলি পেসের বিরুদ্ধে স্বচ্ছন্দ হলেও সচিনের মতো ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে খেলতে হয়নি তাঁকে। অফ ফর্মের সময় অফ স্টাম্পের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া বলে তাঁর দুর্বলতা ধরা পড়েছে বারবার। বর্তমানে সারা বিশ্বেই সেরকম উচ্চমানের স্পিনার না থাকলেও সব দেশের স্পিনারদের বিরুদ্ধে কোহলি একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছেন এবং উইকেট হারিয়েছেন।
তৃতীয়ত, নিন্দুকেরা বলেন সচিন সেঞ্চুরি করলেই দল হেরে যায়! তাঁরা তথ্যগত ভাবে সঠিক নন একেবারেই। সচিনের ৪৯ টি ওয়ান ডে সেঞ্চুরির মধ্যে ভারত ৩৩ টি ম্যাচে জয়লাভ করেছে। অন্যদিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সচিনের সেঞ্চুরি করেও হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সতীর্থরা সচিনকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মরুঝড় (১৪৩), চেন্নাই টেস্টের (৯৯) ১৩৬ বা ২০১০ সালের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩৫০ রান তাড়া করে ১৭৫ রানের ইনিংসের ক্ষেত্রে অন্য কেউ তাঁর অর্ধেক বা কখনও কখনও এক তৃতীয়াংশ রান করেও তাঁকে সাহায্য করতে পারেননি। অন্যদিকে, কোহলি যখন রান ধাওয়া করে ম্যাচ জিতিয়েছেন পাশে পেয়েছেন ধাওয়ান, রোহিত, ধোনি বা যুবরাজের মতো ওয়ান ডে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানদের। এই সহ খেলোয়াড়দের অধিকাংশই কোহলির সঙ্গে ভালো পার্টনারশিপ করেই ম্যাচ জেতাতে সাহায্য করেছেন।
চতুর্থত, ওয়ান ডে ক্রিকেটে বর্তমানে ব্যাটসম্যানদের গড় অনেক বেড়ে গিয়েছে। এর প্রধান কারণ পাওয়ারপ্লে। দুটো নতুন বলের কারণে রিভার্স সুইং না হওয়া, সারা বিশ্বের ড্রপ ইন পিচের কারণে ব্যাটসম্যান ফ্রেন্ডলি উইকেট! তাই এখন যেকোনও ভালো ব্যাটসম্যানের ওয়ান ডে গড় ৫০-এর উপরেই থাকে। এবার আসা যাক সচিনের আমলে, গড় ৪০-কেই তখন খুব উচ্চমান বলে ধরে নেওয়া হতো। সচিন তাঁর কেরিয়ারের শুরুর ৫ বছর লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করতেন বলে সচিনের গড় ও মোট রান শুরুর দিকে খুব ভালো ছিল না একথা আশা করি সকলেই স্বীকার করবেন। প্রথম সেঞ্চুরি পেতেও ওয়ান ডে তে তাঁকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়। অপরদিকে কোহলি প্রথম থেকেই টপ অর্ডারে খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
পঞ্চমত, কোহলি চেসমাস্টার হলেও, আগে ব্যাট করে তাঁর রেকর্ড তত ভালো নয়। অন্যদিকে, সচিন আগে ব্যাট করে দারুণ রেকর্ডের পাশাপাশি চেস করেও কোহলির ঠিক পরেই পরিসংখ্যান ধরে রেখেছেন। সতীর্থদের সাহায্য পেলে চেস করে সচিন আরও অনেক ম্যাচ জেতাতে পারতেন সেটা স্কোরকার্ড দেখলেই বোঝা যায়। ক্রিকেট দলগত খেলা, ৩০০ রান একা ভালো খেলে চেস করা যায় না সেটা যে কেউ বুঝবেন।
ষষ্ঠত, সচিন কেরিয়ারের শেষদিকে টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। আর কোহলি খেলেছেন প্রথম থেকেই। তাই টি-টোয়েন্টির রেকর্ড দিয়ে সচিন-বিরাট বিতর্কের বিচার করা একেবারেই সঠিক কাজ নয়। সচিন সর্বসাকুল্যে মাত্র ১ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। আর কোহলিকে নির্দ্বিধায় টি-টোয়েন্টির অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বলা যায়, তবে সর্বকালের সেরা বলা যায় না কখনই।
সপ্তমত, বিশ্বকাপে সচিনের পারফরম্যান্স বিশ্বসেরা। সবার থেকে বেশি রান করার বিষয়টি পাশে রেখেও তিনি তিনবার ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছেন, ২ বারের টপ স্কোরার ও ১ বার ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছেন। কোহলি সেখানে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে মাঝারি মানের পারফরম্যান্স দিয়েছেন। একটিও নক আউট ম্যাচে তিনি দলকে জেতাতে পারেননি এখনও অবধি।
অষ্টমত, অনেকেই মনে করেন সচিন বহু বছর খেলেছেন, ফলে এতকাল খেললে এত রেকর্ড তো হতই! কিন্তু মনে রাখতে হবে, বহুদিন খেললেই রেকর্ড এমনি এমনিই হয় না। বহু বছর ধরে নিজের ফর্ম ও ফিটনেস ধরে রাখতে না পারলে মাঠে নামাই সম্ভব নয়। আজকাল অত্যাধুনিক ফিটনেস ট্রেনিং নেওয়া খেলোয়াড়রাও দুটো সিরিজ টানা খেলতে সমস্যায় পড়ছেন। টেনিস এলবো, কোমরের চোট, আরও নানারকম আঘাত নিয়ে ২৪ বছর খেলাটাই বিশাল কৃতিত্বের। পন্টিং, কালিস, লারা বা সাঙ্গাকারা কেউই এত দীর্ঘসময় খেলার মতো ফর্ম ধরে রাখতে পারেননি। আসা যাক কোহলির কথায়। নিজের কেরিয়ারের প্রাইম টাইমে প্রায় তিন বছর ফর্ম হারিয়ে বসে ছিলেন বিরাট।
সবশেষে বলা যায়, সচিন একটা ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দলকে লড়তে শিখিয়েছিলেন। গাভাস্কার, অমরনাথ, কপিল, বিশ্বনাথ, বেঙ্গসরকারের অবসরের পরে আজহারের নেতৃত্বে হারের পর হারের মুখ দেখা দলের একা কুম্ভ হয়ে লড়ে যেতেন সচিন। সচিনকে আউট করা মানেই ভারত শেষ, এই নীতি নিয়েই বিপক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে মাঠে নামতো। সেখানে কোহলি শুরু থেকেই একটি শক্তিশালী দলের সদস্য হতে পেরেছেন। শেহবাগ, রোহিত বা কোহলির মতো ব্যাটসম্যানরা সচিনকে দেখেই ক্রিকেট খেলা শুরু করেছেন। কোহলি নিজে একাধিকবার বলেছেন তিনি ব্যাটসম্যান হিসেবে সচিনের সঙ্গে তুলনার যোগ্যই নন, সচিন গুরু হলে তিনি শুধুই এক সুযোগ্য শিষ্য। সচিনের সময়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সচিনের ফ্যান ছিলেন। সেখানে বর্তমান প্রজন্মই ধোনি না কোহলি, নাকি রোহিত এই বিভাজনে বিভক্ত! তাই সচিনের মতো সবার হৃদয়ে জায়গা পাননি বিরাট।
তাই কোহলি নন, ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান অবশ্যই সচিন রমেশ তেন্ডুলকার। কোহলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সেরা কিন্তু সব ক্ষেত্র মিলিয়ে, কালের বিরাট প্রবাহপথে তিনি শ্রেষ্ঠ কখনই নন।