অবহেলিতা নেপালি মেয়ের চিত্রনির্মাতা হয়ে ওঠার কাহিনি- শেষ পর্ব
২০১৩ সালে কার্পেন্টার পুনরায় নেপালের পোখরায় ফিরে যান | তিনি আশা করেছিলেন যে ছয়-সাত বছরের ব্যবধানে তাঁর পরিচিত মেয়েগুলি আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে চলে গিয়ে থাকবে | কিন্তু, তিনি দেখে অবাক হয়ে যান যে- অধিকাংশ মেয়েরা তখনও আশ্রয়কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তাঁদের ওঁর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না | তিনি অনেক কষ্টে এক সমাজ কর্মীর সাহায্যে বেলমায়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন | বেলমায়া তাঁর সঙ্গে ক্ষীণ কণ্ঠে কথা বলে | তাঁর ফোনে বেলমায়া যে ছবি পাঠিয়েছিল, তা দেখে কার্পেন্টার খুব ব্যথিত হয়েছিলেন | ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, বেলমায়া এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর স্বামীর খড়ে ছাওয়া কুটিরের পশে ঘোমটা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, কোলে একটি শিশুকন্যা| ছবিটির সর্বাঙ্গে চরম দারিদ্রের ছাপ| তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, এক লাঞ্ছনার পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে মেয়েটি আর এক লাঞ্ছনার পরিবেশে গিয়ে পড়েছে, স্বামী ও শাশুড়ির হাতে লাঞ্চিত হচ্ছে |
পরের বছর বেলমায়ার স্বামী কাজ ও অর্থ উপার্জনের আশায় সপরিবারে পোখারায় ফিরে আসে | তখন কার্পেন্টার এক স্থানীয় নেপালী চলচ্চিত্রে নির্মাতার সাহায্যে বেলমায়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সফল হন | এবার মেয়েটি আর একটি সুযোগ পেল | ঐ ফটোপ্রোজেক্টের অধীনে গড়া একটি তহবলের অর্থনাকূল্যে বেলমায়া তথ্যচিত্র নির্মাণের কলাকৌশল শেখার একটি পাঠক্রমে ভর্তি হল | এই পাঠক্রমে বেলমায়া শিখল কেমন করে ছবির মাধ্যমে নিজের কাহিনী দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাবে তুলে ধরা যায় | এই কালপর্বে তাঁরা সম্মত হলেন যে তথ্যচিত্রর পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন কার্পেন্টার স্বয়ং এবং ক্যামেরার দায়িত্বে থাকবে বেলমায়া| কার্পেন্টার আশা করেছিলেন যে, এইভাবে বেলমায়া তাঁর নিজের ছবি নির্মাণের বিদ্যাও আয়ত্ব করে নিতে শিখবে|
এমনি করে যখন বেলমায়ার মধ্যে সেই পুরনো উৎসাহ উদ্দীপনা ও সংগ্রামী মনোভাব জেগে উঠল, তখন তার স্বামীও তীব্রভাবে তার বিরুদ্ধতা করা শুরু করল | সাংসারিক অশান্তি চরমে উঠল | বেলমায়া সাংসারিক জীবন ও তার চিত্রনির্মাণ এক বাঁকের মুখে এসে পড়ল |
সমস্ত বিরুদ্ধতা কাটিয়ে বেলমায়া শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালেন| তাঁর স্বামীর মধ্যেও বাহিক্যভাবে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা দিল, সে কন্যাসন্তানের দেখভালের দায়িত্ব নিল আর বেলমায়া চিত্রনির্মাণে মনোনিবেশ করলেন| তিনি তৈরি করলেন 'এডুকেট আওয়ার ডোটার্স' নামের চলচ্চিত্র| তাঁর অতীত জীবনের সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড় করালেন এবং সততার সঙ্গে তুলে ধরলেন নারীশিক্ষার প্রসারের প্রয়োজনীয়তার কথা| এই নিষ্ঠা, সততা ও অধ্যাবসায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দর্শকদের হৃদয় জয় করে নিল| এই ছবিটি 'কাঠমান্ডু ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'-এ প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হল|
সেই থেকে বেলমায়ার প্রগতি শুরু | ২০১৯ সালে সে 'ইউ-কে এশিয়ান ফিল্ম' ফেস্টিভ্যালে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হল | কিছুদিন পরে সে লন্ডনের বাফতায় গ্রান্ড অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে আমন্ত্রিত হল এবং তার তার নির্মিত একটি ছায়াছবি শট ফিল্ম (স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র) -বিভাগে পুরষ্কৃত হল |
অতিমারীর পরিবেশে তাঁর ছবি 'আই অ্যায়াম বেলমায়া' ছবিটি অনলাইন স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে নেপালের ফিল্ম প্রজেক্টের জন্য ১২০০০ পাউন্ড সংগ্রহ করতে সফল হয়েছে এবং তার সহপরিচালিকা হিসেবে দুবছরের জন্য তার প্রাপ্য অর্থ পেয়েছে | এমনি করে বেলমায়া একজন অগ্রণী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে উঠে এসেছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মহিলাদের কাছে আশা, উৎসাহ আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে |