জঘন্য ক্রীতদাস প্রথা না থাকলে বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার হতোই না! লজ্জার সেই ইতিহাস

সেই অগণিত অত্যাচারিত মানুষদের কথা বিজ্ঞানের জয়গান গাওয়ার সময় বিশেষ উচ্চারিত হয়নি।

প্রতি বছর ২৩ অগাস্ট পালিত হয় 'দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য রিমেম্বারেন্স ফর দ্য স্লেভ ট্রেড অ্যান্ড ইট্স অ্যাবোলিশন'। আটলান্টিক মহাসাগরের (ট্রান্স-আটলান্টিক) তীরবর্তী দেশগুলিজুড়ে দীর্ঘকাল ধরে যে ক্রীতদাস প্রথা চলেছে, এবং কালক্রমে সেই প্রথার বিলুপ্তিকরণের ইতিহাসকে স্মরণ করতে এই দিনটি পালন করা হয়। ১৭৯১ সালের ২২ এবং ২৩ অগাস্টজুড়ে সেন্ট ডমিনিকে থাকা ক্রীতদাসরা মালিকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে গর্জে ওঠেন। শুরু হয় কুখ্যাত ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের এক দীর্ঘ, কঠিন লড়াই। ১৮০৭ সালের ২৫ মার্চ শেষ পর্যন্ত অবলুপ্তি ঘটে এই দীর্ঘ, অমানুষিক প্রথার। সেই লড়াইকে মর্যাদা দিতে ইউনেসকোর উদ্যোগে ১৯৯৮ সালের ২৩ অগাস্ট প্রথমবার পালিত হয় দ্য ইন্টারন্যাশানাল ডে ফর দ্য রিমেম্বারেন্স ফর দ্য স্লেভ ট্রেড অ্যান্ড ইটস অ্যাবোলিশন।

চিনি, গুড় থেকে শুরু করে তামাক, তুলো, চাল, বয়নসামগ্রী, এমনকী, বন্দুকও রফতানি হয়েছে ট্রান্স-আটলান্টিক পথে। সঙ্গে পণ্যের মতো করে কেনাবেচা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের। কিন্তু কখনও কি আমরা ভেবেছিলাম, তার সঙ্গে বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাও জড়িয়ে রয়েছে? আমরা ক’জনই বা জানতাম ট্রান্স-আটলান্টিক পথে ক্রীতদাস হিসেবে উর্ধ্বতনের চাবুক মুখ বুজে সয়েছে যে অগুনতি নামহীন, মুখহীন মানুষ, তাঁদের অবদানও বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে!

ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. ক্যারোলিন রবার্টস দ্য রয়্যাল সোসাইটির একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন ট্রান্স-আটলান্টিক ক্রীতদাস প্রথা যখন রমরমিয়ে চলেছে, তখন সেখানে ক্রীতদাস-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীদের। সুদূর আফ্রিকা থেকে আসত বিভিন্ন গাছ এবং প্রাণীদের নমুনা, যা তৎকালীন সময়ে দেশ-বিদেশের গাছপালা ও প্রাণীদের চিনতে এবং তাদের শ্রেণিবিন্যাস বা ট্যাক্সোনমিক স্টাডিতে কাজে লাগাতেন ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুন: শিশুদের কাছে বিজ্ঞানকে সহজ করে তুলেছিলেন, বাঙালি মনে রাখেনি গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে

১৬৬৭ সালে থমাস স্প্র্যাটের প্রকাশিত হিস্ট্রি অফ রয়্যাল সোসাইটি ইন লন্ডন-এর সূত্রে জানা যাচ্ছে, রয়্যাল সোসাইটি এবং রয়্যাল অ্যাডভেঞ্চার ট্রেডিং টু আফ্রিকা, এই দুইয়ের ছিল গলায় গলায় সম্পর্ক। রয়্যাল অ্যাডভেঞ্চার ট্রেডিং টু আফ্রিকা ব্রিটেনে ক্রীতদাস ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত সুপ্রাচীন সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোয়াইটি যে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা, অনুসন্ধান এবং বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত, সে আমাদের অনেকেরই জানা। এই দুই সংস্থাই গড়ে ওঠে ১৬৬০ সালে। আজও রয়্যাল সোসাইটির অফ ইংল্যান্ডের 'ফেলো' নির্বাচিত হওয়া একটি অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় লক্ষ্যণীয় অবদান থাকলে তবেই হয়তো রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হিসেবে মাথায় একটই মুকুট চড়ে। মার্ক গোভিয়ারের গবেষণা বলছে রয়্যাল সোসাইটির একাধিক 'ফেলো' ১৬৬০ শতাব্দী থেকেই রয়্যাল অ্যাডভেঞ্চার ট্রেডিং টু আফ্রিকার সদস‍্য ছিলেন, এমনকী, ম্যানেজারের পদেও আসীন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই।

একদিকে বিজ্ঞানের অজানাকে জানার বাসনা, অন্যদিকে ক্রীতদাস ব্যবসা, এই দুই কেবল পাল্লা দিয়ে চলেনি, এই দু'টি বিষয় ইন্ধন জুগিয়েছে পরস্পরকে। জেমস পেটিভার ছিলেন সেরকম একজন। ব্রিটেনের জাহাজ যখন ক্রীতদাসদের নিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার বন্দরে ভিড়ত, তখন ক্রীতদাসদের ওপর মনিবদের কড়া আদেশ থাকত, তারা যেন বন্দরের আশেপাশে ঘুরে না বেড়ায়। বন্দরেই নিজেদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখতে হতো। এর পিছনে মূল কারণ হল, স্পেনও তখন বাণিজ্য করছে ল্যাটিন আমেরিকায়। স্পেন চাইত ল্যাটিন আমেরিকার বন্দর-সংলগ্ন অঞ্চলে লোভনীয় যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার ওপর যাতে কেবল স্পেনেরই একচেটিয়া অধিকার থাকে।


কিন্তু পেটিভার জানতেন, স্পেন চাইলেও এই কঠিন নিয়ম ক্রীতদাসদের ওপর আরোপ করতে পারবে না। সেই সুযোগে পেটিভার ক্রীতদাসদের দিয়ে লুকিয়ে নানারকম প্রাণী ও উদ্ভিদ সংগ্রহ করাতেন নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে। যদিও পেটিভার নিজে সরাসরি এই কাজ করাতেন না। তিনি পাঠাতেন জাহাজের সার্জেনদের, যাঁদের আবার অগাধ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও ছিল। সার্জেনরা এই কাজের বিনিময়ে পেটিভারের থেকে বই, ওষুধ এবং অর্থ পেতেন।

পেটিভার ছাড়াও একাধিক গবেষক জড়িত ছিলেন এই কাজে। ক্রীতদাসদের সাহায্যে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছে অস্ট্রিচের ডিম, গোলিয়াথ বিটল, স্লথ এবং আর্মাডিলো। কিন্তু তার থেকেও অমূল্য যে সমস্ত জিনিস ইংল্যান্ড অবধি পৌঁছেছিল আটলান্টিক পথে, তা হলো সিঙ্কোনা গাছের ছাল, যা থেকে তৈরি হয়েছে ম্যালেরিয়ার কালজয়ী ওষুধ কুইনাইন, জানা যাচ্ছে, রয়্যাল সোসাইটি প্রকাশিত 'ফিলোজ়ফিক্যাল ট্রানজ্যা়কশন' সূত্রে। আরও অনেক মূল্যবান ওষুধের মধ্যে ছিল রক্তক্ষরণ, যৌন রোগ, এবং স্কার্ভির ওষুধ। বাদ পড়েনি স্মল পক্স, কৃমি, দাঁতের ব্যথার ওষুধও।


আর ছিল ইন্ডিগো এবং কোচানিলের মতো রঞ্জক। কোচানিল সংগ্রহ করা হতো এক ধরনের বিটলের শরীর থেকে, যার তৎকালীন মূল্য শুনলে চোখ কপালে উঠবে। রূপোর থেকেও বেশি দাম ছিল উজ্জ্বল লাল এই রঞ্জকের।

আর এই ঔষধিগুণসম্পন্ন গাছ এবং মূল্যবান রঞ্জক নিয়ে যখন আরও গবেষণা শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা, ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরাও নতুন ব্যবসা আরম্ভের সুযোগ পেয়ে গেলেন। শুধু তাই নয় ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সেই উদ্ভিদগুলিকে চাষ করা শুরু করলেন, এর পাশাপাশি শুরু হলো যথেচ্ছ শোষণ। ভেষজ উদ্ভিদের চাষে নিয়োগ করা হলো ক্রীতদাসদের। ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা যত বাড়তে লাগল, পাল্লা দিয়ে বাড়ল আরও বেশিসংখ্যক ক্রীতদাসের প্রয়োজনীয়তা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তা শোষণ এবং নিপীড়ন বাড়িয়ে তুলেছিল।

এই সময় বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেবল ক্রীতদাস প্রথার ওপর নির্ভরশীল ছিল না, বিজ্ঞানী এবং তাঁদের গবেষণার সূত্র ধরে আরও বিস্তার লাভ করেছিল ক্রীতদাস প্রথা।

ন্যাচারাল সায়েন্স তখন আদতেই ক্রীতদাসপ্রথা নির্ভরশীল ছিল। ন্যাচারাল সায়েন্সের মধ্যে সবথেকে বেশি রসদ সংগ্রহ করেছে উদ্ভিদবিদ এবং প্রাণীবিদরা। সেইরকমই উদ্ভিদবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ক্যারোলাস লিনিয়াস, যাঁকে বলা হয় 'ফাদার অফ ট্যাক্সোনমি'। আজ যত উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস হয়, তা মূলত লিনিয়াসের উদ্ভিদ-শ্রেণিবিন্যাসের পদ্ধতিকে অবলম্বন করেই হয়।

উদ্ভিদ ও পতঙ্গবিদদের পাশাপাশি যে-সমস্ত ডাক্তার ক্রীতদাস ব্যবসার সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা মানুষের দেহাংশ সংগ্রহ করাতেন ক্রীতদাসদের দিয়ে, জানাচ্ছেন ক্যারোলিন রবার্টস।

আইজ্যা়ক নিউটনের মতো ব্যক্তি, যিনি প্রায় নিজের গবেষণাগার এবং টেবিল-চেয়ারে বসেই মূলত গবেষণা করেছেন, তাঁকে গবেষণার উদ্দেশ্যে কোথাও ভ্রমণও করতে হয়নি, সেই নিউটনও পরোক্ষভাবে জড়িয়েছিলেন ক্রীতদাসপ্রথার সঙ্গে। ট্রান্স-আটলান্টিক পথে ফরাসি ক্রীতদাস বন্দর থেকে এসেছিল তাঁর গবেষণার জন্যে প্রয়োজনীয় তথ্য। তিনি তখন সারা বিশ্বের সমুদ্রের ঢেউয়ের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করছেন।

১৫০০ থেকে ১৮০০ শতকের মধ্যে লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ নারী-পুরুষকে ক্রীতদাস হিসেবে কেনাবেচা করা হয়েছে। আজকের বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং তার উন্নতির সঙ্গে তাঁদের অবদান ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কিন্তু সেই অগণিত অত্যাচারিত মানুষদের কথা বিজ্ঞানের জয়গান গাওয়ার সময় বিশেষ উচ্চারিত হয়নি।

More Articles